কাগজের রাজকন্যে by উম্মে মুসলিমা

মাটির পুতুল, কাঠের পুতুল বা কলের পুতুল নয়, ক্লাস সিক্সে উঠে আমার পুতুলরা কাগজের পুতুল হয়ে সংসার শুরু করল। সাদা কাগজ ভাঁজ করে কলম দিয়ে চোখ, ভ্রূ, নাক, ঠোঁট, চুল এঁকে শাড়ি পরিয়ে পেছনের বারান্দায় পরিত্যক্ত টেবিলের ওপর ওদের জন্য তৈরি ঘরের মধ্যে বসিয়ে দিতাম। বড় বোনের ফেলে দেওয়া খাতার শক্ত কভার ছিঁড়ে ওদের টেবিল, খাট, চেয়ার বানাতাম। বড়াপার স্কুলে দেয়াশলাই, ফোম আর ছিটকাপড় দিয়ে ওদের গার্হস্থ্য ক্লাসে সোফা বানাতে শিখিয়েছিল। সেরকম এক সেট সোফা ছিল আমার পুতুলদের সবচেয়ে দামি আসবাব। ওদের নাম ছিল রানু, লাইজু, ডলি, বুলু আর গৃহপরিচারিকা রোমেছা। ওদের একটাই ভাই ছিল_ নাম আদিল। আদিল নামেই ছিল। তার কোনো কাগজিক উপস্থিতি ছিল না। পেছনের বারান্দাতে কেউ সচরাচর যেত না। বারান্দার সামনেই ছিল একটা সজিনা গাছ। বারান্দার ধুলোয় সজিনা ফুল পড়ে শুকিয়ে যেত, কেউ ঝাঁট দিত না। আমি সকালে উঠেই বারান্দায় উঁকি দিতাম সজিনা ফুলগুলো যথারীতি আছে কি-না তা দেখাতে। কারণ ফুল থাকলেই আমার রানু-লাইজুরা থাকবে। একবার এক নতুন গৃহপরিচারিকা ফুলসমেত আমার পুতুলের সংসার ঝাঁট দিয়ে ময়লার গাদায় ফেলে এসেছিল। কেবল আমার বিধবা বড় খালা এলে ওখানে বসে সারা দুপুর নকশিকাঁথা সেলাই করত আর হুলিয়ানামা পড়ত। হুলিয়ানামা হলো আমাদের নবী করিমের (সা.) গুণগান। খালা কেমন কান্নার সুরে ছন্দোবদ্ধ সেই হুলিয়ানামা মুখস্থ পড়ে যেত আর কাঁথার বুকে সুচে ঢেউ তুলত। ভাবতাম খালা তার দুঃখের জীবন কান্নার সুরে আওড়াচ্ছে। আমি পুতুলের শাড়ি পাল্টে দিতে দিতে খালার দুঃখে কাঁদতাম। এখনও ক'টা লাইন মনে আছে _
'আল্লা আল্লা বল বান্দা নবী কর সার
মোহাম্মদের দ্বিন বিনা রাহা নাহি আর
মোহাম্মদের চারি ইয়ার নাম তাহা শোন
আবুবকর ওমর ওসমান আলী চারিজন'
বড় খালার করুণ সুরের হুলিয়ায় আমি অভ্যস্ত হয়ে গেলাম। আর কান্না পেত না। আমি আপন মনে ঠ্যাং বের করে খালার উল্টো দিকে বসে পুতুলদের কাপড় খুলতাম, পরাতাম আর ওদের একে অন্যের সংলাপ নিজে নিজে বলতাম। একবার বড় খালা শুধু বলেছিল_
'এত ছোট ফ্রক আর পরো না টিকলি। তুমি বড় হচ্ছো। হাঁটু অব্দি বড় ফ্রক বানাতে বলব তোমার মাকে।'
'কিন্তু ওবাড়ির ডলি-বুলুরা তো আমার চেয়ে বড়। ওদেরকেও তো ছোট ফ্রক পরে বাগানে খেলতে দেখেছি'
'ওদের কথা বাদ দাও'।
আমিও ওদের কথা বাদই দিই। ওরা আর আমরা তো সমান নই। তবুও ওদের নিয়েই আমার সংসার।
ওটা ছিল একান্তই আমার রাজত্ব। সেবার আমার ছোটমামা বড় খালাকে নিতে এলে আমার সাজানো সংসার তছনছ করে দেয়। বারান্দায় গিয়ে লুকিয়ে সিগারেট টানতে টানতে ছোট মামা আমাকে ডাক দিল_
'এই টিকলি, এগুলো কী রে?'
'ছোটমামা, খবরদার ওগুলোতে হাত দেবে না কিন্তু'_ আমি হা হা করে ছুটে আসলাম। ততক্ষণে ছোট মামা মুখের মধ্যে সিগারেটের ধোঁয়া ভরে আমার ডলি-বুলুর সাজানো ঘরের ওপর জোরে ফুঁ দিতে দিতে বলল_
'দেখ দেখ কেমন ঘূর্ণিঝড়। সব উড়ে যাচ্ছে।'
আমি আঁচড়ে কামড়ে ছোট মামার ওপর প্রতিশোধ নিতে গিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললাম_
'তুমি যে এখানে লুকিয়ে লুকিয়ে সিগারেট খাও আমি বাবাকে বলে দেব'।
ছোট মামা সেগুলো আবার কুড়িয়ে আমার হাতে পাঁচ টাকার কয়েন ধরিয়ে দিয়ে ভয়ে ভয়ে বলল_
'আচ্ছা নে ধর, বলে দিলে আমিও কিন্তু তোকে মিলিটারিদের ক্যাম্পে নিয়ে যাব'।
আমাদের মফস্বল শহরে পাকিস্তানি মিলিটারিরা ক্যাম্প করেছে। স্কুল-কলেজ সব বন্ধ। রাস্তার এপাশে আমাদের ছোটখাটো একতলা বাড়ি। ওপাশে জান মোহম্মদের বিশাল তিনতলা 'জাহান মঞ্জিল'। জান মোহম্মদদের মায়ের নামে নাম। ও বাড়ির প্রায় অসূর্যম্পশ্যা মেয়েদের নিয়েই আমার যত কল্পনাবিলাস। ওদের নামেই আমার পুতুলদের নাম। রানু প্রাইভেটে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে বাসায় থাকে, কেক পেস্ট্রি বানানো শেখে, এমব্রয়ডারির কাজ হাতে নিয়ে কখনও ছাদে আসে। আর না হলে সেলাই মেশিনে বসে নিজের আর ছোট বোনের সালোয়ার-কামিজ সেলাই করে। লাইজু আমার বড় বোনের সঙ্গে ক্লাস এইটে গার্লস স্কুলে পড়ে। স্কুলে খুব একটা যায়টায় না। একমাত্র আমার বড়াপাই ওদের বাড়িতে ঢোকার অনুমতি পায়। ওদের গৃহপরিচারিকা রোমেছা এসে মাঝেমধ্যেই দুপুরে বড়াপাকে ডেকে নিয়ে যেত। ওর ফিরতে ফিরতে বিকেল। আসার পর আমি রাজ্যের কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞাসা করি_
'ওরা কী খায়রে বড়াপা? পোলাও, কোপ্তা, কাবাব, বিরিয়ানি?'
'খায়ই তো'।
'তোকে ডাকলেই তুই যাস কেন? ওরা কি আমাদের বাসায় আসে?'
'ডাকে কি খামোখা? লাইজুকে পড়া দেখিয়ে দিতে হয় না? আর যাব না ভাবছি। লাইজুর প্রাইভেট টিচার আসবে সামনের সপ্তাহ থেকে'।
লাইজু দেখতে সাদামাটা। তবে একবার ঢাকা থেকে ওদের বড় বোনের মেয়ে ডলি আর বুলু এসেছিল। ওরা বাগানে খেলছিল। বয়সে আমার চেয়ে একটু বড়ই। ওদের দেখে মনে হচ্ছিল, ওরা যেন জুলেখা, বাদশাহর মেয়ে। ভারি অহঙ্কার! সুন্দরী যাকে বলে সে রানুপা। দু'একবার দু'এক ঝলক দেখেছি। আমার পুতুলদের জন্য ওদের দালানের উঁচু জানালার নিচে টুকরো ছিটকাপড় কুড়াতে যেতাম। রানুপার সালোয়ার-কামিজের কাপড়। খুব ইচ্ছে হতো জানালায় উঁকি দিয়ে দেখতে। একদিন কাপড় কুড়িয়ে ফিরছি। রানুপা জানালায় এসে বসল। মনে হচ্ছিল তুষারকন্যা। গুনগুন করে গান গাচ্ছিল 'একটা গান লিখো আমার জন্য ...'। আমি হাঁ করে তাকিয়ে আছি, এমন সময় ভেতর থেকে ভারি গলায় 'রানুউউউ' ডাক শুনেই জানালা বন্ধ হয়ে গেল। রানুর মা নাকি ইয়া মোটা, অনেক বয়স, সবসময় ধবধবে সাদা শাড়ি পরে নামাজ পড়ে। সে সময় রোমেছাকে হাতপাখা দিয়ে অবিরাম বাতাস করতে হয়। বড়াপা ওদের বাড়ি থেকে এলেই খুব জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হতো আচ্ছা, রানুপা কি সোনার পালঙ্কে শুয়ে চুল শুকায়? ওদের কি সুখপাখি আছে? বড়াপা বলত_
'রানুপা ভালো তবে খুব অহঙ্কারী। লাইজুকে সারাক্ষণ বকে। লাইজু বলে, দাঁড়া না ক'দিন বাদে যখন বিয়ে হয়ে যাবে ওর, তখন আমিই এ বাড়ির সব। আমার হুকুমে সবাই চলবে।'
সে সময় আমাদের মফস্বল শহরে কারও ব্যক্তিগত গাড়ি ছিল না। রানুর বড় ভাই জান মোহম্মদ জেলা শহর থেকে সপ্তাহে একদিন মা-বোনদের দেখতে আসত গাড়ি করে। জান মোহম্মদের গাড়ি আমাদের শহরে ঢুকলেই সবাই কেমন সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ত। তখন দেশে যুদ্ধের ডামাডোল। রানুদের বাড়ি থেকে খানিক দূরে পাকিস্তানি মিলিটারিদের ক্যাম্প। জান মোহম্মদের গাড়ি অনেকেই ওদিকে যেতে দেখত। আমার বাবা বড়াপাকে আর রানুপাদের বাসায় যেতে দিত না। আমি জিজ্ঞেস করি_
'কেন রে বড়াপা?'
'ওরা মুসলিম লীগার যে'_ বড়াপার শঙ্কিত উত্তর। মুসলিম লীগার কেন খারাপ তা আমাকে কেউ বুঝিয়ে বলেনি। কিন্তু আমি আমার পুতুলদের পুরনো নামেই ডাকতাম। রানুপার আর একটা ভাই ঢাকায় পড়ত, নাম আদিল। সে এলেই বাড়ির সামনের মাঠে ফ্লাড লাইট জ্বালিয়ে ব্যাডমিন্টন খেলত। শ্যামলা, লম্বা, ফ্যাশনদুরস্ত আদিলকে দেখতে পাড়ার মেয়েরা অকারণে প্রধান সড়ক বাদ দিয়ে জাহান মঞ্জিলের পাশের সরু গলি দিয়ে থেমে থেমে হাঁটত। বড়াপাকেও লুকিয়ে দেখতে দেখেছি। একদিন আদিল শূন্যে উঁচু হয়ে কর্কে বাড়ি দিতে গিয়ে ধপাস করে মাটিতে পড়ে গিয়েছিল। আমি খিলখিল করে হেসে উঠতে আদিল এমন কটমটিয়ে আমার দিকে তাকিয়েছিল যে আমি সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির ভেতর দে দৌড়। এই আদিল আমার একমাত্র পুরুষ পুতুল। তাও নেপথ্যের।
একদিন সকালের দিকে রোমেছাকে নিয়ে লাইজু হাজির। আমি খুব কাছ থেকে রূপকথার রাজবাড়ির মেয়েকে দেখলাম। লাইজুকে আমাদেরই মতো মনে হচ্ছিল। মা ওদের ঝাল-পেঁয়াজ দিয়ে মুড়ি মাখিয়ে দিল, শেষ দানাটিও সে খুঁটে খেল। লাইজুকে বেশ উদ্বিগ্ন মনে হচ্ছিল। ও আস্তে আস্তে ওর প্রাইভেট টিচার সম্পর্কে যা বলছিল তা এরকম_
'মুকুল স্যার যে গেরিলা তা যদি মিয়াভাই জানতে পারে তাহলে...'
'জানবে কী করে? গেরিলারা গোপনে কাজ করে।'
'কিন্তু মুকুল স্যার তো মনে হচ্ছে রানুপার প্রেমে পাগল।'
'আর রানুপা?'
'জানি না, সামনের মাসে পাকিস্তানি এক ক্যাপ্টেনের সঙ্গে ওর এনগেজমেন্ট। খুব রূপচর্চা চলছে।'
'মুকুল স্যার জানে?'
'জানলেই কী? পোস্টাপিসের কেরানির ছেলে যতই ইন্টারে স্ট্যান্ড করুক, তার ওপরে গেরিলা। মিয়াভাই জানলে...'
রোমেছা তাড়া দিচ্ছিল। বাইরের রাস্তায় মুক্তি ছেলেরা গাছ কেটে ফেলে রেখে গেছে। রোমেছা নাকি মুকুল স্যারকে দেখেছে ছেলেদের সঙ্গে ওখানে। লাইজু রোমেছাকে এসব কথা বাড়িতে বলতে নিষেধ করে দ্রুত পেছনের ধানকলের দেয়াল ঘেঁষে ওদের খিড়কির দরজা দিয়ে ঢুকে গেল।
এর পনের দিন বাদে জাহান মঞ্জিলের সামনে বেশ কিছু আর্মির গাড়ি। জমকালো শেরওয়ানি আর জিন্নাহ টুপি পরে উকিল জান মোহম্মদ হাত বাড়িয়ে বিনয়ের সঙ্গে গাড়ি থেকে নেমে আসা আর্মি অফিসারদের হাত ধরে বাড়ির মধ্যে নিয়ে যাচ্ছে। আদিলকেও ভাইয়ের মতো আচরণই অনুসরণ করতে হচ্ছে। রান্নার সুগন্ধে বাতাসে বারুদের গন্ধও ম্লান। রানুপার এনগেজমেন্ট। নিজস্ব আত্মীয় ছাড়া বাইরের কেউ আমন্ত্রিত নয়। লাইজু বড়াপাকেও ডাকতে পারেনি। কড়া নিরাপত্তার মধ্যে ক্যাপ্টেনের সঙ্গে রানুপার এনগেজমেন্ট শেষ হলো। শোনা গেল, ওই ক্যাপ্টেন নাকি জেনারেল টিক্কা খাঁর বোনের ছেলে। যুদ্ধে বাঙালিদের পর্যুদস্ত করে পাকিস্তান সমুন্নত রাখার পর বিয়ে। বিয়ের পর রানুকে নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যাবে ক্যাপ্টেন।
সেপ্টেম্বর ১৯৭১। আমাদের ধূলিধূসর পেছনের বারান্দা। আমার পুতুলদের ঘর অগোছালো। রানুপার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, তাও আবার আমাদের দেশের শত্রু পাকিস্তানি ক্যাপ্টেনের সঙ্গে। একবার মনে হলো পুতুলের নামটা পাল্টে দিই। রানুপা চলে যাবে পশ্চিম পাকিস্তানে। উর্দু ভাষায় কথা বলবে। বাঙালিদের বলবে নেমকহারামের জাত। কিন্তু রানুপা যে আমার রূপকথার রাজকন্যে। রানুপুতুল বলে_
'রোমেছা, মেন্দি বাট। হাতে লাগাব। জানিস না আমার বিয়ে'
'মেন্দিগাছ উপড়ে ফেলেছে মুক্তিরা, আপামনি'_ রোমেছা পুতুল মিনমিন করে জবাব দেয়।
'কোন মুক্তি?'
'মুকুল মুক্তি'
'মুকুল কাঁহা, মুকুলকো মার ডালো'।
খুব ভোরে বাইরে বাতাসের তাণ্ডব। জাহান মঞ্জিলের সামনে লোকে লোকারণ্য। রানুপার জানাজা। রাত ১২টা ২০ মিনিটে জান মোহম্মদ তার পিস্তল হাতে অন্ধকার সিঁড়িঘরের দিকে যেতে যেতে নাকি বলে, 'মুকুল কাঁহা, মুকুলকো মার ডালো'। আদিল টর্চের আলো ফেলে। দেখে দু'হাত প্রসারিত করে আজানুলম্বিত চুল ছড়িয়ে দিয়ে রানু দেবীর মতো দাঁড়িয়ে আছে মুকুলকে আড়াল করে। জান মোহম্মদ গুলি চালায়। রানু তার বিছানো চুলের ওপর ঢলে পড়ে। মুকুলকে পাকিস্তানি আর্মিদের ক্যাম্পে দিয়ে আসা হয়।
ওইদিনই তাড়াহুড়ো করে বাবা আমাদের নিয়ে গ্রামে রওনা দেয়। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে নেওয়ার সময় মা-বাবা নিচু স্বরে রানুপা আর মুকুল স্যারকে নিয়ে যা বলছিল আমি তার সবটুকুই বুঝতে পেরেছিলাম। যাওয়ার আগে আমি এক দৌড়ে পেছনের বারান্দায় গিয়ে আমার কাগজের পুতুলের সংসার ফ্রকের কোচড়ে ওঠাতে থাকি। তক্ষুনি এক দমকা বাতাসের ধাক্কায় ফ্রক থেকে আমার কাগজের পলকা পুতুল আর আসবাব অনেক দূরে ইতস্তত উড়ে যায়। আমার ছোট্ট ফ্রক পতপত করে আমার নাকে এসে বাড়ি খায়। আমি দু'হাত দিয়ে জোর করে ফ্রক নামিয়ে আমার উন্মুক্ত উরু ঢাকতে থাকি।

No comments

Powered by Blogger.