আশাবাদী হওয়া ছাড়া বিকল্প নেই

একগুঁয়েমি আর নিষ্ঠুরতার মিশেল দেওয়া অপরাজনীতির ঘটনা-দুর্ঘটনায় ভরা ২০১৩ সাল শেষ হলো। সম্পন্ন নাগরিক জীবনে বছর, দশক আর শতাব্দীর মূল্য যতই হোক না কেন, আমজনতার কাছে প্রতিটি দিনই নতুন। এ দেশের এক-চতুর্থাংশ মানুষ হতদরিদ্র। প্রতিদিন রাতে তারা ঘুমাতে যায় এই চিন্তা করে, আগামীকাল তার রুটি-রুজির ব্যবস্থা হবে কি না, শ্রম বিক্রি করতে পারবে কি না। সাম্প্রতিক দিনগুলোর সহিংসতা দেশের অর্থনীতির বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। হতদরিদ্রের সংখ্যাটা ৫ থেকে ১০ শতাংশ বেড়ে গেলে কেউ অবাক হবেন না। দেশের অবস্থা যখন এমন, তখন নতুন বছর ২০১৪ সালের আবির্ভাব। যেখানে তারুণ্যের আনন্দে উদ্দীপ্ত হওয়ার কথা, সেখানে মানুষ অশ্বস্তি আর আশঙ্কায় ম্রিয়মাণ। একটাই প্রশ্ন, নতুন বছরটি কেমন যাবে? আমাদের সামনে এখন অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ। যুযুধান দুই রাজনৈতিক গোষ্ঠীর ক্ষমতার দ্বন্দ্ব কি আরও বাড়বে, নাকি তারা একটি সহাবস্থানের পথে যাবে? অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির চাকা, যা গত এক দশকে মোটামুটি সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল, তা কি সচল থাকবে? প্রতিবছর যে লাখ লাখ তরুণ শ্রমবাজারে ঢুকছেন, তাঁদের কি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে? প্রশ্নগুলোর উত্তর যদি ‘হ্যাঁ’ হয়, তাহলে সবাই খুশি হবেন। কিন্তু জোর গলায় সেটা বলা যাচ্ছে না। দেশটা দুই ভাগ হয়ে গেছে। একদল ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ নিয়ে দৌড়ঝাঁপ দিচ্ছে, অন্য দল দেশটা ‘হিন্দুস্থানের’ দখলে চলে যাচ্ছে বলে ‘সার্বভৌমত্ব রক্ষার’ ডাক দিচ্ছে। একদল মনে করে, ‘জামায়াত’ হলো দেশের একমাত্র সমস্যা। অন্য দলটি ‘লেন্দুপ দর্জির’ ব্যাপারে খুবই উৎকণ্ঠিত।
এক দল বলছে তোমরা ভারতের দালাল, অন্য দলটি বলছে তোমরা পাকিস্তানের দালাল। এই বস্তাপচা সেন্টিমেন্টাল অপরাজনীতিতে দেশটা আচ্ছন্ন হয়ে গেছে। এ থেকে শিগগিরই পরিত্রাণ পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। মার্ক্সীয় রাজনীতির ওপর ভরসা করে হয়তো বলা যেত, এরা একই শ্রেণীর দুটো গোষ্ঠী, একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। এরা খেয়োখেয়ি করে নিজেদের শক্তি ক্ষয় করতে করতে একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে। তখন হয়তো আমজনতা স্বস্তি ফিরে পাবে। কিন্তু বিষয়টা এত সরল নয়। এ দেশে এক-এগারো নিয়ে অনেক বিতর্ক হয়েছে। ২০০৭-০৮ সালে আমরা অনেক বাঘা বাঘা রাজনীতিক, ব্যবসায়ী ও আমলাকে ফুটো বেলুনের মতো চুপসে যেতে দেখেছি। কিন্তু এটা যে সমাধান নয়, তা বুঝতে ছয় মাসের বেশি লাগেনি। রাজনীতির ভেতর থেকেই নবশক্তির উত্থান হতে হবে। সেটা হয়নি। আমরা বড় দুই গোষ্ঠীর বিপরীতে দলছুট, ক্ষুব্ধ, বঞ্চিত ও সুযোগসন্ধানীদের লম্ফঝম্ফ দেখেছি কয়েক দিন। জনগণ তাদের পেছনে দাঁড়াননি। বাধ্য হয়েই এক-এগারোর কুশীলবদের পিছু হটতে হয়েছে। দেশটা তাঁদের হাতেই ফিরিয়ে দিতে হয়েছে, যাঁদের সাংবিধানিক বৈধতা ছিল, যদিও নৈতিক মানদণ্ডে তাঁরা ছিলেন অচল। এটা আজ দিবালোকের মতো স্পষ্ট, তাঁরা এক-এগারো থেকে কোনো শিক্ষাই নেননি। এ দেশে কোনো ‘তৃতীয় শক্তি’ নয়, প্রয়োজন বিকল্প রাজনৈতিক শক্তির। এবং সেটা আসবে মূলধারার রাজনীতি থেকেই। সে জন্য সময় লাগবে। যাঁরা রাজনীতি করেন না, তাঁদেরও রাজনীতিকদের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করতে হবে। নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা এই অনুঘটকের ভূমিকা ঠিকমতো পালন করতে পারছেন না। কারণ, তাঁরা নিজেরাই রাজনৈতিক বিভাজনের শিকার অথবা কোনো তৃতীয় শক্তির অপেক্ষায় আছেন। ‘রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা’ একটা আপেক্ষিক বিষয়।
অনেকেই মনে করেন, ঘন ঘন সরকার বদল হলে স্থিতিশীলতা নষ্ট হয়ে যাবে। এটা ঠিক নয়। তবে আমাদের দেশে আশঙ্কার ব্যাপার হলো, সরকার বদল হলে রাষ্ট্রীয় রীতিনীতি আমূল পাল্টে যায়। এখানে রাষ্ট্র আর সরকার একাকার। আমাদের মনোজগতে রাষ্ট্রকে সরকার থেকে আলাদা করতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, অর্থনীতিকে রাজনীতি থেকে আলাদা করে দেখতে শেখা। জাপান ও ইতালি বিশ্বের প্রধান আটটি অর্থনৈতিক পরাশক্তির দেশের অন্যতম। ওই দুটো দেশে অনেক ঘন ঘন সরকার বদল হয়। তাতে অর্থনীতির কোনো ক্ষতি হয় না। আমাদের দেশে বিষয়টা পুরোপুরি উল্টো। এ দেশে প্রতিপক্ষের ওপর রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগের প্রধান মাধ্যম হয়ে উঠেছে জনগণকে জিম্মি করার মধ্য দিয়ে। ভাবখানা এই, দায়দায়িত্ব তো সরকারের। এখানে রাজনৈতিক দলগুলো যুদ্ধ করে জনগণের বিরুদ্ধে। এ দেশে রাজনৈতিক ‘আন্দোলনের’ নামে যা কিছু হয়, তাতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রাণ যায় সাধারণ মানুষের, আন্দোলনের সঙ্গে যাদের কোনো সংস্রব নেই, কিংবা থাকলেও খুবই সামান্য। শুনতে হয়তো ভালো লাগবে না, কিন্তু এটাই সত্য যে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে আজ অবধি বিভিন্ন ‘আন্দোলনে’ কোনো ‘নেতা’র প্রাণ গেছে বলে শুনিনি। জনগণকে কাঁচামালের মতো ব্যবহার করে যাঁরা রাজনীতির পুঁজি সঞ্চয় করেন, তাঁদের মুখোশটা ক্রমেই উন্মোচিত হচ্ছে। আমি সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি। যদি কোনো বড় নেতা, ব্যবসায়ী কিংবা আমলা গ্রেপ্তার কিংবা নাজেহাল হন, সাধারণ মানুষ খুশি হয়। কারণ, মানুষ ক্ষমতার দম্ভ পছন্দ করে না। এক-এগারোর সময় আমরা এটাই দেখেছি। অর্থনীতির চাকা সচল না থাকলে সবকিছুই ভেঙে পড়বে। তখন কোনো সরকারই তা সামাল দিতে পারবে না।
মানুষ তার প্রয়োজনেই জীবিকার অন্বেষণ করে। আর সে কারণেই আমরা দেখি, শত হরতাল-অবরোধের মধ্যেও দেড় কোটি মানুষের ঢাকা শহরে পণ্য সরবরাহব্যবস্থা চালু আছে। কেউ না খেয়ে মারা যাচ্ছে না। মানুষ তার প্রয়োজনেই বিকল্প পথ খুঁজে নেয়। জীবনসংগ্রামের এই নিভৃত দিকটি আমরা খুঁজে দেখি না। নতুন বছরের জন্য অন্যতম নাগরিক ভাবনা হবে একটা সহজবোধ্য সংবিধান। বর্তমান সংবিধান অচল। সংবিধান এমন কোনো পূতপবিত্র দলিল নয় যে তা বদলানো যাবে না। সংবিধানের চেয়ে হাজার গুণ পবিত্র হচ্ছে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অ-আ-ক-খ শেখার বই। জাতীয় সংসদ কিংবা সুপ্রিম কোর্টের চেয়ে কম পবিত্র নয় একটি স্কুল কিংবা হাসপাতাল। মানুষের জন্যই সংবিধান, আদালত, সরকার ও রাষ্ট্র। আমাদের এমন একটা সংবিধান দরকার, যা হবে সত্যিকারের নাগরিক সনদ, যা নাগরিকদের সুরক্ষা দেবে। রাষ্ট্র সেবা দেবে, ছড়ি ঘোরাবে না। এমন একটা সংবিধান, যা বছর বছর বদলাতে হবে না। এমন একটা সংবিধান, যেখানে নাগরিকেরাই হবেন সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। কেউ যাতে স্পর্ধার সঙ্গে বলতে না পারেন যে জাতীয় সংসদ কিংবা সুপ্রিম কোর্ট সার্বভৌম। ২০১৪ সালব্যাপী এমন নাগরিক সংলাপ চলুক, যেখানে আমরা একটা টেকসই এবং সমৃদ্ধ অর্থনীতি ও সমতাভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলার ব্যাপারে মতৈক্য গড়ে তুলতে পারি। প্রয়োজনীয় সংস্কারগুলো চিহ্নিত করতে পারি। গণতন্ত্রের অন্বেষণ যেন নিছক ভোটকেন্দ্রিক না হয়। ফাঁকে টপকে গদিতে বসবে, তার জন্য ১৬ কোটি মানুষ কেন মাথা ঘামাবে? ২০১৪ সালে আমরা আশায় বুক বাঁধব। চারদিকে অন্তহীন নৈরাজ্য। এর মধ্যে আশাবাদী হওয়াও অনেক সাহসের ব্যাপার। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা এবং কিশোর কুমারের কণ্ঠে গীত অমানুষ ছবির সেই বিখ্যাত গানের একটি কলি এখানে উদ্ধৃত করা যেতে পারে, ‘কী আশায় বাঁধি খেলাঘর’। তার পরও বলব, আমাদের আশাবাদী হওয়া ছাড়া বিকল্প নেই।
 মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক।
mohi2005@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.