ধর্ম মনুষ্যত্ব অর্জনে রোজার ভূমিকা by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান

মানুষ যেন প্রকৃত মানুষ হতে পারে, তার মধ্যে মনুষ্যত্ব যেন পূর্ণ মাত্রায় জাগ্রত হয়, সে যেন খুঁজে পায় চিরমুক্তির মোহনা, যেন পৌঁছাতে পারে তার কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে বা মনজিলে মাকসুদে—এ জন্য আল্লাহ তাআলা পবিত্র রমজান মাসে ৩০ দিন রোজার বিধি-বিধান দান করেছেন।
কিন্তু মানুষকে পথভ্রষ্ট করার জন্য শয়তান ব্যক্তির নফস বা প্রবৃত্তির ওপর কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য প্রভৃতি রিপু দ্বারা প্রভাব বিস্তার করে।
মানব চরিত্রের অন্যতম মহৎ গুণ সততা—এ গুণ অর্জনের আন্তরিক চেষ্টা ও নিরলস চর্চা মানুষকে মর্যাদার উচ্চতর স্থানে পৌঁছে দিতে পারে। আর রোজার মধ্যে ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ বা সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে মানুষের পূতপবিত্র সুন্দর চরিত্র সৃষ্টির ঐশী অবদান লুকিয়ে আছে। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে মাহে রমজানে রোজা রাখার নির্দেশ প্রদানের সঙ্গে সঙ্গে এর তিনটি উদ্দেশ্য ঘোষণা করেছেন। বলা হয়েছে যে রোজা এ জন্য ফরজ করা হয়েছে, যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো, আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করতে পারো এবং তাঁর শোকরগুজার হতে পারো। মূলত এ তিনটি মহান লক্ষ্য অর্জনের জন্য যাঁরা রমজান মাসে রোজা পালন করবেন, তাঁরাই এ মহিমান্বিত মাসের অশেষ কল্যাণ ও পুণ্য লাভ করতে পারবেন। ইসলামে রোজা তাই নিছক উপবাস নয়, বরং মাহে রমজানের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য মানুষকে সৎ, নির্লোভ ও সংযমী হতে শেখায়। রোজার প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমাদের জন্য সিয়ামের বিধান দেওয়া হলো, যেমন বিধান তোমাদের পূর্ববর্তীদের দেওয়া হয়েছিল, যাতে তোমরা সাবধান হয়ে চলতে পারো।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৮৩)
রোজাদার ব্যক্তির সৎ ও পুণ্যবান থাকার প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে সমাজে নীতি-নৈতিকতা এবং সততার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। রোজা পালনের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে তাকওয়া তথা খোদাভীতি ও পরহেজগারি অর্জন করা। তাকওয়া মানে আল্লাহর অসন্তুষ্টির ভয়ে তাঁর নিষেধসমূহকে পরিহার করা, স্রষ্টার ভালোবাসায় বিনম্রভাবে তাঁর যাবতীয় আদেশ-নির্দেশ যথাযথভাবে পালন করা এবং তাঁর সন্তুষ্টি লাভের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করা। এক কথায় সব ধরনের অকল্যাণকর ও গুনাহর কাজ বর্জন করা এবং সব ধরনের কল্যাণময় ও সওয়াবের কাজ পালন করার নামই তাকওয়া। রোজা মানুষের মধ্যে সর্বতোভাবে এ তাকওয়া সৃষ্টি করে দেয়। মানুষ যখন রোজাব্রত পালন করেন, তখন তিনি আত্মশুদ্ধি লাভ করে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করেন। মাহে রমজানে রোজাকে সফল করে তুলতে হলে সৎ থাকার অভ্যাস অর্জন করতে হয়।
একজন রোজাদার ব্যক্তি যখন রোজা পালন করে চরম ধৈর্য, সততা, ন্যায়নিষ্ঠা ও ঐকান্তিকতার পরিচয় দেন, তখন দারুণ ক্ষুধা-তৃষ্ণার মধ্যেও তিনি পানাহার করেন না। কারণ, তিনি আল্লাহকে ভয় করেন। তিনি মনে করেন, কেউ না দেখলেও সর্বশক্তিমান আল্লাহ তো দেখছেন। তিনি আল্লাহকে পরম ভালোবাসেন। তাঁর ভালোবাসায় উদ্বুদ্ধ হয়েই বিধিসম্মতভাবে রোজা আদায় করেন। মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ, পরকাল, হিসাব-নিকাশ, শাস্তি, পুরস্কার প্রভৃতির প্রতি তাঁর দৃঢ়বিশ্বাস আছে বলেই তিনি পানাহার না করার সংকল্পে অটল থাকতে পারেন। মূলত এটিই হচ্ছে তাকওয়া। সততা ও ন্যায়নিষ্ঠার সঙ্গে রোজা পালন করে ইমানদার ব্যক্তি এ তাকওয়ার অনুশীলন করেন। মাহে রমজানের পূর্ণ একটি মাস তাঁর এ প্রশিক্ষণ কার্যক্রম প্রতিবছর চলতে থাকে। এমনিভাবেই একজন সৎ ও নিষ্ঠাবান মুমিনের জীবনে রোজা রাখার মাধ্যমে তাকওয়া অর্জনের উদ্দেশ্য হাসিল হয়ে থাকে।
রোজার মাধ্যমে মানুষকে সৎ ও পুণ্যবান করাই হলো রোজার প্রকৃত উদ্দেশ্য। রোজা রাখার পরও যদি কেউ পুণ্যবান না হন; আদর্শ, সততা ও ন্যায়নিষ্ঠার ওপর নিজের জীবনের ভিত্তি রচনা করতে না পারেন, মাহে রমজানে অসত্য ও নিরর্থক কথাবার্তা পরিত্যাগ করতে না পারেন এবং রমজান মাসের বাইরে নিজের জীবনে সততা ও পবিত্রতা দেখা না দেয়, তাহলে তাঁর চিন্তা করে দেখা উচিত যে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত উপবাস যাপন করে তাঁর কী লাভ হলো? তাই রোজাদারকে রোজার আসল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সম্পর্কে সজাগ থাকার জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘অনেক রোজাদার এমন আছে, কেবল ক্ষুধা আর পিপাসা ছাড়া যাদের ভাগ্যে অন্য কিছুই জোটে না। তেমনি রাত্রিতে ইবাদতকারী অনেক মানুষও এমন আছে, যারা রাত্রি জাগরণ ছাড়া আর কিছুই লাভ করতে পারে না।’ (ইবনে মাজা)
মাহে রমজানের লক্ষ্য হচ্ছে মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্ববোধ জাগ্রত করে পারস্পরিক প্রেম-ভালোবাসা, ভ্রাতৃত্ব, সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও মহব্বতের সুমধুর ও সুনিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলে এ পৃথিবীকে শান্তির বেহেস্তে পরিণত করা, তা যদি না হয় আর মানুষের ভেতর যদি মানবিক গুণাবলি সৃষ্টি না করা যায়, তাহলে সে রোজা উপবাস ছাড়া আর কিছু নয়। তাই রমজানের একটি মাসে কঠোর সিয়াম সাধনা করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য অবশ্যকর্তব্য। নবী করিম (সা.) রোজার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ইমান ও আত্মবিশ্লেষণের সঙ্গে রোজা রাখবে, তার অতীতের গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।’ (বুখারি ও মুসলিম)
মাহে রমজানে শুধু রোজা রাখলে হবে না, অবশ্যই রোজাদারকে যাবতীয় পাপকাজ যথা পরচর্চা, পরনিন্দা, ঝগড়া-বিবাদ, সুদ-ঘুষ, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, হারাম, অশ্লীলতা, ব্যভিচার, বেহায়াপনা, অন্যায়-অত্যাচার, ওজনে কম দেওয়া, খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল দেওয়া প্রভৃতি শরিয়ত-পরিপন্থী কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকতে হবে। সুতরাং প্রত্যেক রোজাদার মুসলমান নর-নারীর জীবনের পাপকাজ থেকে মুক্ত থেকে মনুষ্যত্বের গুণাবলি অর্জনে নীতি-নৈতিকতা, সততা ও ন্যায়নিষ্ঠা প্রদর্শন করে রোজার প্রকৃত উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য পরিপূর্ণ করার প্রত্যয়ে অধিক পরিমাণে পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত, দোয়া-ইস্তেগফার, তাসবিহ-তাহলিল, জিকির-আজকার, দান-সাদকা ও তারাবিহ-তাহাজ্জুদ নামাজ আদায়সহ ইবাদত-বন্দেগি করে অশেষ পুণ্য লাভের জন্য মাহে রমজানে অবশ্যই আত্মনিয়োগ করা উচিত।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: চেয়ারম্যান, ইসলামিক স্টাডিজ ও দাওয়াহ বিভাগ, ধর্মবিজ্ঞান অনুষদ, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়।
dr.munimkhan@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.