গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন জাতীয় নেতাদের দৌড়ঝাঁপ by শরিফুল হাসান ও মাসুদ রানা

নারায়ণগঞ্জের মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী গতকাল মঙ্গলবার গাজীপুরে এসে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত মেয়র প্রার্থীর পক্ষে ভোট চেয়েছেন। সাংসদ আসাদুজ্জামান নূরের পর আইভীর প্রচারণা আজমতের ভোটের মাঠে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে জেলার নেতারা মনে করছেন।
বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থীর পক্ষেও দলের কেন্দ্রীয় নেতারা নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছেন। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা ও সাংসদেরা নিজ দলীয় প্রার্থীকে জয়ী করতে দুই সপ্তাহ ধরে টানা প্রচারণা ও গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রার্থী, স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় নেতাদের প্রচারণায় এখন জমজমাট গাজীপুর।
সাধারণ ভোটাররা বলছেন, আইভী বা আসাদুজ্জামান নূরের মতো নেতারা এসে যেমন প্রার্থীর ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করছেন, তেমনি নুরন্নবী চৌধুরীর (শাওন) মতো নেতারা গাজীপুরে আসায় অনেক প্রশ্নও উঠছে। একই কথা বিএনপির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তাঁরা বলছেন, ঢাকা থেকে সব নেতা এসেই যে নিজস্ব ভাবমূর্তি দিয়ে সাধারণ মানুষকে টানতে পারছেন তা নয়, বরং বিতর্কিত অনেকে এসে প্রার্থীদের ভোটও কমাচ্ছেন।
সকালের আলো ফুটলেই মেয়র প্রার্থীরা বেরিয়ে পড়ছেন প্রচারে। চষে বেড়াচ্ছেন গাজীপুরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত। খোঁজখবর নিচ্ছেন বাসিন্দাদের, চাইছেন ভোট, দিচ্ছেন নানা প্রতিশ্রুতি। পাশাপাশি এক পক্ষ তুলে ধরছে সরকারের সাফল্য, আরেক পক্ষ ব্যর্থতার দায় চাপাচ্ছে সরকারের ওপর।
পাল্টাপাল্টি এই প্রচারণার মধ্যেও নতুন সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গাজীপুরবাসীর উৎসাহ-উদ্দীপনা অনেক বেশি। প্রতিদিন বেলা দুইটা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত মাইকের আওয়াজে সরব থাকে পুরো শহর। গানে, কবিতায়, ছন্দে সারা দিন চলে প্রচার। এরপর রাতে কোলাহল কমে। ঘুমাতে যান নগরবাসী। কিন্তু জেগে থাকে আরেক দল। তাঁরা নগরের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে প্রার্থীদের জন্য পোস্টার টাঙান। রিকশা-ভ্যান ও পিকআপ নিয়ে ছোটাছুটি করেন। প্রায় নির্ঘুম রাত কাটে প্রার্থীদেরও। তাঁরা কর্মীদের নিয়ে দফায় দফায় বৈঠক করেন। পরের দিনের প্রচার কৌশল ঠিক করেন। গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মেয়র প্রার্থী সাতজন। তবে প্রচার-গণসংযোগে সর্বোচ্চ গুরুত্ব পাচ্ছেন ১৪ দল-সমর্থিত আজমত উল্লা খান এবং ১৮ দল-সমর্থিত প্রার্থী এম এ মান্নান। আজমত উল্লা দোয়াত-কলম মার্কা নিয়ে লড়ছেন। আর মান্নানের প্রতীক টেলিভিশন। আরেক আলোচিত প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। তার প্রতীক আনারস। তিনি বর্তমানে দোয়াত-কলম মার্কায় ভোট চাইছেন।
গাজীপুরের ভোটারদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে এখানে এসেছেন। এর মধ্যে দুই থেকে আড়াই লাখ পোশাকশ্রমিক, যাঁদের একটি বড় অংশেরই বাড়ি রংপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রামসহ দেশের উত্তরাঞ্চলে। এই ভোটারদের টানতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের উত্তরাঞ্চলের অনেক সাংসদ গাজীপুরে এসেছেন। নীলফামারীর সাংসদ ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আসাদুজ্জামান নূর আসেন সোমবার। তিনি বিভিন্ন পোশাক কারখানায় যান। ‘বাকের ভাই’ খ্যাত এই অভিনেতাকে গাজীপুরে দেখে অনেকেই মুগ্ধ হয়ে যান। অনেককে তাঁর সঙ্গে ছবি তুলতে দেখা যায়। তিনি আজমত উল্লার দোয়াত-কলমে ভোট চান। এ ছাড়া প্রচার শুরুর পর থেকেই আজমত উল্লাকে বিজয়ী করতে গাজীপুর চষে বেড়াচ্ছেন কণ্ঠশিল্পী ও সাংসদ মমতাজ।
এরই মধ্যে গতকাল বিকেলে কোনাবাড়ী, দেউলিয়াবাড়ী, জরুল, কাশিমপুর রেলগেট এলাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় প্রচার চালান নারায়ণগঞ্জের মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী। এ সময় তাঁকে দেখতে অনেক ভোটার ছুটে আসেন। তাঁদেরই একজন মুদি দোকানদার আকমল হোসেন বলেন, ‘আইভী আপাকে দেখতে এসেছি। তাঁর মতো মেয়র এসে যখন আরেকজনের জন্য ভোট চান, তখন তো সেটা বিবেচনায় নিতেই হয়।’
এ ছাড়া আওয়ামী লীগের তোফায়েল আহমেদ, মোহাম্মদ নাসিম, সাত সাংগঠনিক সম্পাদকসহ বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের নেতারা নিয়মিত আসছেন গাজীপুরে। এর পাশাপাশি ৫৭টি ওয়ার্ডে ৫৭ জন সাংসদ আসছেন প্রতিদিন। গাজীপুরে অনেক শ্রমিক ভোটার। এই ভোটারদের আজমত উল্লার পক্ষে টানতে প্রচার চালাচ্ছেন জাসদ নেত্রী শিরিন আখতারও।
একইভাবে এম এ মান্নানের পক্ষে ভোট টানতে প্রচার চালাচ্ছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান। এর বাইরেও জাতীয় শ্রমিক লীগ ও জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের নেতারা শ্রমিক-অধ্যুষিত এলাকায় গিয়ে ভোট চাইছেন। কয়েক দিন ঘুরে দেখা গেছে, দুই মেয়র প্রার্থীর পক্ষে ঢাকা থেকে আসা কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও প্রচার চালাচ্ছেন। বিএনপির প্রার্থীর জন্য ভোট চাইতে আসছেন খন্দকার মোশাররফ হোসেন, তরিকুল ইসলাম, রফিকুল ইসলাম মিয়া, হান্নান শাহ, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, জয়নাল আবেদীন, শহীদ উদ্দীন চৌধুরী, সৈয়দা আসিফা আশরাফী, রাজশাহীর সাবেক মেয়র মিজানুর রহমানসহ আরও অনেকে।
সাধারণ মানুষের কথা: গাজীপুর শহর থেকে একটু দূরে মেঘডুবি এলাকা। ঢাকা ও বিভিন্ন এলাকা থেকে বড় নেতারা সেখানে গিয়েও নিজ নিজ প্রার্থীর জন্য ভোট চাইছেন। এ সম্পর্কে এখানকার বাসিন্দা শাহজাহান আলী বলেন, ‘প্রতিদিন সাবেক ও বর্তমান সাংসদসহ বাইরের অনেক লোক ভোট চাইতে আসছেন। আমরা তাঁদের দেখছি। তবে ভোট দেব আমাদের ইচ্ছায়।’ শহরের মুক্তমঞ্চের পাশের একজন ব্যবসায়ী আসাদুল ইসলাম বলেন, ‘অনেক বড় বড় নেতা প্রতিদিন ভোট চাইতে আসেন। আমরা তাঁদের কথা শুনি। কিন্তু আমরা ভোট দেব আমাদের ইচ্ছায়।’ শহরের আঞ্জু স্টোর নামের একটি চা ও পানের দোকানদার আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘প্রতিদিন শত শত লোক আমার সঙ্গে কথা বলেন। আমি নিজেও ভোটার। এখন তো কারও কথায় কেউ ভোট দেয় না। আমার নিজের বউ-ছেলেরাই আমার কথায় ভোট দেয় না। আর নেতাদের কথা কে শুনবে।’
গতকাল বিকেলে তাঁদের সঙ্গে কথা বলার সময় মান্নানের পক্ষে ভোট চাইতে আসেন বিএনপির সাংসদ বরকত উল্লা। নেতাদের অনুরোধ ভোটাররা কতটুকু শোনেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতি করি। আমরা জানি কীভাবে মানুষের কাছে ভোট চাইতে হয়। আমরা সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ভোট চাইছি এবং ভোটারদের সাড়া পাচ্ছি।’
ঢাকা থেকে আসা নেতারা শুধু যে গণসংযোগ ও প্রচারণা চালাচ্ছেন তা নয়, তাঁরা পরস্পরের বিরুদ্ধেও নানা কথা বলছেন। হান্নান শাহ প্রায় প্রতিদিনই সংবাদ সমেঞ্চলন করছেন। তাঁর দাবি, এই সরকারের প্রতি মানুষের আস্থা নেই। তাই সাধারণ মানুষ বিএনপির প্রার্থীকেই জয়ী করবে।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগের মোহামঞ্চদ নাসিম সংবাদ সমেঞ্চলন করে বলেছেন, গাজীপুর আওয়ামী লীগের ঘাঁটি। এখানে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরই জয় হবে।
৬ জুলাই অনুষ্ঠেয় গাজীপুর সিটি নির্বাচনে ছয়জন মেয়র প্রার্থী ছাড়াও ৪৫৬ জন কাউন্সিলর পদে লড়ছেন। এ ছাড়া সংরক্ষিত ১৯টি ওয়ার্ডে ১২৮ জন নারী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।

No comments

Powered by Blogger.