চারজনে একজনকে সেবা পেতে হয়েছে ঘুষ দিয়ে

বিশ্বে গত এক বছরে প্রতি চারজনে অন্তত একজন কোনো না কোনো প্রাতিষ্ঠানিক কাজের জন্য ঘুষ দিয়েছে। আর গত দুই বছরে দুর্নীতির মাত্রা বেড়েছে বলে বিশ্বাস করে বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি মানুষ।
বার্লিনভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) গতকাল মঙ্গলবার এসব তথ্য জানিয়েছে। 'দ্য গ্লোবাল করাপশন ব্যারোমিটার ২০১৩' শীর্ষক জরিপ প্রতিবেদনে জানানো হয়, প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়েই সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হচ্ছে। জরিপে রাজনৈতিক দলগুলোকে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে চিহ্নিত করেছে উত্তরদাতারা। দুর্নীতি প্রতিরোধে সরকারি প্রচেষ্টার ওপরও মানুষের আস্থা কমছে।
১০৭ দেশের এক লাখ ১৪ হাজার মানুষের ওপর জরিপ চালিয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে টিআই। দুর্নীতি বিষয়ে মতামত নেওয়ার পাশাপাশি কোন কোন প্রতিষ্ঠানকে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত মনে করে, সে ব্যাপারেও প্রশ্ন করা হয় জরিপে অংশগ্রহণকারীদের। উত্তরদাতাদের মূল্যায়নের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠানগুলোকে ১ থেকে ৫-এর মধ্যে পয়েন্ট দেওয়া হয়েছে। ১ বলতে 'একেবারেই দুর্নীতিগ্রস্ত নয়' এবং ৫ বলতে 'চরম দুর্নীতিগ্রস্ত' ধরে নেওয়া হয়েছে।
২৭ শতাংশ উত্তরদাতা জানায়, গত এক বছরে রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা পেতে বা প্রাতিষ্ঠানিক কাজ করিয়ে নিতে ঘুষ দিতে হয়েছে তাদের। জরিপে অংশ নেওয়া দেশগুলোর মধ্যে সিয়েরা লিওনে ঘুষ লেনদেন হয়েছে সবচেয়ে বেশি। দেশটির ৮৪ শতাংশ উত্তরদাতা ঘুষ দেওয়ার কথা জানিয়েছে। জরিপ অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি ঘুষ লেনদেনকারী ৯ দেশের সাতটিই সাবসাহারান আফ্রিকার। ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ায় ঘুষ লেনদেনের পরিমাণ সবচেয়ে কম। তবে প্রতি ১০ উত্তরদাতার ৯ জনই দুর্নীতির বিরুদ্ধে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
৫১টি দেশে উত্তরদাতারা রাজনৈতিক দলকে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে চিহ্নিত করেছে। দুর্নীতির মানদণ্ডে ৩.৮ পেয়েছে রাজনৈতিক দল। এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে টিআই জানায়, 'বিশ্বাস ফিরে পাওয়ার জন্য রাজনীতিবিদদের অনেক কিছু করতে হবে। রাজনীতিবিদদের নিজের ও পরিবারের সম্পদের হিসাব প্রকাশ এবং রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের অর্থের উৎস সম্পর্কে স্বচ্ছতা থাকতে হবে।' রাজনৈতিক দলগুলোর পরেই পুলিশকে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে উল্লেখ করেছে উত্তরদাতারা। ৩৬ দেশে পুলিশকে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত উল্লেখ করা হয়েছে। সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানের তালিকায় তৃতীয় স্থানে যৌথভাবে রয়েছে প্রশাসন, আইন ও বিচার বিভাগ। ২০ দেশের উত্তরদাতারা বিচার বিভাগকে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান মনে করে। জরিপ অনুযায়ী, এসব দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে বিচারকরা ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন এবং জনগণের অধিকারের পরিবর্তে নিজের স্বার্থকেই প্রাধান্য দিচ্ছেন। দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে এগিয়ে থাকা ১২টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সংবাদমাধ্যমের অবস্থান ৯ নম্বরে। ব্রিটেন ও অস্ট্রেলিয়ায় সংবাদমাধ্যমকেই সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান মনে করে সাধারণ মানুষ। সংবাদমাধ্যমের পরেই সামরিক বাহিনীগুলোর অবস্থান। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে অপেক্ষাকৃত কম দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
টিআই জানায়, বিশ্বের বেশির ভাগ দেশেই দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাগুলোর ওপর সাধারণ মানুষের বিশ্বাসের ঘাটতি রয়েছে। ২০০৮ সালে অর্থনৈতিক মন্দা শুরুর পর বিভিন্ন দেশের সরকারগুলোর দুর্নীতি প্রতিরোধের সফলতা কমতে শুরু করেছে। ২০০৮ সালে যেখানে ৩১ শতাংশ মানুষ সরকারের দুর্নীতিবিরোধী প্রচেষ্টাকে যথেষ্ট মনে করত, এখন তা ২২ শতাংশে নেমে এসেছে।
জরিপে বলা হয়েছে, ২০১১ সালে আরব বসন্তের পর মধ্যপ্রাচ্যের বেশির ভাগ দেশেই দুর্নীতি বেড়েছে। অথচ দুর্নীতির প্রতিবাদেই মধ্যপ্রাচ্যের গণ-আন্দোলনের ঢেউ শুরু হয়ছিল। মিসরে ৬৪ শতাংশ, লিবিয়ায় ৪৬ শতাংশ ও তিউনিসিয়ায় ৮০ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছে, গত দুই বছরে তাদের দেশ আরো দুর্নীতিগ্রস্ত হয়েছে। সূত্র : গার্ডিয়ান, বিবিসি।

No comments

Powered by Blogger.