প্রতারিত হয়েছি, মাঠে ফিরে সব বলব by হায়দার আলী ও শরীফ আহ্‌মেদ শামীম

'কথা ছিল, প্রধানমন্ত্রীর কাছে নিয়ে গিয়ে তাঁরা আমার পক্ষে বলবেন। কারণ নির্বাচনের মাঠে আমি যে অনেক এগিয়ে আছি, সেটা তাঁরা জরিপ করে জেনেছেন। কিন্তু নেত্রীর কাছে গিয়ে তাঁরা আর মুখ খোলেননি। আমি আওয়ামী লীগের রাজনীতি করি।
নেত্রী শেখ হাসিনা আমাদের অভিভাবক। আমার কাছে তিনি মায়ের মতো। তিনি যখন আমাকে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর আদেশ দিয়েছেন, সেই আদেশ আমি উপেক্ষা করতে পারিনি। তবে সাবেক ছাত্রলীগ নেতারা, যাঁরা আমার খুবই ঘনিষ্ঠ, তাঁরা আমাকে মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। আমি সুস্থ হয়ে গাজীপুরে ফিরে আমার কর্মী-সমর্থকদের কাছে সব বলব।'
গতকাল শনিবার দুপুরে রাজধানীর একটি আধুনিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় কালের কণ্ঠকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে কথাগুলো বলেন গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বহুল আলোচিত বিদ্রোহী প্রার্থী সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মো. জাহাঙ্গীর আলম। গত ১৮ জুন আদালতের রায়ে নির্বাচনী প্রতীক পেয়ে প্রচারণা শুরু করেন তিনি। ওই দিনই কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে টঙ্গী এলাকায় গণসংযোগ চালানোর একপর্যায়ে ছাত্রলীগের সাবেক কয়েকজন নেতা তাঁকে ডেকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে ঢাকায় রওনা হন। এরপর থেকেই তাঁর সঙ্গে কর্মী-সমর্থক ও পরিবারের লোকজনের সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। ওই দিন রাত ১১টার দিকে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচার করা হয়, তিনি মহাজোট সমর্থিত প্রার্থী আজমত উল্লা খানকে সমর্থন জানিয়ে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। তার পর থেকেই তিনি একরকম নিখোঁজ। তাঁর খোঁজ না পেয়ে গাজীপুরে তাঁর কর্মী-সমর্থকরা উদ্বিগ্ন ও হতাশ হয়ে পড়েন। তবু তাঁরা জাহাঙ্গীরের পক্ষে মাঠ চষে বেড়ান। এ পরিস্থিতিতে জাহাঙ্গীর হয়ে ওঠেন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। কিন্তু তাঁর কোনো খোঁজ না পেয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে তাঁকে নিয়ে দিন দিন কৌতূহল বাড়তে থাকে। এই অবস্থায় কালের কণ্ঠ নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যায় জাহাঙ্গীরের সাক্ষাৎ পেতে। অবশেষে গতকাল তাঁর এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের মাধ্যমে সেটা সম্ভব হয়। রাজধানীর এক হাসপাতালের বেডে শুয়ে জাহাঙ্গীর সাক্ষাৎকার দেন কালের কণ্ঠকে।
১৮ জুন প্রধানমন্ত্রীর কাছে যাওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জাহাঙ্গীর আলম বলেন, 'সেই দিন রাতে টঙ্গীতে গণসংযোগের একপর্যায়ে ক্লান্ত হয়ে পড়লে একজন সমর্থকের বাসায় বিশ্রাম নিই। এ সময় সাবেক ছাত্রলীগ সভাপতি লিয়াকত সিকদার, সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম বাবু, সহসভাপতি রফিক কোতোয়ালসহ আরো কয়েকজন বড় ভাই আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেন। আলাপ-আলোচনার পর তাঁরা বলেন, পর্যবেক্ষণ ও ভোটারদের মতামত যাচাই করে পরিস্থিতি আমার অনুকূলে বলে তাঁরা জেনেছেন। আমাকে সমর্থন না দেওয়ায় দলের ভুল হয়েছে। এসব কথা তুলে ধরে আমাকে সমর্থন জানানোর অনুরোধ করতে তাঁরা আমাকে প্রধানমন্ত্রীর কাছে নিয়ে যান। কিন্তু তাঁরা সে কথা রাখেননি।'
জাহাঙ্গীর বলেন, 'নেত্রী যখন আমাকে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর কথা বলেন, তখন আমি নেত্রীকে বলেছি, তিন বছর কাজ করে মাঠ গুছিয়েছি। বিপদে-আপদে নেতা-কর্মীদের পাশে দাঁড়িয়েছি। তাদের আধুনিক ও মডেল নগর গড়ার স্বপ্ন দেখিয়েছি। এখন কিভাবে সরে যাব? মানুষ আমাকে ভুল বুঝবে। আমি আমার মায়ের প্রেরণায় এত দূর এসেছি জানিয়ে নেত্রীকে আমার মায়ের সঙ্গে কথা বলার অনুরোধ করি। প্রধানমন্ত্রী আমার মায়ের সঙ্গেও মোবাইল ফোনে অনেকক্ষণ কথা বলেন। পরে আমাকে দোয়া করে বলেছেন, তোমার দায়িত্ব আমি নিলাম।'
জাহাঙ্গীর বলেন, 'নেত্রী আমার মায়ের মতো। তিনি দলের প্রধান ও দেশের প্রধানমন্ত্রী। তাঁকে আমি অসম্মান করতে পারিনি।'
অসুস্থ জাহাঙ্গীর হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে বলেন, 'আমার নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পেছনে বড় প্রেরণা ছিল আমার মায়ের। গত দুই বছরে তিনি প্রতিদিন অসংখ্য কর্মী-সমর্থককে রান্না করে খাইয়েছেন। কোনোদিন ক্লান্ত বোধ করেননি। লটারিতে আনারস প্রতীক পেয়ে প্রথম খবরটি মাকেই জানাই। মা-ই আমার কাছে সব। আমার প্রার্থিতা থেকে সরে দাঁড়ানোর কথা শুনে মা অসুস্থ হয়ে পড়েন। রাতেই তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তার পর থেকেই মায়ের কাছে আছি। তাঁর সেবা করছিলাম। কিন্তু ক্লান্তি আর অনিদ্রায় অসুস্থ হয়ে আমি নিজেও এখন চিকিৎসাধীন।'
এলাকায় কবে যাচ্ছেন, জানতে চাইলে আলোচিত এই নেতা বলেন, 'মা আস্তে আস্তে সেরে উঠছেন। আমিও দুর্বল হয়ে পড়েছি। সেরে উঠলে দু-এক দিনের মধ্যেই এলাকায় যাব। আমার কর্মী-সমর্থকরাই আমার প্রাণ। তাদের ভালোবাসায়ই আজ এখানে আসতে পেরেছি। তাদের উদ্দেশে অনেক কিছু বলার আছে আমার। যা বলার, তাদের সামনে গিয়েই বলব।'
আপনাকে নিয়ে এসব ঘটনার পেছনে আজমত উল্লা খানের হাত রয়েছে- এমনটাই মনে করছেন আপনার সমর্থকরা। আপনি যদি তাঁর পক্ষে ভোট চান, তাঁরা কি ভোট দেবেন, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'মাঠে গিয়ে মানুষের মন পাব কি না জানি না; আমি মাঠে গেলে তারা হয়তো আমার সামনে আসবে, কথা বলবে, জড়িয়ে ধরবে। কিন্তু আমার কথায় উনাকে ভোট দিবে কি না, নিশ্চিত করে বলতে পারছি না।'
সাক্ষাৎকারে জাহাঙ্গীর আরো বলেন, 'প্রার্থী হওয়ার আগে দুই বছরে অনেকবার গাজীপুরে প্রত্যেক সংসদ সদস্যের কাছে গিয়ে মেয়র নির্বাচন করার কথা বলেছি, দোয়া চেয়েছি। সে সময় কেউ আমাকে নিষেধ করেননি। উল্টো আমাকে উৎসাহিত করেছেন। এমনকি আজমত ভাইয়ের কাছে সাতবার গিয়েছি এবং মনের ইচ্ছার কথা জানিয়েছিলাম। তিনিও আমাকে নিষেধ করেননি। বরং বলেছেন, গণতান্ত্রিক দেশ, যে কেউ নির্বাচন করতে পারে, তুমিও নির্বাচন করো, আমার কোনো আপত্তি নাই। সব জায়গা থেকে অনুমতি পেয়ে আমি হজে গিয়ে আল্লাহর ঘর ছুঁয়ে শপথ নিই নির্বাচন করার।'
এখন যদি প্রধানমন্ত্রী গাজীপুর নগরের বর্তমান অবস্থা দেখে আপনাকে নির্বাচন করার সুযোগ দেন, তাহলে কী করবেন, জানতে চাইলে জাহাঙ্গীর বলেন, 'নিরপেক্ষ জরিপ করিয়ে আমার নেত্রী মাঠের বর্তমান অবস্থা বিবেচনা করে যদি আমাকে নির্বাচন করার সুযোগ দেন, তাহলে বিজয়ী হয়ে গাজীপুর সিটি নেত্রীকে উপহার দিতাম। কারণ গাজীপুরের দলমত নির্বিশেষে মানুষ আমাকে সমর্থন দিয়েছে। আমি গাজীপুর সিটি করপোরেশন বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়ক থেকে নগরের অলিগলিতে ঘুরেছি, মাঠ গুছিয়েছি। নির্বাচন করব ভেবে চীন, হংকং, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া ঘুরে সেসব দেশের সিটি করপোরেশনের মাস্টারপ্ল্যান সংগ্রহ করেছি। সেগুলোর সমন্বয় করে গাজীপুর সিটিকে সাজানোর পরিকল্পনা করেছিলাম। কিন্তু মায়ের নির্দেশ যেমন উপেক্ষা করতে পারিনি, তেমনই নেত্রীও আমার মায়ের মতো, তাই তাঁর নির্দেশও উপেক্ষা করতে পারিনি।'
গাজীপুরবাসীর উদ্দেশে জাহাঙ্গীর বলেন, 'এই মুহূর্তে আমার অসুস্থ মায়ের পাশে পরিবারের সবাই ব্যস্ত আছে এবং আমি নিজেও অসুস্থ। আমাদের জন্য দোয়া করবেন যেন আমার মা এবং আমি সুস্থ হয়ে আপনাদের সামনে আসতে পারি।'
মোবাইল ফোন বন্ধ রাখেন কেন, কোথায় আছেন, কেমন আছেন, সেই দিন কী ঘটেছিল এসব কর্মী-সমর্থকদের কেন জানাচ্ছেন না- এ প্রশ্ন করলে জাহাঙ্গীর বলেন, 'মা ও আমি সুস্থ হয়ে উঠলে গাজীপুর গিয়ে সব কিছু বলব, সব খুলে বলব।'

No comments

Powered by Blogger.