ফার্মাজায়ান্ট র‌্যানবেক্সিকে জরিমানা

র‌্যানবেক্সি ল্যাবরেটরিজ লিমিটেড হলো ভারতের একটি প্রসিদ্ধ ওষুধ কম্পানি, যা ১৯৬১ সালে করপোরেশনরূপে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৭৩ সালে কম্পানিটি জনসাধারণের ক্রয়ের জন্য বাজারে শেয়ার ছাড়ে।
২০০৮ সাল নাগাদ জাপানের ওষুধ কম্পানি ডাইচি সানকাইও ৪ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার দিয়ে র‌্যানবেক্সির ৫০ দশমিক ১ শতাংশ শেয়ার কিনে নেয়। র‌্যানবেক্সি বর্তমানে পৃথিবীর ১৫০টি দেশে তাদের উৎপাদিত ওষুধ রপ্তানি করে থাকে। ২০১১ সালে র‌্যানবেক্সি গ্লোবাল কনজ্যুমার হেলথ কেয়ার 'ওটিসি (ওভার দ্য কাউন্টার) কম্পানি অব দ্য ইয়ার' পুরস্কারে ভূষিত হয়। ১৯৯৮ সালে এই কম্পানি বিশ্বের সর্ববৃহৎ ওষুধের বাজার যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবসা শুরু করে। ২০০৫ সালের মধ্যেই র‌্যানবেক্সি যুক্তরাষ্ট্রের মোট ওষুধ বিক্রির ২৮ শতাংশ নিজের আয়ত্তে নিয়ে আসে। ২০০৫ সালে র‌্যানবেক্সির বিশ্বব্যাপী মোট বিক্রির পরিমাণ ছিল ১১৭৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং ২০০৬ সালে এই বিক্রির পরিমাণ গিয়ে দাঁড়ায় ১৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে।
জেনেরিক ওষুধ উৎপাদনকারী বিশ্ববিখ্যাত এই কম্পানিটিকে এই বছরের ১৩ মে যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ ৫০০ মিলিয়ন ডলার জরিমানা করেছে। বছরের পর বছর সত্য না বলা, তথ্য বিকৃতি ও জাল করাসহ নিম্নমানের ও ভেজাল ওষুধ উৎপাদন এবং বিক্রি করার জন্য র‌্যানবেক্সিকে এই বিশাল অঙ্কের অর্থ জরিমানা করা হয়। জেনেরিক ওষুধ উৎপাদনকারী ভারতীয় কোনো বহুজাতিক কম্পানিকে এই প্রথম এত বড় অঙ্কের জরিমানা করা হলো। র‌্যানবেক্সির প্রতারণা, জালিয়াতি ও অসংখ্য অপকর্মের চাঞ্চল্যকর তথ্য ফাঁস করে আদালতের রায় বের করে আনার পেছনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন কম্পানির সাবেক পরিচালক দিনেশ ঠাকুর। ভয়ভীতি, পরিবারের সদস্যদের জীবনের নিরাপত্তাহীনতা উপেক্ষা করে দিনেশ ঠাকুর র‌্যানবেক্সির প্রতারণা, জালিয়াতি ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সাহসিকতার সঙ্গে লড়ার কারণে তাঁকে ৪৮ দশমিক ৬ মিলিয়ন ডলার পুরস্কার বা ক্ষতিপূরণ প্রদান করার জন্য আদেশ প্রদান করেন আদালত। নাটকীয়ভাবে ঘটনার সূত্রপাত ঘটে। তাহলে শুনুন সেই কাহিনী-
যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক দিনেশ ঠাকুর ব্রিস্টল-মায়ার-স্কুইবে ১০ বছরের চাকরির অভিজ্ঞতা নিয়ে ২০০২ সালে ভারতের সর্ববৃহৎ ওষুধ কম্পানি র‌্যানবেক্সিতে যোগদান করেন। যোগদানের দুই বছরের মাথায় ২০০৪ সালে দিনেশ ঠাকুর র‌্যানবেক্সির প্রতারণা ও দুর্নীতির কথা প্রথম জানতে পারেন তাঁরই বস ড. রাজিন্দর কুমারের কাছ থেকে। দক্ষিণ আফ্রিকার এইডস রোগীদের চিকিৎসার জন্য উৎপাদিত অ্যান্টিরেট্রোভাইরাল ড্রাগের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল পরিচালনার জন্য র‌্যানবেক্সি ভিমতা ল্যাবরেটরিজ নামের এক ভারতীয় কম্পানিকে ভাড়া করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত তদন্তে দেখা যায়, ভিমতা ট্রায়াল সম্পর্কিত পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফল জাল করেছে। দিনেশ ঠাকুরের অন্য এক সহকর্মীর মতে, সমস্যা শুধু ভিমতা বা অ্যান্টিরেট্রোভাইরাল ওষুধ নিয়ে নয়, র‌্যানবেক্সির ওষুধ নিয়ে বিশ্বব্যাপী আরো জটিল ও গুরুতর সমস্যা রয়েছে। এসব কথা কোনোমতেই তিনি মেনে নিতে পারছিলেন না। অল্প সময়ের মধ্যে তাঁর হাতে প্রমাণ এসে গেল। তাঁর তিন বছরের ছেলে ভয়ানক কানের সংক্রমণে আক্রান্ত হওয়ার পর এক শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ শিশুটিকে র‌্যানবেক্সির শক্তিশালী অ্যান্টিবায়োটিক অ্যামোঙ্কি্ল্যাভ প্রদান করেন। কিন্তু তিন দিন অতিবাহিত হয়ে যাওয়ার পরও ছেলের জ্বর না কমাতে চিকিৎসক র‌্যানবেক্সির ওষুধ পরিবর্তন করে গ্ল্যাক্সো-স্মিথক্লাইনের একই ব্র্যান্ডের ওষুধ প্রদান করেন। এক দিনের মধ্যেই শিশুর জ্বর কমে গেল। অবাক হলেন দিনেশ ঠাকুর এবং তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন পুরো সত্য উদ্ঘাটিত না হওয়া পর্যন্ত তাঁর পরিবারের কাউকে আর র‌্যানবেক্সির ওষুধ সেবন করতে দেবেন না। পরবর্তী কয়েক মাসে দিনেশ ঠাকুর যেসব ধ্বংসাত্মক তথ্য ও অভিযোগ উত্থাপন শুরু করলেন, তাতে র‌্যানবেক্সি, এফডিএ (ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন) এবং বিচার বিভাগের মধ্যে দীর্ঘ ৯ বছরের এক চাঞ্চল্যকর আইনি লড়াই শুরু হবে তা কেউ আন্দাজ করতে পারেনি। চলতি বছরের ১৩ মে র‌্যানবেক্সি সাতটি অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে অভিযুক্ত হয় এবং দোষ স্বীকার করে বিচার বিভাগের সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতে ৫০০ মিলিয়ন ডলার জরিমানা ও ক্ষতিপূরণ পরিশোধে সম্মত হয়। অপরাধগুলোর মধ্যে গুরুতর কয়েকটি হলো- ঠকানোর উদ্দেশ্যে ভেজাল ওষুধ উৎপাদন ও বিক্রয়। উৎপাদিত ওষুধের গুণগতমানের শর্তাবলি পূরণ না করা, তথ্য গোপন করা, সরকারের কাছে ভুয়া তথ্য প্রদান করা, এফডিএর অনুমোদন লাভের জন্য জাল ও মিথ্যা তথ্য প্রদান করা ইত্যাদি। কেন্দ্রীয় আইনানুযায়ী গোপন তথ্য ফাঁস করার স্বীকৃতিস্বরূপ দিনেশ ঠাকুরকে ৪৮ দশমিক ৬ মিলিয়ন ডলার প্রদানের হুকুম দিয়েছেন আদালত। র‌্যানবেক্সির সঙ্গে বিচার বিভাগের আপসরফা হলেও পুরো ঘটনাটি এই মর্মে এমন এক চ্যালেঞ্জ ও প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে গেল যে এসব ফার্মাজায়ান্টের প্রতারণা ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ কতটুকু নিরাপদ। কারণ প্রতারণার দায়ে র‌্যানবেক্সিকে জরিমানা করাটা বিশ্বের ওষুধ শিল্পের প্রথম বা নতুন ঘটনা নয়। এর আগেও অসংখ্য ফার্মাজায়ান্টকে জালিয়াতি ও প্রতারণার দায়ে বিপুল অঙ্কের টাকা জরিমানা করা হয়েছিল। মার্ক যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় বৃহত্তম ওষুধ কম্পানি। ১৯৯৯ সালে মার্ক প্রদাহ, অস্টিও আর্থ্রাইটিস, তীব্র ব্যথা-বেদনা ও ডিসমেনোরিয়ার জন্য ভায়োক্স (মূল উপাদান-রফেকক্সবি) বাজারজাত করে। ১৯৯৯ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত এই ওষুধটি ব্যবহার করার কারণে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ফলে বিশ্বের হাজার হাজার মানুষ হৃদরোগ, স্ট্রোক ও অন্যান্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াজনিত রোগে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ছাড়াও মৃত্যুবরণ করে।
ফিরে আসি র‌্যানবেক্সি প্রসঙ্গে। র‌্যানবেক্সির ওষুধের বিশাল বাজার নিয়ে আরো কিছু তথ্য উপস্থাপন অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক বলে মনে করি। বর্তমানে বিশ্বে জেনেরিক ওষুধের বাজার ২৪২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে এবং এখনো দাম কম হওয়ার কারণে এসব জেনেরিক ওষুধের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। প্রথম জেনেরিক ওষুধ কম্পানি হিসেবে র‌্যানবেক্সি যুক্তরাষ্ট্রে ওষুধ বিক্রয়ের অনুমতি লাভ করে। যুক্তরাষ্ট্রে গত বছর র‌্যানবেক্সির জেনেরিক ওষুধ বিক্রির পরিমাণ ছিল প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা এবং বিশ্বে এই বিক্রির পরিমাণ ছিল ২৪ হাজার কোটি টাকা। জেনেরিক ওষুধের কাটতি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বজুড়ে স্বাভাবিকভাবে এসব ওষুধের উৎপাদন, গুণগতমান ও বিপণনে ভুলভ্রান্তি এবং নিরাপত্তার প্রশ্নটি বারবার উত্থাপিত হচ্ছে। সকারি জবাবদিহিতা অফিস কর্তৃক প্রণীত এক রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০০৯ সালে নিয়ন্ত্রক সংস্থা মাত্র ১১ শতাংশ বিদেশি এবং ৪০ শতাংশ স্থানীয় ওষুধ কম্পানি পরিদর্শন করেছে। ২০০৮ সালে প্রথম র‌্যানবেক্সির প্রতারণার ঘটনাটি কেন্দ্রীয় বিচার বিভাগে লিপিবদ্ধ হয়। কিন্তু এই প্রতারণার পরিমাণ ও গভীরতা, কম্পানির ঊর্ধ্বতন কর্তাব্যক্তিদের প্রতারণা ও দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার ব্যাপারটি আগে কেউ জানত না।
গবেষণা তথ্য ও প্রকল্প ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দিনেশ ঠাকুরের দায়িত্ব ছিল বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ওষুধের বাজারে স্বচ্ছতা ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা। এই দায়িত্ব পালনকালে দিনেশ ঠাকুর বিশ্বের অনেক দেশে র‌্যানবেক্সির প্রতারণা ও জালিয়াতির অকাট্য তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করার সুযোগ পেয়ে যান। ২০০৪ সালে ড. রাজিন্দর কুমার র‌্যানবেক্সির পরিচালনা পরিষদের সভাপতি ও সায়েন্টিফিক কমিটির সদস্যদের অবহিত করেন, কম্পানি নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে মিথ্যা বলেছে, পরীক্ষা চালানো প্রতিটি দেশে ব্যবসার স্বার্থে তথ্য জাল করেছে। ড. কুমার বলেন, ৪০টি দেশের ২০০ উৎপাদিত ওষুধের ক্ষেত্রে তথ্য জাল করে ব্যবসা চালানো হচ্ছে। এইডস প্রতিরোধে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক ক্রয় করা অ্যান্টিরেট্রোভাইরাল ওষুধগুলোও অনিয়মবহির্ভূত ছিল না। ইউরোপে উৎপাদিত ওষুধের সক্রিয় উপাদান ক্রয় করা হয়েছে অননুমোদিত উৎস থেকে। শেলফ-লাইফ ডাটা জাল করা হয়েছে। বিক্রয়ের জন্য ওষুধ বাদ দিয়ে অন্যান্য ওষুধের ওপর পরীক্ষা চালানো হয়েছে এবং উৎপাদন পদ্ধতিতে অননুমোদিত পরিবর্তন আনা হয়েছে। ব্রাজিল, কেনিয়া, ইথিওপিয়া, উগান্ডা, মিয়ানমার, মিসর, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, পেরু, ডমিনিকান রিপাবলিকসহ অসংখ্য দেশে কম্পানি ঠিকমতো ওষুধ পরীক্ষা করেনি এবং ইচ্ছেমতো তথ্য ও ডাটা জাল করেছে। ড. কুমার এসব দেশের সব ওষুধ বাজার থেকে তুলে এনে যথাযথ পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষ তাঁর প্রস্তাবে সাড়া দেয়নি। ফলে এক সময় ড. কুমারকে র‌্যানবেক্সি থেকে বিদায় নিতে হয়।
২০১৩ সালের ১৩ মে র‌্যানবেক্সি অপরাধ স্বীকার করে ৫০০ মিলিয়ন ডলার জরিমানা পরিশোধে সম্মত হয়।
বহুজাতিক ওষুধ কম্পানির প্রতারণা, দুর্নীতি ও অনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে আপসহীন, সৎ, সাহসী, নিষ্ঠাবান লড়াকু সৈনিক জন ক্যাপকিনস্কি, গ্রেগ থর্প ও ব্লেয়ার হ্যামরিকের অবদানের কথা স্বীকার করে আগে আমি প্রবন্ধ লিখেছি। তাঁদের তালিকায় যোগ করছি আরো দুটি নাম- ড. রাজিন্দর কুমার ও দিনেশ ঠাকুর। আন্তরিক ধন্যবাদ ও অভিনন্দন ড. কুমার ও দিনেশ ঠাকুরকে। কৃতজ্ঞচিত্তে স্বীকার করছি- আপনাদের কারণে বিশ্বের লাখো কোটি মানুষ র‌্যানবেক্সি ফাইজার, মার্ক, গ্ল্যাক্সো-স্মিথক্লাইনের মতো ফার্মাজায়ান্টগুলোর অমানবিক প্রতারণা ও জালিয়াতির হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে। পৃথিবীতে আপনাদের মতো সৎ ও নিষ্ঠাবান মানুষ আছে বলেই আমরা অনেকাংশে ভালো আছি। আর সঙ্গে সঙ্গে অন্যায়, অত্যাচার, প্রতারণা ও জালিয়াতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার অনুপ্রেরণা লাভ করছি আমরাও। আপনাদের নিরাপত্তা, সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করি।
লেখক : অধ্যাপক, ক্লিনিক্যাল ফার্মেসি ও ফার্মাকোলজি বিভাগ, ঢাবি।
profmuniruddin@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.