লাস্ট এপিসোড by ড. মাহফুজ পারভেজ

টিভি নাটকের শেষ পর্ব বা এপিসোডে পরিচালক যেভাবে চরম রোমাঞ্চ, রহস্য ও চমক লুকিয়ে রাখেন, তেমনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক রণাঙ্গনে চলছে প্রবল উত্তেজনাকর শেষ এপিসোড।
সরকারি ও বিরোধী দল সর্বশক্তিতে মাঠে হাজির। নির্বাক দর্শকরূপে চেয়ে চেয়ে দেখছে অবরুদ্ধ জনসাধারণ। অবরুদ্ধ বিরোধী দলের নেতাও। তাকে হয়তো আটকও করা হতে পারে। তিনি বলেছেন, ‘সরকার মানুষের রক্তের উপর দিয়ে ক্ষমতায় যেতে চাইছে।’ বিদেশী  মিডিয়ায় বাংলাদেশকে ‘গৃহযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে’ বা ‘কারাগার-সদৃশ’ বলে যে মন্তব্য করা হয়েছিল, তা এখন শত ভাগ বাস্তব। বাংলাদেশের একজন মানুষও এ পরিস্থিতিতে মুক্ত আছেন কিনা সন্দেহ। কারও চলাচল, যাতায়াত ও গতিবিধির স্বাধীনতা নেই। নাগরিক সমাজ ও শহর-নগরের উপর চলছে প্রথমত বিরোধী দলের অবরোধ আর এখন সরকার আরোপিত অবরোধ। এমন বিভীষিকার মধ্যে সরকার ৫ই জানুয়ারি ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন করবেই। অন্যদিকে বিরোধী দল নির্বাচন মানবেই না। ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ করতে না দেয়ায় বিরোধীদের আন্দোলন আবার লাগাতারভাবে অবরোধ-হরতালরূপে গ্রামে-গঞ্জে-দেশব্যাপী ছড়িয়ে গেছে। আন্দোলনের মাঠে বাড়ছে আহত-নিহত-আটকের সংখ্যা। পুলিশের সঙ্গে সরকারি লোকজনের সশস্ত্র সংযুক্তিতে পরিস্থিতি আরও সংঘাত-সন্ত্রাসময়। ব্যক্তিগত ও দলীয় স্তর ছেড়ে আক্রমণ সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ আর প্রেস ক্লাবের ভিতরেও পৌঁছে গেছে। নৈরাজ্যের তীব্রতম মাত্রার মধ্যে গণতন্ত্রের নয়, চলছে শক্তির মহড়া। কে বেশি শক্তি দেখাচ্ছে? সরকার নাকি বিরোধী দল? তারচেয়ে জরুরি প্রশ্ন হলো, কে জিতবে শক্তির এই লড়াইয়ে? নাকি আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক কর্তৃক উচ্চারিত ‘দেশ হারবে দল জিতবে’ বক্তব্যই সঠিক বলে প্রমাণিত হবে? রাজনীতির মাঠে বা নির্বাচনে জয়ের আগেই দেখা যাচ্ছে হাজারো প্রশ্ন আর সন্দেহ। যে ১০ম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগেই এত আপত্তি, যেখানে দেশের অর্ধেকের বেশি মানুষ ভোটই দেয়নি, তেমন নির্বাচন হয়ে গেলেও তা কতক্ষণ টিকতে পারবে, বলা শক্ত। সামনের দিনগুলোতে ‘কি হবে’, ‘কি হতে পারে’ এমন বহু প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে বাংলাদেশের চলমান রাজনীতির শেষ এপিসোডে। আসলেই শেষ এপিসোডে রাজনৈতিক লড়াইটি শক্তি ও ক্ষমতার তীব্র, ভয়াবহ ও সর্বাত্মক লড়াই হয়ে উঠেছে। কে জিতবে জানা না গেলেও, যে জিতবে তাকে ভয়াবহ মূল্য দিতে হবে, সেটা স্পষ্ট। কিন্তু রাজনৈতিক বিজয়ের জন্য আর্থ-সামাজিক-জৈবিক কতটুকু মূল্য দেয়া সঙ্গত? যদি বিজয়ের মধ্যে নিহিত অর্জনের চেয়ে বিসর্জনের মূল্যই বেশি হয়ে যায়, তাহলে সে বিজয়ের মানে তো চরম পরাজয়। যে বিজয়ে জনগণের মুখে শঙ্কার কালো মেঘ, যে বিজয়ে গণতন্ত্রের শরীরে রক্তের দাগ, যে বিজয়ে গোপন ষড়যন্ত্রের ক্রূর অট্টহাসি, যে বিজয়ে কিলবিল করছে শাঠ্য-ষড়যন্ত্রের শ্বাপদ ছায়া, যে বিজয়ে নৃত্যরত খলতার অশুভ প্রেতাত্মা, সে বিজয় কি আসলেই বিজয়? এমন বিজয় তুচ্ছ। কলঙ্কময়। নিন্দায় আকীর্ণ। সারা জীবনের বোঝা। এত শ্রম, সংগ্রাম, ক্ষমতা আর শক্তি প্রয়োগ করে যদি এমনই বিজয় অর্জিত হয়, যা অগ্রহণযোগ্য, বৈধতাহীন, আপাদমস্তক প্রশ্নবিদ্ধ ও কালিমালিপ্ত, সে বিজয় কি এতই দরকারি? নির্বাচন বন্ধ করে যদি শান্তি ও সম্মান প্রতিষ্ঠা করা যায় এবং আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সবাইকে নিয়ে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা যায়, তাহলে কি ক্ষতি? কিছুদিন পিছিয়ে সকলের সম্মতিতে নির্বাচন করার জন্য নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে প্রস্তাব দেয়া হলে সেটা যদি তৃতীয় শক্তিকে আনার যড়ষন্ত্ররূপে গণ্য করা হয়, তাহলে জনপ্রত্যাখ্যাত, একদলীয়, অস্বচ্ছ, রক্ত-পিচ্ছিল ও সংখ্যালঘুদের শাসন নিশ্চিতকারী ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন কি নামে পরিচিত হবে? রাজনৈতিক পরিস্থিতির শেষ দেখতে অপেক্ষা করতে হবে বটে। কিন্তু এহেন নির্বাচনের উদ্দেশ্য ও চরিত্র জানতে কাউকেই অপেক্ষা করতে হচ্ছে না। সবাই এই নির্বাচনকে চিনে ফেলেছে। তবে সেটা নির্বাচন নামে নয়, অন্য নামে। যে নির্বাচনকে মানুষ নির্বাচন নয়, অন্য নামে চিনে, সে নির্বাচন নিয়ে আর যা-ই হোক, সত্যিকারের বিজয়ী হওয়া কখনও সম্ভব নয়।

No comments

Powered by Blogger.