নিজেকে ভাঙছিল ঋতু

ঋতুর সঙ্গে কাজ করার এইটা সুবিধে ছিল যে ওকে কোনও রেফারেন্স দিলে ও চট করে সেটা বুঝতে পারত৷ নিজেও প্রচুর রেফারেন্স দিত৷ জানাচ্ছেন
অভীক মুখোপাধ্যায়।খুব ছেলেমানুষি শোনাতে পারে, কিন্ত্ত যদি একটু বেছে নেন, ঋতুপর্ণ ঘোষের যে সব ছবিতে আপনি কাজ করেছিলেন, তার মধ্যে তিনটে সিকোয়েন্স যাতে কাজ করে আপনার ভালো লেগেছে৷

ঋতুপর্ণর সঙ্গে আমি কাজ করছি ‘অসুখ’ ছবি থেকে৷ মাঝে দু’ একটা ছবি করা হয়নি৷ তখন আমার অন্য ছবি নিয়ে একটু ব্যস্ততা ছিল৷ তার পর আবার শুরু হয়েছিল এবং পর পর অনেকগুলো ছবি যেমন ‘চোখের বালি’, ‘রেনকোট’, ‘অন্তরমহল’ করে লাস্টলি আমরা ‘সত্যান্বেষী’ ছবিটা করছিলাম৷ জাস্ট শুটিং শেষ হয়েছে৷ পরবর্তী কিছু কাজ বাকি৷ আসলে এতগুলো ছবি করেছি এবং খুব আলাদা করে তিনটে সিকোয়েন্স বার করাটা রিয়েলি ডিফিকাল্ট৷ একটা জিনিস খুব ইমপর্টেন্ট৷ তা এই যে, যখন একজন ডিরেক্টরের সঙ্গে অনেক দিন কাজ করা হয় তখন কতগুলো আনসেড আন-ডিসকাসড জিনিস তৈরি হয়ে যায়৷ ইনফ্যাক্ট আমার সঙ্গে ঋতুর ছবির লুক কী হবে, কী রকম ভাবে শট হবে, কী ভাবে আলো হবে সেটা নিয়ে বিরাট বিস্তারিত আলোচনা কখনওই হত না৷ বিভিন্ন আড্ডা হত এবং তার থেকে কিছু জিনিস বেরিয়ে আসত৷ আমি খানিকটা বুঝে নিতাম যে এটা এ রকম হতে পারে৷ তার ভিত্তিতেই কাজটা হত৷ একটা ইমপর্টেন্ট সিকোয়েন্স-এর কথা ভাবলে বলা যেতে পারে- ‘চিত্রাঙ্গদা’-তে ঋতু বলেছিল, ‘এই ছবিটা দেখতে একটু অন্য ধরনের হওয়া উচিত৷ মানে আমার ছবির যে আপাত সৌন্দর্য আছে সেটাকে যদি কোথাও ভাঙা যায়৷’ মানে সব কিছুই খুব গ্লসি, খুব সুন্দর সুন্দর জিনিস রয়েছে সেটাকে যদি কোথাও ভেঙে দেওয়া যায়৷ এটা একটা ব্রিফিং ছিল এবং সেখান থেকে আমি কতগুলো জিনিস তৈরি করেছিলাম- ইউসড লট অফ হার্শ লাইট, যেটা অন্যান্য ছবিতে খুব একটা নেই৷ খুব স্ট্রংলি হিউম্যান ফিগারগুলোকে বার করা৷ মোর ইনপর্টেন্ট ইজ দ্য হিউম্যান ক্যারেক্টর দ্যান এনিথিং এলস ইন দ্য সেট৷ অনেক জায়গায় আছে গ্রে ওয়াল, জাস্ট একটা ছবি রয়েছে৷ যেটা ঋতু কোনও দিনই করেননি আর কী৷ আমার মনে হয় ঋতু কোনও দিনও এ রকম ছবিও করেননি, ‘চিত্রাঙ্গদা’র মতন এ রকম সেল্ফ অ্যানালিটিক্যাল ছবি৷ মজা লেগেছিল কাজটা করে৷ ‘চোখের বালি’ ইমপর্টেন্ট কাজ একটা দিক থেকে কারণ ‘চোখের বালি’ প্রোডাকশন ভ্যালু হিসেবে খুব ডিফারেন্ট বাংলা ছবি৷ বাংলা ছবিতে প্রথম এ রকম একটা সেট, এ রকম দেখতে লাগছে, তার একটা এ রকম কোয়ালিটি আছে, সেটা প্রথম হয়েছিল আর কী৷ সেটার জন্য অনেকেই রেসপন্সেবল৷ ওর ভাই ইন্দ্রনীল আর্ট ডিরেক্টর৷ খুব ভালো কাজ করেছিল এবং সেখানে আমরা খুব ক্লাসিকল ভাবে কাজটা করার চেষ্টা করেছি৷ অলমোস্ট লাইক আ রেনেসাঁ পেন্টিংয়ের মতো করে৷ সেই জায়গা থেকে ‘অন্তরমহল’ একেবারে অন্য রকম৷ সেখানে অনেক বেশি ডার্কনেস আছে, ভায়োলেন্স আছে৷ এই ভাবে জিনিসগুলো ডিভার করে যায়, এবং প্রতিটা যে খুব আলোচনা করে করা হয়েছে তা নয়৷ আমি অ্যাকচুয়ালি অন্য ডিরেক্টরের সঙ্গে অনেক বেশি আলোচনা করি ছবির লুক নিয়ে৷ তুলনামূলক ভাবে আমি ঋতুর সঙ্গে কখনওই খুব একটা আলোচনা করিনি৷ বেসিকালি ওই ঠাট্টা ইয়ার্কিই হত৷ ঋতুপর্ণ ওয়ান অফ দ্য লাস্ট ফিউ ডিরেক্টরস যার শিক্ষা-দীক্ষা আছে৷ ছবি করি বলে আমার কোনও ইন্টারটেক্সচুয়ালিটি নেই, জানাশোনা নেই, পড়াশুনো কম, তা তো নয়৷ ঋতুর সঙ্গে কাজ করার এইটা সুবিধে ছিল যে ওকে কোনও রেফারেন্স দিলে ও চট করে সেটা বুঝতে পারত৷ নিজেও প্রচুর রেফারেন্স দিত৷ সেই রেফারেন্সটা হতে পারে লিটারারি রেফারেন্স কারণ নিজে লিটারেচর পড়তে ভালোবাসত৷ আমি আমার মতো করে ইন্টারপ্রেট করতাম৷

আপনি বললেন ডার্কনেস-এর কথা৷ ওঁর সঙ্গে আপনার প্রথম ছবি ‘অসুখ’-এ অন্ধকারের একটা বিরাট ভূমিকা৷

অনমোস্ট লাইক আ জার্নি টুওয়ার্ডস দ্য ইন্টিরিয়র অফ নট আ হাউস, ইন্টিরিয়র অফ আ মাইন্ড, সেল্ফ৷ সেইখানটা অনেক বেশি আনসার্টেন, অজানা, আমরা নিজেরাও জানি না সেই কর্নারগুলো কী৷ খানিকটা সেই জন্য দেখবে চরিত্রগুলোও আলোতে বসে আছে কিন্ত্ত পাশগুলো অন্ধকার হয়ে আছে৷ খানিকটা ‘অসুখ’ ব্যাপারটা কী- ডিজিজ অফ মাইন্ড, সেইটাকে খানিকটা ধরার চেষ্টা করা হয়েছিল৷

উনি অন্ধকারটা কী ভাবে বর্ণনা করতেন? আমার এখানে অন্ধকারটা চাই, এটা কী ভাবে বলতেন?

ঋতু কোনও কিছু এক্সপ্লেন করতে গেলে একজ্যাক্টলি লিটারারি জিনিসটা এ রকম চাই, সেটা হয়তো বলতো না৷ একটা পার্টিকুলার সিন হবে, একটা পারফর্মেন্স হচ্ছে, সেই স্টাইলটা, ও তো নিজে অভিনয় করে দেখাত, ওর ছবিতে যারা কাজ করেছেন, মোটামুটি সবাই ওকেই ফলো করতেন৷ সেটা থেকে খানিকটা আন্দাজ করা যেত যে এই সিকোয়েন্সটার জন্য কী রকম লাইটিং হতে পারে৷ একটা চরিত্র হেঁটে উঠে কোথায় যাচ্ছে, কী করছে, যেহেতু প্রচুর জিনিসপত্র থাকত ঘরে, সেই জিনিসটা নিয়ে কাজ করতে করতে অভিনয় করা, এটা থাকে ওর ছবিতে৷ কেউ জাস্ট বসে কথা বলে যায় না৷ ইন্টারেক্টিং উইথ দ্য প্রপস অ্যান এনভায়ারমেন্ট-টা ছিল৷ সেটা থেকেই লাইটটা তৈরি করা হত৷ তা হলে কি লাইটটা এই জোনের বাইরে যাবে? কতটা এক্সটেন্ড করবে বা না করলে কতটা করবে না! সেটা করা হত৷

এই যেটা আপনি বললেন সেটটা ভরা থাকত খুব৷ কেন থাকত?

সেটার একটা কারণ আমার মনে হয় ছিল যে পার্সোনালি ওর বোধ হয় একটা অবসেশন ছিল ভালো দেখতে জিনিসপত্রের প্রতি৷ হি অ্যাকচুইলি ব্রিংস ব্যাক সাম কাইন্ড অফ নিটনেস ইন দ্য সেট৷ যেটা মাঝখানে একদম ছিল না বাংলা ছবিতে৷ কেন দেওয়ালে কী একটা ছবি আছে, সেটা মানে জাস্ট একটা আর্ট ডিরেক্টর এসে লাগিয়ে দিয়ে চলে গিয়েছে৷ কোথায় একটা কিছু রাখা আছে, মানে একটা ফুলদানি৷ সেইটা থেকে কমপ্লিটলি বেরিয়ে গিয়ে খানিকটা চরিত্রদের মতো করে নিজের মতো করে একটা সেটকে তৈরি করা এবং সাজানো, বিভিন্ন জায়গা থেকে বিভিন্ন জিনিস খুঁজে এনে… ওর এটা একদম পার্সোনাল ভাবে করা কারণ ওর বাড়িও সে রকম৷ হি ওয়জ অলমোস্ট লিভিং ইন আ ফিল্ম সেট৷ অথবা ওর সেটটাই আসলে ওর বাড়ি৷ এই ধাঁচটা থেকে কিছু কিছু সময় বেরিয়েছে, যেমন ‘চিত্রাঙ্গদা’৷

হ্যাঁ, সেটা দিচ্ছিল, হি ওয়াজ লাইক চেঞ্জিং টুওয়ার্ডস দ্য সার্টেন ডিরেকশন৷ আর একটা যেটা হয় যে অনেক দিন ধরে ছবি করলে পরে প্রথম প্রথম আমরা মনে করি যে এই জিনিসগুলোই বোধ হয় সিনেমা৷ একটা টেবিল ল্যাম্প ইত্যাদি৷ আস্তে আস্তে হয়তো বুঝতে পারি যে সিনেমাটা আসলে কী৷ তখন ওই টেবিল ল্যাম্পগুলো গৌণ হয়ে যায়৷ ইফ ইউ রিয়েলি ফাইন্ড দ্য ট্রুথ ওই সিম্পলিসিটিটা তখনই অ্যাচিভ করা যায়৷ আমার মনে হয় খানিকটা সে দিকেই উনি যাচ্ছিলেন৷

যখন স্ক্রিপ্টটা তৈরি করা হত, আপনি ঢুকতেন কোন পর্যায়ে?

ও এমনিতে স্ক্রিপ্ট খুব তাড়াতাড়ি লিখত৷ ও হয়তো ফোন করে বলতো একটা ছবি ভাবছি করব, দেখি স্ক্রিপ্টটা লিখে ফেলি৷ ও সাত দিনের মধ্যে স্ক্রিপ্ট লিখে ফেলত৷ কারণ হয়তো পুরো জিনিসটা ওর মাথার মধ্যে ভাবা আছে৷ জাস্ট লিখত৷ ও যেটা শুরু করে দিত, প্রপ জোগাড় করা, কস্টিউম করা৷ তার মধ্যে মধ্যে আমাকে জিজ্ঞেস করে নিত যে এই ছবিটার জন্য তোর কী মনে হয় এই রংগুলো কি যাবে না যাবে না৷ তার পর সবকিছু জোগাড় হলে পরে বিভিন্ন ফেজ-এ বসা হত৷ কালার স্কিম একটা বেসিক ঠিক করে নেওয়া হত যে এই প্যালেটটার মধ্যে থাকব৷ স্ক্রিপ্ট রিডিংটা খুব ভালো করত৷ ওর স্ক্রিপ্ট রিডিং থেকে অ্যাকচুয়ালি বুঝে নেওয়া যেত যে ওর ছবিটা কী৷ ওকে বলেছিলাম যে, তুই এই প্রপের মধ্যে বসে স্ক্রিপ্টটা পড়, এটা শুট করে দিচ্ছি৷ তাতেই ছবিটা হয়ে যাবে৷ ও বলত, তা হলে তো খুবই ভালো হয়, এত পরিশ্রম করতে হয় না৷ ওই স্ক্রিপ্ট রিডিংটা থেকে সব কিছু বেরিয়ে আসত৷ তার পরে পুরো ছবিটা করার সময় আমি আর স্ক্রিপ্ট পড়তাম না৷ ওই রিডিংটা থেকেই যে কটা পয়েন্ট তোলার তুলে নিতাম৷ মূল সুরটা কী সেটা বুঝে নিতাম৷ তার পর স্ক্রিপ্টের সিকোয়েন্স আমার কাছে মনে হত মেকানিকাল৷ সেটার জন্য অন্য লোকজন, অ্যাসিসটেন্ট আছে, ও সব বলে দেবে৷

আপনার মতে ওর সেরা ছবি কোনটা? এবং সবথেকে ভালো ক্যামেরা? সব কিছু মিলিয়ে ভাবলে ওর সবচেয়ে ভালো কাজ ‘চিত্রাঙ্গদা’৷ আর, সেরা বেস্ট শট আমার মতে সব কিছু মিলিয়ে ‘অন্তরমহল’৷ ‘চোখের বালি’র মধ্যে একটা অবভিয়াস বিউটি আছে৷ যেটা খুব সাধারণ লোকও বলবে খুব ভালো ছবি তোলা হয়েছে৷ ‘অন্তরমহল’-এর যে ডার্কনেসটা সেইটা বোধ হয় রিয়ালাইজ করার জন্য এখনও বাঙালি অডিয়েন্স তৈরি নয়৷ ওখানে একটা সুন্দর লাইটিংয়ের মধ্যেও একটা ভায়োলেন্ট জায়গা থাকতে পারে সেইটা বোধ হয় একটু মিসজাজড থেকে গিয়েছে৷

আপনার কি মনে হয় ডিরেক্টর যদি নিজে অ্যাক্টর হয় যেমন সুবিধা হতে পারে, সমস্যাও হতে পারে কি?

সমস্যা যে খুব একটা হয়েছে তা আমার মনে হয় না৷ তার একটা বড়ো কারণ আমি কী পারফর্মেন্স চাইছি শুধু যদি আমি অ্যাক্টরকে মুখে বলি তা হলে হয়তো সে না-ও বুঝতে পারে৷ কিন্ত্ত অ্যাক্টর হলে ফিজিক্যালি কী ভাবে মুভ করতে হবে একটা স্পেসের মধ্যে, সেটাও দেখিয়ে দিতে পারে৷ অনেক ডিরেক্টর-অ্যাক্টরের ছবি আমি দেখেছি, উডি অ্যালেন থেকে অনেকেই, তাদের কিন্ত্ত সাম হাউ একটা ইন্টিগ্রিটি তৈরি হয় পুরো কাজটা নিয়ে৷ ওভারঅল কন্ট্রোল যদি বলি, সেটা তো সত্যজিত্ রায়ও করতেন৷ উনিও তো অভিনয় করে দেখিয়ে দিতেন৷ তাতে পুরোটাই কন্ট্রোলে থাকে৷

No comments

Powered by Blogger.