কেউ কিছু বলতে পারে না by নুরুল করিম নাসিম

তিনি পালিয়ে যাচ্ছেন। নিজ বাসভূমি নড়িয়া ছেড়ে ঢাকা শহরে আত্মগোপন করার জন্য পালিয়ে যাচ্ছেন। গতরাতে তিনি ঘুমোতে পারেননি। দলের নির্দেশ পালন করতে হলে এলাকাবাসীর বিরাগভাজন হতে হয়, ক্ষমতাসীন দলের প্রশাসন উষ্মা প্রকাশ করে। তিনি কি করবেন? তার দল ক্ষমতায় নেই। দেশে এখন সামরিক শাসন। ফিল্ডমার্শাল আইয়ুব খান এখন দেশের সর্বময় কর্তা। গত বছর তিনি এস্কান্দার মির্জার গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাত করে এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছেন। তিনি এখন বিরোধী দলে। দলের নির্দেশ সবকিছু অচল করে দিতে হবে। সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে হবে। ঢাকার বাইরে সব যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থগিত করে ফেলতে হবে। সড়কপথ, জলপথ, সবরকম যোগাযোগ ব্যবস্থা অচল করে দিতে হবে।
তার এক ছেলে ঢাকায় থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছে। তার তিন মেয়ে এলাকার স্কুল-কলেজে পড়ছে। হরতাল কিংবা অবরোধে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার অনেক ক্ষতি হয়ে যায়। তিনি সবকিছু বোঝেন, সবকিছু উপলব্ধি করেন, কিন্তু বলতে পারেন না। পার্টির ভেতরে থেকে এসব কথা বলা যায় না। পার্টি এসব পছন্দ করে না। পার্টি চায় নিরংকুশ নিবেদন। কাল সারা রাত তিনি ঘুমোতে পারেননি। বার বার ঘুম ভেঙে গেছে। তার মনে হয়েছে কে যেন দরজায় নক করছে। তিনি হঠাৎ হঠাৎ জেগে উঠেছেন। দরজা খুলে দেখেন কেউ নেই, কোনো পুলিশ আসেনি। রাত ৩টায় বিল্লাল টেলিফোন করে বলল, লিংকন ও আফাজ উদ্দিনকে সাদা পোশাকের পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। কোথায় নিয়ে গেছে, কেউ বলতে পারে না। এরা দুজন দলের ওপর সারির নেতা। খুবই কর্মঠ, খুবই আত্মত্যাগী। পার্টির জন্মলগ্ন থেকে এরা খুব গভীরভাবে দলের সঙ্গে জড়িত। বিল্লাল দলের নীতিনির্ধারক। এলাকায় থাকেন। দলের ওপর প্রভাব আছে।
রাতে অনেক চেষ্টা করেও তিনি ঘুমাতে পারেননি। মনে হয়েছে, দরজায় পুলিশ কড়া নাড়ছে। সাদা পোশাকের পুলিশ তাকে অ্যারেস্ট করতে এসেছে। কিন্তু বাস্তবে পুলিশের বড়কর্তার সঙ্গে তার ভালো হৃদ্যতা। পুলিশ বলেছেন, ঘরে থাকবেন না, ঢাকায় চলে যান। তিনি চলে যাচ্ছেন। সুরেশ্বর থেকে সকাল ৮টায় লঞ্চে উঠেছেন। তার স্ত্রী কন্যারা এলাকাতে রয়ে গেছেন। শুধু তিনি চলে যাচ্ছেন। স্ত্রীর টেলিফোন এলো সকাল ৯টায়। তখন তিনি পদ্মার বুকে। লঞ্চ ঢাকার সদরঘাটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। স্ত্রী বললেন, তার ভয় লাগে। কাছেই বাবা-মার বাড়ি। ছেলেমেয়ে নিয়ে দিনকয় সেখানে বেড়িয়ে এলে কেমন হয়? তিনি সম্মতি দিলেন।
শীতকাল। লঞ্চ এগোচ্ছে। পদ্মা অতটা উন্মত্ত নয়। তার সব আক্রোশ ভেতরে ভেতরে। দেশের রাজনীতির সঙ্গে, তার দলের রাজনীতির সঙ্গে কোথায় যেন মিল আছে এ পদ্মার। তার স্ত্রী হয়তো ভয় পেয়েছে। এলাকায় কিছু হবে না। পুলিশ তার বাসায় কখনও রেইড করবে না। তবুও তার স্ত্রী ভয় পান। এখন দেশে সামরিক শাসন। কি হবে, কেউ কিছু বলতে পারে না। তিনিও বাসায় থাকতে পারছেন না, পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। তার স্ত্রীও তিন মেয়ে, এক ছেলেকে নিয়ে বাপের বাড়িতে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। তার ব্যবসা-বাণিজ্য নেই। এ সামরিক সরকারের আমলে কোনো কাজ পাবেন বলে মনে হয় না। কিভাবে জীবন চলবে কিছুই বুঝতে পারছেন না।
অনেক বার ভেবেছেন রাজনীতি ছেড়ে দেবেন। দেশে যা কিছু জমিজমা আছে বর্গা দেবেন, তাতেই চলে যাবে। কিন্তু এটা এমন এক নেশা, ড্রাগের চেয়েও মারাত্মক, কিছুতেই ছাড়াতে পারেন না। আর রাজনীতিও এমন এক দৈত্য, তার কাঁধে সেই যে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে চেপে বসেছে, আর তাকে পরিত্যাগ করছে না। এ রাজনীতির জন্য তার প্রেম মরে গেল। তার ভালোবাসার মানুষ তাকে পরিত্যাগ করে চলে গেল। তার বড় মেয়ে অনেকবার তাকে বারণ করেছে। তার স্ত্রীরও রাজনীতি পছন্দ নয়। তিনিও অনেকবার ভেবেছেন, রাজনীতি ত্যাগ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবেন। কেন্দ্র থেকে নির্দেশ এসেছে, যানবাহন প্রতিরোধ করার ব্যাপারে সব ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হোক। নদীপথ অবরোধ করা হোক। তিনি লঞ্চে করে পালিয়ে যাচ্ছেন। সারেংয়ের পাশে বসে যেতে যেতে তার অনেক কথা, অনেক স্মৃতি মনে উঁকি দিয়ে যায়।
এত দিনের কথা খুব গেঁথে আছে। তখন তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষবর্ষের ছাত্র। কমিউনিস্টদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন। তার প্রিয় শিক্ষকের প্ররোচনায় ও অনুপ্রেরণায় মাক্সবাদে দীক্ষা নিলেন। শ্রেণী-সংগ্রামে আÍনিয়োগ করলেন। সমাজের এক দল মানুষ অন্য মানুষদের কেন শোষণ করছে, সারা দুনিয়ার মজুররা একই পতাকা তলে কেন একত্রিত হচ্ছে, লাতিন আমেরিকার চেগুয়েভারা ও ফিদেল ক্যাস্ট্রো কেন আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন, এসব ঘটনা প্রতিদিন তার প্রিয় শিক্ষক তাকে বলেছেন। গ্র“প স্টাডি নিয়মিত হচ্ছে। তিনি অংশগ্রহণ করছেন। অনুপ্রেরণায় পুরানা পল্টনের একটি বাড়িতে মিটিং হতো। গ্র“প স্টাডি হতো। স্বৈরাচারী ফিল্ডমার্শাল আইয়ুব খান ক্ষমতার খুঁটি ক্রমশ শক্ত করেছেন। জনগণ ফুঁসে উঠেছে। যে কোনো সময় বিস্ফোরণ হতে পারে। রক্তহীন বিপ্লবের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকার এস্কান্দার মির্জাকে ক্ষমতাচ্যুত করেছেন।
সর্বত্র ভয় বিরাজ করছে। বিশিষ্ট নেতাদের কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়েছে। আপামর জনসাধারণের প্রিয় নেতা শহীদ সোহরাওয়ার্দী বইরুতে চিকিৎসা করতে গেছেন। রবীন্দ্র সঙ্গীত আর মেয়েদের কপালে লাল টিপের ওপর এক অলিখিত নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। তিনি সেদিন পুরান ঢাকার এক বাসায় গোপন মিটিং করছেন তার প্রিয় শিক্ষকের সঙ্গে। হঠাৎ পুলিশ রেইড করল তখন রাত ২টা। পেছনের দেয়াল দিয়ে তিনি লাফিয়ে পালিয়ে গেলেন। একটা রাত জাগা কুকুর ডেকে উঠল। কোথায় যেন পাহারাদার হুইসেল বাজাল। একটি অ্যাম্বুলেন্স করুণ আর্তনাদ তুলে কোথায় যেন দ্রুত বেগে চলে গেল।
কী ছিল সেসব দুর্ধর্ষ দিনরাত্রি! কী ছিল সেই যৌবনের তেজ ও দীপ্তি আর স্বপ্ন। তিনি সমাজটাকে বদলাতে চেয়েছিলেন। সেদিন তার প্রিয় শিক্ষক, এদেশের বাম আন্দোলনের এক বিশিষ্ট তাত্ত্বিক পালাতে পারেননি। পুলিশের হাতে ধরা পড়েছিলেন। তাকে কারাজীবন বরণ করে নিতে হয়। তার প্রিয় শিক্ষক কারাগারে ধুঁকে ধুঁকে মারা গিয়েছিলেন। সামরিক শাসন প্রচণ্ডভাবে দেশের সর্বত্র তখন বিরাজ করছে। ১৯৬৭-এর উন্মাতাল আন্দোলনে মুখর দেশ। নেতা ঢাকা শহর অভিমুখে পালিয়ে যাচ্ছেন। তার নড়িয়ার বাড়িতে সবাই তাকে চেনে। ঢাকা শহরে কেউ তাকে চেনে না। নেতা শহরে আত্মগোপন করে থাকবেন।
তিনি এখন দিনরাত্রির অধিকাংশ সময় ঘরে থাকেন। স্বেচ্ছায় গৃহবন্দি। তার প্রিয় শিক্ষককে পুলিশের হাতে ফেলে একদা পালিয়ে গিয়েছিলেন। সেসব স্মৃতি এখন তাকে ঠুকরে ঠুকরে খায়। এক ধরনের অনুশোচনা তাকে বিহ্বল করে তোলে। তার প্রিয় শিক্ষক কি তবে তাকে অভিশাপ দিয়েছিলেন? এজন্য কি তার এ অসহায় অবস্থা? এভাবেই সময় বয়ে যায়। মুখমণ্ডল ক্রমান্বয়ে দাড়িতে ঢেকে যাচ্ছে। তিনি নিজেকে আর চিনতে পারেন না। তিনি চিরদিনের মতো নিজের ভেতর আত্মগোপন করে রইলেন।

No comments

Powered by Blogger.