অ্যাবোটাবাদ কমিশনের প্রতিবেদন ফাঁস-সম্মিলিত ব্যর্থতা লাদেনের আত্মগোপনে সহায়ক হয়

সেনাদের পদক্ষেপ ও গুলির শব্দ ক্রমেই তিন তলার ঘরটির দিকে এগিয়ে আসছে। ঘরটিতে রয়েছেন আল কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেন, তাঁর ছোট স্ত্রী আমাল ও এক মেয়ে। অনেক দেরি হয়ে গেছে তখন।
সবাই বুঝতে পারে জীবনের শেষ মুহূর্তটি চলে এসেছে তাদের। ঘরের বাইরে তাকালেন আমাল। দেখেন যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ কমান্ডো বাহিনী নেভি সিলের এক সদস্য আগ্নেয়াস্ত্র ধরে আছে স্থির হাতে। অস্ত্র থেকে আসা লেজার রশ্মির লাল আলোটি ওসামার বুকের ওপর। রাইফেলটি ছিনিয়ে নিতে কমান্ডোর দিকে লাফ দিয়ে এগিয়ে যান আমাল। কিন্তু এর আগেই গুলি লাগে তাঁর হাঁটুতে। বের হয় আরো এক ঝাঁক। কিছুক্ষণ পরে তিনি শুনতে পান, সেনারা মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করছেন, যে লোকটিকে তাঁরা এইমাত্র গুলি করে মেরেছেন, তাঁর নাম কি?
২০১১ সালের ২ মে ওসামা বিন লাদেন নিহত হওয়ার পর তাঁর হত্যাকাণ্ডের নানা কাহিনী শুনে এসেছে বিশ্ববাসী। কখনো নেভি সিল টিমের কোনো সদস্যের মুখে, কখনো মার্কিন কর্মকর্তাদের সংবাদ মাধ্যমে দেওয়া বক্তব্য থেকে। কিন্তু এবার প্রথম মুখ খুললেন বিন লাদেনের পরিবারেরই সদস্যরা। তাঁর স্ত্রী ও কন্যাদের মুখে জানা গেল সেই দিনের পুরো ঘটনা। গত সোমবার ফাঁস হয়ে যাওয়া পাকিস্তানের বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশনের (অ্যাবোটাবাদ কমিশন) প্রতিবেদনে জানা গেছে এসব।
অ্যাবোটাবাদ কমিশনের প্রতিবেদনটি কাতারভিত্তিক আল-জাজিরা নিউজ নেটওয়ার্কের হাতে এলে তারা এর পুরোটাই প্রকাশ করে দেয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারের বিভিন্ন সংস্থার 'সম্মিলিত ব্যর্থতা, অযোগ্যতা এবং অবহেলার' কারণেই আল কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেন ৯ বছর পাকিস্তানে আত্মগোপন করে থাকতে পেরেছিলেন। ব্যর্থতার জন্য সরকারের বিভিন্ন সংস্থাকে তীব্র র্ভৎসনাও করা হয় এতে।
পাকিস্তান সরকারের অজ্ঞাতে যুক্তরাষ্ট্রের লাদেন হত্যা অভিযান ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়। জনরোষের মুখে পড়ে পাকিস্তান সরকার। ঘটনার দুই মাস পরে সুপ্রিম কোর্ট অ্যাবোটাবাদ কমিশন নামে বিশেষ তদন্ত কমিটি গঠন করে। বিচারপতি জাভেদ ইকবালের নেতৃত্বে চার সদস্যের কমিটি গত জানুয়ারিতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজা পারভেজ আশরাফের কাছে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। পাকিস্তান সরকার প্রতিবেদনটিকে 'রাষ্ট্রীয় গোপন দলিল' হিসেবে শ্রেণীভুক্ত করে।
লাদেনের পরিবারের সদস্য, সরকারি কর্মকর্তাসহ প্রায় ২০১ ব্যক্তির সাক্ষ্যের ভিত্তিতে ৩৩৬ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের হামলা থেকে বাঁচতে বিন লাদেন ২০০২ সালের বসন্তে বা গ্রীষ্মে পাকিস্তানে প্রবেশ করেন। প্রথম দিকে তিনি সোয়াত উপত্যকায় ছিলেন। নিহত হওয়ার দিন পর্যন্ত এই ৯ বছর তিনি কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই পাকিস্তানে ছিলেন। এই সময়ে তিনি ছয়বার ঠিকানা পরিবর্তন করেন। গোয়েন্দাদের ফাঁকি দিতে এক সময় দাড়ি কামিয়ে 'কাউবয় হ্যাটও' পড়েন তিনি। অ্যাবোটাবাদের বাড়িটিতে তিনি ছিলেন ছয় বছর ধরে।
বিন লাদেন ২০০২ অথবা ২০০৩ সালের প্রথম দিকেই ধরা পড়তে পারত বলে প্রতিবেদনে দাবি করা হয়। কিন্তু সরকারি নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থার ব্যর্থতার কারণেই সেটা সম্ভব হয়নি। সেবার বেশি জোরে চলার কারণে বিন লাদেনকে বহনকারী গাড়িটি থামিয়েছিল পুলিশ। কিন্তু পুলিশ তাঁকে চিনতে পারেনি। লাদেনের পরিবারের সদস্যদের বক্তব্যে জানা যায়, তাঁদের সঙ্গী ইব্রাহিম আল-কুয়েতির তৎপরতায় পুলিশ তাঁদের ছেড়ে দেয়। প্রতিবেদনে পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর তৎপরতা বন্ধে সরকার ব্যর্থ হয়েছে বলা হয়। এর জন্য পাকিস্তানি কর্মকর্তাদের তিরস্কার করা হয় এবং যুক্তরাষ্ট্রের তৎপরতাকে অবৈধ ও অনৈতিক বলে চিহ্নিত করা হয়। পাকিস্তানে কর্মরত এনজিওগুলোকে যুক্তরাষ্ট্রের 'ভাড়াটে গুণ্ডা' বলে অভিহিত করা হয়। লাদেনের পরিবারের সদস্যরা জানান, সে রাতে তাঁরা যুক্তরাষ্ট্রের ব্ল্যাক হক হেলিকপ্টারের শব্দকে মনে করেছিলেন ঝড়ের শব্দ। সুমাইয়া নামে লাদেনের এক মেয়ে জানান, ঘটনার পর পরই তিনি বুঝতে পারেন তাঁর বাবা মারা গেছেন। কারণ একটি গুলি তাঁর কপালের মাঝখানে লেগেছিল এবং মাথার নিচ থেকে রক্তের একটি স্রোত ভিজিয়ে দিয়েছিল ঘরের মেঝে।
সূত্র : এএফপি, টেলিগ্রাফ।

No comments

Powered by Blogger.