মনের কোণে হীরে-মুক্তো-চাকরি শেষে সব কর্মকর্তা কি হারিয়ে যান? by ড. সা'দত হুসাইন

লেখাটি শুরু করতে চেয়েছিলাম সব চাকরিজীবীকে অন্তর্ভুক্ত করে। পরে ভেবেচিন্তে দেখলাম এতে সংলেখের আকার এবং বিষয়বস্তুর বিস্তৃতি এত বেশি হয়ে যায় যে দৈনিক কাগজের কলামের জন্য তা উপযোগী হয় না।
সেহেতু শুধু কর্মকর্তাদের অবসর জীবনের মধ্যেই লেখাটি আপাতত সীমাবদ্ধ রাখতে চাচ্ছি। কর্মচারীদের চাকরি-উত্তর জীবন সম্পর্কে পরে লিখব। ইতিমধ্যে তাঁদের জীবনযাত্রার মান ও ধারা সম্পর্কে সরাসরি আলাপ-আলোচনা এবং পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তথ্যাদি সংগ্রহ করার চেষ্টা করব। কাজটি খুব সহজ হবে বলে মনে হয় না।
কর্মকর্তাদের চাকরি-উত্তর (অবসর) জীবন সম্পর্কে আমার সন্ধিৎসা জাগরূক হয় একটি তালিকার ওপর কয়েক মিনিট চোখ বুলানো থেকে। পুরনো কাগজপত্র গোছাতে গিয়ে সরকারের পদস্থ কর্মকর্তাদের কয়েকটি তালিকা আমার হাতে পড়ল। তালিকাগুলো প্রায় চার দশক ধরে বিভিন্ন সময়ে তৈরি করা। সবচেয়ে পুরনো তালিকাটি সত্তরের দশকে তৈরি করা; শেষ তালিকাটি ২০০৫ সালের। তালিকাগুলোতে প্রায় সব ক্যাডারের কর্মকর্তাদের নাম রয়েছে। একটি তালিকায় তাঁদের প্রত্যেকের জন্ম তারিখ, চাকরিতে যোগদানের তারিখ, নিজ জেলাসংক্রান্ত তথ্যসহ চাকরিসংক্রান্ত আরো কিছু তথ্য রয়েছে। তালিকার শতকরা ৮০-৮৫ ভাগ কর্মকর্তাকে আমি চিনি। তালিকার প্রায় সব কর্মকর্তা অবসর গ্রহণ করেছেন। বেশ কিছু কর্মকর্তা ইতিমধ্যে প্রয়াত হয়েছেন, যাঁদের কারো কারো জানাজা ও কুলখানিতে আমি উপস্থিত ছিলাম। স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কোনো তালিকা আমার কাছে ছিল না, যদিও এসব সংস্থার অনেক কর্মকর্তাকেই আমি চিনতাম এবং এখনো চিনি।
তালিকায় চোখ বুলাতে গিয়ে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই আমি অতীতে হারিয়ে গেলাম। আসলে চাকরিতে যোগদানের কয়েক বছরের মধ্যে আমরা চাকরির জগতে স্থায়ীভাবে আবদ্ধ হয়ে পড়েছিলাম। সিনিয়র, সমবয়সী সহকর্মী এবং জুনিয়রদের নিয়ে রচিত এই জগৎ। পারিবারিক পর্যায়েও মেলামেশা মূলত এ জগতের মানুষদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, লেখক, সংস্কৃতিকর্মীরা আসা-যাওয়া করেন, কখনো কখনো তাঁদের সঙ্গে আড্ডা চলে। কিন্তু তাঁরা ঠিক আমাদের জগতের লোক হন না। আমাদের সার্কেলে অন্তর্ভুক্ত বড়জোর আধাসরকারি সংস্থা বা বেসরকারি সংস্থার কর্মকর্তারা। এক কথায়, চাকরিজীবীরা। আজ এত বছর পরও দৃষ্টি মেলে দেখি আমাদের বন্ধু-বান্ধব, আপনজনদের বেশির ভাগই কোনো না কোনো সময় সরকারি-বেসরকারি সংস্থায় চাকরি করেছেন।
তালিকাবদ্ধ চেনা লোকদের কথা মনে করতে গিয়ে বেশ কয়েকটি জায়গায় কেমন যেন খটকা লাগল। চাকরিজীবনে যেসব কর্মকর্তাকে সতত সঞ্চরমান, সর্বত্র বিরাজমান, চির চঞ্চল, সদা সক্রিয় দেখেছি আজ তাঁদের কোনো খোঁজ নেই বললেই চলে। কাগজ-কলমে দেখা যায় তাঁরা বেঁচে আছেন, কিন্তু বাস্তবে তাঁরা যেন হারিয়ে গেছেন। বন্ধু-বান্ধব এবং আশপাশের লোককে জিজ্ঞাসা করে দেখেছি তাঁরা তাঁদের অনেকের খোঁজ দিতে পারেন না। তবে কি তাঁরা হারিয়ে গেছেন, না সীমিত পরিসরে কাজকর্মের মধ্যে নিজেদের লুকিয়ে রেখেছেন? এ প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে অবসর জীবন এবং অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পেরেছি, সে সম্পর্কে পাঠকরা সাধারণভাবে আগ্রহী হবেন।
ষাটের দশকে সরকারি সংস্থায় অবসর গ্রহণের বয়স ছিল ৫৫ বছর। স্বাধীনতার পর এটি ৫৭ বছর করা হয়েছে। বেসরকারি সেক্টরে এ সীমা ৬০ থেকে ৬৫ বছরের মধ্যে নির্ধারিত রয়েছে। সামরিক চাকরির ক্ষেত্রে অবসর গ্রহণের বয়স 'র‌্যাংক'-এর ওপর নির্ভরশীল, কর্মকর্তারা সাধারণত ৪৮ থেকে ৫৭ বছরের মধ্যে অবসর গ্রহণ করেন। স্বাধীনতার আগে এ অঞ্চলে অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র কর্মকর্তার সংখ্যা ছিল অতি নগণ্য। সমাজের খুব কমসংখ্যক লোকই তাঁদের চিনত, তাঁদের নিয়ে চিন্তাভাবনা করা লোকের সংখ্যা ছিল আরো কম। মধ্যম ও নিম্নস্তরের কর্মকর্তারা অবসরের পর সীমিত পরিবেশে, সীমিত পরিসরে চলাফেরা করতেন। অবসরের পর অল্প কয়েক বছর মাত্র তাঁরা পূর্ণ কর্মক্ষম থাকতেন। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া ৭০-৭৫ বছরের আগেই তাঁরা প্রয়াত হতেন। কদাচ দু-একজন মহাপ্রাণ ব্যক্তি ৮০ বছরের বেশি বেঁচে থাকতেন। তাঁদের অর্থবিত্ত এবং সম্পদ ছিল সীমিত; তাঁদের কর্মকাণ্ড, জীবনযাত্রা ছিল সাদাসিধে, কিছুটা বৈচিত্র্যহীন। অবসর গ্রহণের কয়েক বছর পর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাঁদের উপস্থিতি, অনুপস্থিতি কিংবা সমাজজীবনে তাঁদের কর্মকাণ্ড নিয়ে লোকজন মাথা ঘামাত না।
স্বাধীনতার পর, বিশেষ করে গত ২০-৩০ বছরে অবস্থার বড় রকমের পরিবর্তন ঘটেছে। দেশের মানুষের গড় আয়ুষ্কাল প্রায় ১৫ বছর বেড়ে এখন ৭০-এর কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, কর্মক্ষম বয়সসীমা কমপক্ষে ১০ থেকে ১৫ বছর বেড়ে গেছে। আশির দশকের আগে ষাটোর্ধ্ব খুব কমসংখ্যক লোক পূর্ণমাত্রায় কর্মক্ষম ছিল, এখন বহু লোক ৭০-৭৫ বছর পর্যন্ত কর্মক্ষম থাকছে। চাকরি থেকে অবসরপ্রাপ্ত লোকজন স্বাস্থ্যের সম্পর্কে অধিকতর সচেতন বিধায় কর্মক্ষম বয়স্ক লোকদের মধ্যে তাঁদের সংখ্যাই সমধিক। সাবেক সিএসপি অফিসারদের প্রথম ও দ্বিতীয় ব্যাচের (১৯৪৯ ও '৫০ ব্যাচের) কর্মকর্তাদের কেউ আজ বেঁচে নেই। মাত্র দু-তিন বছর আগে তাঁরা প্রয়াত হয়েছেন। পরবর্তী ব্যাচের কর্মকর্তা, যাঁরা প্রায় সবাই সচিব বা সমপর্যায়ের কর্মকর্তা ছিলেন, তাঁদের কেউ কেউ এখনো বেঁচে আছেন। ৮০ বছরের কাছাকাছি বা তদূর্ধ্ব বয়সের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সংখ্যা খুব কম নয়। অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রেও এ কথা মোটামুটি প্রযোজ্য। মাত্র কয়েক দিন আগে পুলিশ সার্ভিসের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা খালেক, হোসেন আহমেদ এবং পোস্টাল সার্ভিসের আহসান উল্যাহ (সবাই সচিব) প্রয়াত হয়েছেন। আশি-ঊর্ধ্ব (বা আশির কাছাকাছি) ব্যক্তিদের মধ্যে সর্বজনাব এম কে আনোয়ার, আবুল মাল আবদুল মুহিত, এয়ার ভাইস মার্শাল খোন্দকার, সাইদুজ্জামান, আনিসুজ্জামান, গোলাম মোস্তফা, আল হুসাইনি, গোলাম কিবরিয়া, ব্যারিস্টার হারুনুর রশিদ, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, দেলোয়ার হুসেন, সি এম মোরশেদ, রেহমান সোবহান, মোস্তফা নুরুল ইসলাম, অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, ড. নুরুল ইসলাম সামাজিক বলয়ে সক্রিয় এবং দৃশ্যমান রয়েছেন। সর্বজনাব মুজিবুল হক, সুলতানুজ্জামান খান, বিচারপতি সাহাবুদ্দীন এবং কাজী ফজলুর রহমান সামাজিক অনুষ্ঠান বা সভা-সেমিনারে খুব একটা উপস্থিত থাকেন না; তাঁদের সবাই পূর্ণমাত্রায় কর্মক্ষম নন।
অন্যান্য ক্যাডার বা নন-ক্যাডার কর্মকর্তা যাঁরা সচিব, অতি সচিব, যুগ্ম সচিব, হিসেবে অবসর গ্রহণ করেছেন, তাঁরা অবসর গ্রহণের পরও অন্তত ১০ বছর পর্যন্ত বেসরকারি সংস্থায় হয় সরাসরি চাকরি করেন অথবা সংযুক্ত থেকে কিছু প্রফেশনাল কাজ করে নিয়মিত আয় উপার্জনের ব্যবস্থা করেন। তবে এ সময় তাঁরা নিয়মিত আয়ের মাধ্যমে আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষে নিবেদিত থাকেন। প্রচার, প্রসার কিংবা সামাজিক-রাষ্ট্রীয় বলয়ে নিজেদের তাঁরা নতুনভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চান না। তাঁদের প্রায় সবার বাড়ি-গাড়ি, অন্যান্য সম্পদ এবং সঞ্চিত টাকাপয়সা রয়েছে। সংসার চালানোর জন্য এসব যথেষ্ট হলেও এতে তাঁরা আর্থিক দিক থেকে নিরাপদ বোধ করেন না। তাঁরা চান নিয়মিতভাবে প্রাপ্ত মাসিক কিছু অতিরিক্ত আয়। যে সংস্থা থেকে এ আয়ের ব্যবস্থা করা হয়, সে সংস্থার কাজেই তাঁরা সম্পূর্ণভাবে ব্যাপৃত থাকতে পছন্দ করেন। নতুন করে সামাজিক বা রাষ্ট্রীয়ভাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষে তাঁরা বাড়তি কোনো কাজ করতে চান না। রাজনীতির ধকল, জেল-জুলুম, হামলা-মামলার কারণে রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ তাঁদের প্রায় সবারই ভাবনাচিন্তার বাইরে। চাকরি জগতের ডাকসাইটে কর্মকর্তা, প্রায় সব অনুষ্ঠানে, সভা-সেমিনারে, সামাজিক বলয়ে যাঁদের বলিষ্ঠ উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো, তাঁরা এখন শহর থেকে দূরে কোনো ফ্যাক্টরিতে বা এনজিওর আঞ্চলিক অফিসে পূর্ণকালীন কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেন। শহরে এসে সামাজিক পর্যায়ে মেলামেশা কিংবা অনুষ্ঠান আয়োজনে চোখে পড়ার মতো সময় নিয়ে উপস্থিত থাকা তাঁদের পক্ষে সম্ভব হয় না। পত্রপত্রিকা এবং টিভি চ্যানেলের সংখ্যা অত্যধিক হওয়ায় তাঁদের লেখালেখি কিংবা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ আমাদের অনেকের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়। আমরা তখন মনে করি তাঁরা বোধ হয় হারিয়ে গেছেন। আসলে তাঁরা হারিয়ে যাননি, তাঁদের জীবনধারা বদলে গেছে।
সরকারি-বেসরকারি সব খাতের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের জীবনধারায় গত দুই দশকে একটি বড় পরিবর্তন হিসেবে যোগ হয়েছে লম্বা সময় ধরে বিদেশে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে অবস্থান। স্বাধীনতার পর এ দেশের হাজার যুবক-যুবতী শিক্ষা এবং কর্মসংস্থান ব্যাপদেশে বিদেশে গিয়েছে। তাদের এক বিরাট অংশ এখন বিদেশে বসবাস করছে। তাদের মা-বাবা বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি করে অবসর গ্রহণ করেছেন। তাঁরা বছরে তিন থেকে ছয় মাস বিদেশে গিয়ে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে অবস্থান করেন। তাঁরা নিজে এবং ছেলেমেয়েরা উভয়ে এতে খুশি। এ শ্রেণীর কর্মকর্তারা বস্তুত দেশে এবং বিদেশে আসা-যাওয়া করেন। দেশে ফিরে আসার মাস দু-এক পরই তাঁরা আবার বিদেশ যাওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকেন। দেশের বাসস্থান অনেকটা পান্থনিবাসে পরিণত হয়েছে। এখানকার সমাজ এবং পরিবেশের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক ক্ষীণ হয়ে আসছে। বিদেশে অবস্থানরত ছেলেমেয়েদের জীবনের সঙ্গে তাঁরা জড়িয়ে পড়েছেন; অনেকে আবার বিদেশের নাগরিকত্ব নেওয়ার চেষ্টা করছেন। দেশীয় সমাজে, পাড়া-মহল্লায়, আচার-অনুষ্ঠানে তাঁদের খুব একটা দেখা যায় না। আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, সাবেক সহকর্মী, পড়শি কে কী ভাবল, তাতে তাঁদের কিছু যায় আসে না। তাঁরা হারিয়ে যাননি, ভিন দেশে পরিবর্তিত মনমানসিকতা নিয়ে অবস্থান করছেন। পর্যটক হিসেবে মাঝেমধ্যে দেশে আসেন, কিছুদিন থাকেন, আবার চলে যান। তাঁরা ভালোই আছেন।
কর্মকর্তাদের ছোট একটি অংশ সীমিত পরিসরে সমাজ উন্নয়নমূলক বা জনহিতকর কাজে আত্মনিবেশ করেন। তাঁরা নিজ গ্রামে (এলাকায়) ঘন ঘন গিয়ে স্কুল, কলেজ, মসজিদ-মাদ্রাসা, হাসপাতাল, পাঠাগার নির্মাণ করেন, গ্রাম-উন্নয়নমূলক সংগঠন গড়ে তোলেন; ধর্মীয় কিংবা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানাদিতে নেতৃত্ব দেন; রাজধানী বা বড় শহরে খুব কমই অবস্থান করেন। পুরনো সহকর্মী এবং বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে আগের মতো মেলামেশা করেন না। গ্রামীণ পরিবেশে প্রায় সব আধুনিক সুবিধা পাওয়া যায় বলে তাঁদের থাকা-খাওয়া, চলাফেরায় তেমন কোনো অসুবিধা হয় না। ভাষাসৈনিকদের ওপর সম্প্র্রতি প্রকাশিত লেখাগুলো পড়ে আমার এ ধারণা আরো দৃঢ় হয়েছে। তাঁদের বেশির ভাগই বিভিন্ন সংস্থায় চাকরি করেছেন; এখন তাঁদের বয়স আশির বেশি। তাঁরা প্রায় সবাই গ্রামেগঞ্জে সমাজ-উন্নয়নমূলক কাজ করছেন। শহরাঞ্চলে তাই তাঁদের পরিচিতি নেই। কিন্তু তাঁদের কাজ এবং জীবনধারা সম্পর্কে জেনে ভালো লেগেছে। এ রকম অনেক কর্মকর্তা দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন; নিজেদের মতো জনকল্যাণে কাজ করে যাচ্ছেন। তাঁরা হারিয়ে যাননি। আমাদের পরিচিত পরিবেশ থেকে একটু দূরে আছেন। তাঁদের কাজকর্ম আমাদের গর্বিত করে।
আর এক ধরনের কর্মকর্তা রয়েছেন যাঁরা অবসর জীবনে নিজেদের অনেকটা গুটিয়ে নেন। তাঁদের বেশির ভাগ মোটামুটি সচ্ছল, তবে তাঁরা পরিমিত ব্যয়ে বিশ্বাস করেন। খেয়েপরে ভালোভাবেই চলতে পারেন। তাঁরা ধর্ম-কর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, কেউ কেউ তাবলিগে যোগ দেন; 'চিল্লায়' অংশ নেন। দৈনন্দিন রুটিন তাঁরা এমনভাবে সাজিয়ে নেন যে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের বাইরে আর বিশেষ কিছু করার থাকে না। রাতে এশার নামাজের কিছু পর তাঁরা শুয়ে পড়েন এবং শেষ রাতে বা অতি ভোরে উঠে নামাজ-কালাম পড়ে দিন শুরু করেন। তাঁরা সুখ-শান্তিতে জীবনযাপন করেন। সংসার সমাজের সাত-পাঁচের মধ্যে থাকেন না। বিশ্বাস এবং মূল্যবোধ তাঁদের জীবনে এক ধরনের প্রশান্তি এনে দেয়, যা সত্যিকার অর্থে এক অমূল্য সম্পদ। তাঁদের আমরা আমাদের মধ্যে দেখি না। কিন্তু তাঁরা হারিয়ে গেছেন বা নিঃশেষ হয়ে গেছেন- এমনটি বলা সঠিক হবে না। ধর্মে-কর্মে তত গভীরভাবে ব্যাপৃত না হয়ে যাঁরা পরিবার-পরিজন, বিশেষ করে নাতি-নাতকুর নিয়ে সময় কাটান তাঁদেরও সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে খুব একটা দেখা যায় না। জীবনের এ অংশে এসে পারিবারিক পরিবেশে আয়েশী সময় কাটাতে তাঁরা পছন্দ করেন। নিজের মতো করেই তাঁরা সুখী থাকেন।
সবার শেষে রয়েছেন সেই ক্যাটাগরির কর্মকর্তা, যাঁরা ভাগ্য বিড়ম্বনার শিকার। এর একটি বড় কারণ হচ্ছে রোগ-শোকের আক্রমণ, আর্থিক অভাব-অনটন। ষাটোর্ধ্ব খুব কম লোকই নিরোগ দেহের অধিকারী। সবাই অল্প-বিস্তর ছোটখাটো রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হন। এর মধ্যে ভাগ্য-বিড়ম্বিত কয়েকজন কর্মক্ষমতা সংহারক গুরুতর ব্যাধিতে আক্রান্ত হন। স্ট্রোক, পক্ষাঘাত, ক্যান্সার, কিডনি রোগ, পারকিনসনস, আলঝেইমার, মারাত্মক হৃদরোগ, মানসিক বৈকল্য, স্নায়ু দৌর্বল্য, মারাত্মক ডায়াবেটিস ইত্যাদি রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন, অন্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন এবং আর্থিক দিক থেকে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েন। দুঃখজনকভাবে কোনো কোনো অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এরূপ অবস্থায় বিপর্যস্ত হয়ে যান। কেউ বা শয্যাশায়ী থাকেন। তাঁদের সম্পর্কে লিখতে গেলে মন খারাপ করে। তাই আর লিখছি না। সরকার এবং সংশ্লিষ্ট নিয়োগকারী সংস্থা মানবিক কারণে তাঁদের সাহায্যে এগিয়ে আসা সমীচীন হবে বলে মনে করি।
চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করাকে জীবন বা কর্ম থেকে অবসর নেওয়া মনে করা একটি বিরাট ভুল। দেশের মানুষের আয়ুষ্কাল উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যাওয়ার ফলে অবসর গ্রহণের পরও ২০-২৫ বছর অনেকেই নানা ধরনের সুন্দর কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকছেন। চাকরিজগতের পূর্বতন পরিবেশের সঙ্গে তাঁরা হয়তো বা সম্পৃক্ত থাকছেন না, তবে তাঁরা হারিয়ে যাননি। জীবনসায়াহ্নে কেউ কেউ কর্মে অক্ষম হয়ে পড়লেও চাকরিজীবনে এবং অবসর-উত্তর জীবনে দেশ ও মানুষের কল্যাণে তাঁরা যে অবদান রেখে গেছেন, আমরা যেন তা ভুলে না যাই। অন্তত আমাদের জীবদ্দশায় আমাদের মধ্যে তাঁদের বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ববোধ থেকে আমরা যেন বিস্মৃত না হই।

লেখক : পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান ও
সাবেক মন্ত্রিপরিষদসচিব

No comments

Powered by Blogger.