নারী রিপোর্টার নও, তুমি রিপোর্টার! by সাজেদা সুইটি

সারাদিন দৌড়ঝাঁপ শেষে বিকেলে অফিসে ঢুকছি, এডিটর ইন চিফ আলমগীর হোসেনের এসএমএস, ‘পাঁচদিনের সফরে দিনাজপুর যেতে তৈরি থাকো।’
কিছুক্ষণ বুঝিইনি ঘটনা, বলে কী! দিনাজপুর! মানে কী?
পরিবারের সদস্য বা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুরা মিলে সদলবলে বেড়াতে গিয়েছি দূরদূরান্তে। কিন্তু অফিসের দায়িত্ব মাথায় একদম নতুন জায়গায়, তাও আবার ঢাকা থেকে এতো দূরে!
কিন্তু কীইবা করার আছে! চোখ গোল করে, চাপা শক্ত করে জবাব দিলাম, ‘ঠিক আছে।’

নফল নামাজ পড়া শুরু হয়ে গেল, বিপদ থেকে পরিত্রাণের জন্য মা-বাবার দোয়াও চাইলাম।

ঘনিয়ে এলো দিনক্ষণ। এডিটর ইন চিফ মিটিং ডাকলেন। এক সিনিয়র কলিগ আশঙ্কার সুরে বললেন, ‘নারী রিপোর্টার, অচেনা জায়গায় কোথায় কোন প্রব্লেমে পড়ে…!’

তার কথা শেষ করতে না দিয়েই এডিটর ইন চিফ আমার চোখে তাকিয়ে বললেন, ‘‘মনে রাখবা, নারী রিপোর্টার নও, তুমি রিপোর্টার!’

মাথাটা ডানে সামান্য কাৎ করে সায় দিলাম। তার কাছে আইডিয়া চাইলাম।

জবাবে বললেন, “একদম নির্ভার থাকো। যা কিছু ইন্টারেস্টিং মনে হয়, তাই লিখে পাঠাও। যা নিউজ মনে হবে, তাই পাঠাবা। আমি জানি, তুমি পারবা!”

এই ভয়টাই পাচ্ছিলাম, যে বিশ্বাসে ‘পারবা’ বললেন তিনি, তা যে কতো বড় চাপ, তা এই ভদ্রলোককে কী করে বোঝাই!

যাত্রা শুরু, কাজ শুরু, মিশে গেলাম কাজের সঙ্গে। এ যেন একটা নেশা! খেয়ে-না খেয়ে নিউজ, ইন্টারভিউ, নতুন প্ল্যান, নতুন অ্যাঙ্গেল…।

বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার জনসভা, পুলিশি হেফাজতে ধর্ষিতা ও নিহত ইয়াসমিনের মায়ের খোঁজখবর, হিজড়াদের জীবনযাত্রার সরেজমিন প্রতিবেদন নিয়ে ফিরলাম ঢাকায়।

দিনাজপুরের কড়া রোদে পুড়ে মুখপোড়া হনুমানের মতো চেহারা নিয়ে অফিসে ঢুকলাম।

এডিটর ইন চিফের মুখোমুখি হতেই অট্টহাসি হাসি দিয়ে সবাইকে ডাকাডাকি শুরু করলেন তিনি, “এ্যাই, তোমরা কে দেখবা আসো, আমার রিপোর্টারের চেহারা দেখে যাও, সিঙ্গাড়া ভাজতে ভাজতে তেলটা যেমন কালো হয়ে যায়, তেমন চেহারা হয়েছে সুইটির!”

সেই থেকে শুরু, একের পর ট্যুর নিয়ে দেশের নানা প্রান্তে ছুটে বেড়াচ্ছি, কখনো কোনো ভয় কাজ করে না। প্রতিমুহূর্তে অফিসের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহায়তায় হাড়ভাঙা খাটুনি করি অপূর্ব এক তৃপ্তি নিয়ে।

এডিটর ইন চিফ থেকে শুরু করে অন্য সহকর্মীরা, একে একে সবাই খোঁজ খবর নেন, সমস্যা হলেই জানাতে বলেন। অসাধারণ এক অনুভূতি! একা হয়েও যেন কখনো একা নই!

এটাই বাংলানিউজের কর্মপরিবেশ। প্রতিটি নারী সদস্য এখানে সম-মর্যাদা, সম্মান ও নিরাপত্তা পান। এই পরিবেশের কল্যাণে খাটুনির আগ্রহও বাড়ে।

জীবনে যোগ হতে থাকে একে একে নানান সাফল্য।

বছরের প্রথম দিন ছাত্রদলের অনুষ্ঠানে খালেদা জিয়ার বক্তব্য গুছিয়ে নিউজ করছি, হঠাৎ দেখি বাংলানিউজের একটি নিউজে আমার ছবি! ‘বর্ষসেরা রিপোর্টার’ খেতাব দেওয়া হয়েছে এই ক্ষুদে সাধারণ সংবাদ কর্মীকে!

এতোবড় প্রতিষ্ঠানে ‘বর্ষসেরা রিপোর্টার’ পুরস্কার! যে আজব অনুভূতি সে মুহূর্তে হয়েছিল, তা নাতিপুতিদের কাছে গল্প না করে মরতে চাই না।

এভাবেই এখানে কাজের মূল্যায়ন হয়। যতোটা সম্ভব বৈষম্য পরিহার করা হয়।

ফিল্ডে কাজ করতে গিয়ে অন্য হাউজের নারী কলিগদের কারো কারো কষ্টের কথা শুনি। কর্মক্ষেত্রে তারা কীভাবে হয়রানির শিকার হন, শুনলে অবাক হতে হয়।

সেসব শুনে নিজেকে অনেক ভাগ্যবান মনে করি। কারণ বাংলানিউজে কোনো কলিগের কাছ থেকে এমন আচরণ বা চালাকির শিকার হতে হয় না নারীদের।

এক কলিগকে শেয়ার করলাম বিষয়টি, হেসে কুটি কুটি হয়ে সে বললো, “কাজ কইরা কুল পায় না এই হাউজের লোকজন, ওসব করার টাইম কই!”

এডিটর ইন চিফ মাঝে মাঝে সব নারী কর্মীকে নিয়ে সভাও করেন। তাদের সমস্যা, প্রতিকূলতা নিঃসঙ্কোচে জানাতে বলেন। যেকোনো সমস্যার তাৎক্ষণিক সমাধান দেওয়ার চেষ্টা করেন। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজের অধিকার আদায়ের কৌশল আয়ত্ত করতে বলেন।

নাইট ডিউটি নিয়ে নারী সদস্যদের মনে একটি শঙ্কা কাজ করতো। কিন্তু কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তায় সেটা এখন রাত জেগে কাজ করা ছাড়া কিছুই নয়।

বাংলানিউজের কর্মীরা প্রত্যেকেই পরিশ্রমী, এখানে দারুণ প্রতিযোগিতায় তারা কাজ করেন। কিন্তু গোমড়া মুখে কেউ বেশিক্ষণ বসে থাকার সুযোগ পান না। ২৪ ঘণ্টা পরিশ্রম করেও সুযোগ পেলেই আড্ডা, একযোগে অট্টহাসি প্রতিষ্ঠানটিকে প্রাণবন্ত করে তোলে।

বাংলানিউজ-কর্মীদের মেধা, চিন্তাশক্তি অবাক করে দেবে যে কাউকেই। এটি শক্তিশালী একটি টিম। এডিটর ইন চিফ থেকে শুরু করে অফিস সহকারী ভাইটি- সবাই এখানে সমান আন্তরিকতা নিয়ে কাজ করেন।

আর এটাই রহস্য, যা মাত্র তিন বছরে বাংলানিউজকে এমন সফল অবস্থানে নিয়েছে।

লেখক:সাজেদা সুইটি, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট ।

No comments

Powered by Blogger.