চারপাশে আলো, মধ্যে অন্ধকার by আব্দুল কুদ্দুস

পাহাড়ঘেরা গর্জনিয়া ইউনিয়ন। ২৪ দশমিক ৮৮ বর্গমাইলের এ জনপদে ৩৩ হাজার মানুষের বসবাস। কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগে এখনো বিদ্যুৎবিহীন কক্সবাজার জেলার এই ইউনিয়নটি। স্বাধীনতার পর থেকে বারে বারে ধরনা দিয়েও কোনো কাজ হয়নি।
সন্ধ্যা হলেই অন্ধকারে ডুবে যায় পুরো জনপদ। অথচ চারপাশের ঈদগড়-বাইশারী, কচ্ছপিয়া, দৌছড়ি, জোয়ারিয়ানালা ও কাউয়ারখোপ ইউনিয়ন বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত। শুধু মাঝখানে অন্ধকার।
সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা গেছে, পাহাড়, নদী আর সবুজ গাছপালায় ভরপুর নির্জন গর্জনিয়ার অযত্ন আর অবহেলার ছাপ। হাটবাজারে পানির দরে বিক্রি হচ্ছে গাছের ফলমূল, খেতের শাকসবজি ও তরিতরকারি। পুরো ইউনিয়নে ছয় কিলোমিটারের একটি ইটের রাস্তা। বাকি ৭৫ কিলোমিটার রাস্তাই কাঁচা। ইউনিয়নে চার হাজার ৪০০ পরিবারের বাস। জীবিকার প্রধান উৎস কৃষি।
বোয়াংখিল গ্রামে স্থাপিত দ্বিতল বিশিষ্ট গর্জনিয়া ইউনিয়ন পরিষদ ভবনে গিয়ে দেখা যায়, বিদ্যুৎ না থাকায় ভবনের ভেতর অন্ধকার। ছোট্ট সোলার প্যানেল বসিয়ে লোকজনকে কোনো রকমে তথ্যসেবা দেওয়া হচ্ছে। বিদ্যুতের অভাবে ব্যাহত হচ্ছে একটি উপস্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও তিনটি কমিউনিটি ক্লিনিকে চিকিৎসাসেবা। ইউনিয়নের মাদ্রাসাবাজার, টাইমবাজার, থিমছড়িবাজার, বেলতলীবাজার ও বটতলাবাজারেও বেহাল দশা। বাজারে ডিজেল চালিত কয়েকটি চালের কলে চাষিরা ধান চিড়াই করছেন চড়া দামে।
ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান তৈয়ুব উল্লাহ চৌধুরী বলেন, পুরো ইউনিয়নের কোথাও বিদ্যুৎ নাই। তবে ধনী লোকজন ঘরবাড়িতে সোলার প্যানেল বসিয়ে বিদ্যুতের জরুরি চাহিদা মেটাচ্ছেন। সর্বশেষ ২০১২ সালের ১০ মে তিনি গর্জনিয়ায় বিদুৎ লাইন সম্প্রসারণের জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরে তাগাদাপত্র পাঠান।
ওই পত্রে চেয়ারম্যান উল্লেখ করেন, বিদ্যুৎ লাইন সম্প্রসারিত হলে গর্জনিয়ার চাষের জমি ৮১৫ হেক্টর থেকে ২০০০ হেক্টরে উন্নীত হবে। শিক্ষার হার ৩০ থেকে বেড়ে ৮০ শতাংশ হবে। মানুষ স্বাস্থ্যসেবা পাবে। অর্থনীতির চাকা ঘুরে ৩৩ গ্রামে স্থাপিত হবে ছোট-বড় অসংখ্য কুটিরশিল্প, মৎস্য, মুরগি ও গবাদিপশুর খামার।
থিমছড়ি গ্রামের গৃহবধূ নুর জাহান (৪৫) ও কৃষক সৈয়দ আমিন (৭০) জানান, জন্মের পর থেকে তাঁরা বিদ্যুৎ দেখেননি। সন্ধ্যার পর অন্য ইউনিয়ন গুলোতে যখন বিদ্যুত জ্বলে ওঠে-তখন কষ্ট আরও বেড়ে যায়। গর্জনিয়া উচ্চবিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র কেফায়েত উল্লাহ জানায়, বিদ্যুৎ না থাকায় তারা কম্পিউটারসহ তথ্যপ্রযুক্তির নানা পাঠ নিতে পারছে না।
রামু উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান সোহেল সরওয়ার বলেন, গর্জনিয়ায় বিদ্যুৎ লাইন পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি নাকি বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিউবো) নিয়ে যাবে? এ নিয়ে রশি টানাটানিতে অনেক সময় চলে গেছে। এখন পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি জানিয়ে দিয়েছে-তারা গর্জনিয়ায় বিদ্যুৎ লাইন টানাবে না। এখন অন্য পথে লাইন টানার কাজ চলছে। স্থানীয় বিএনপি দলীয় সাংসদ লুৎফুর রহমান জানান, তিনি সাংসদ নির্বাচিত হওয়ার পর গর্জনিয়ায় বিদ্যুৎ লাইন সম্প্রসারণের জন্য বিউবোর চেয়ারম্যান বরাবরে চাহিদাপত্র (ডিও) প্রেরণ করেন। এরপর বিউবো সরেজমিন জরিপ চালিয়ে একটি প্রকল্প গ্রহণ করেন। কিন্তু গর্জনিয়ার বেশির ভাগ মানুষ বিএনপি সমর্থক বলে বিদ্যুৎ পাচ্ছে না। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০০৯ সালের ১১ অক্টোবর চাহিদাপত্র পাঠানোর পর গর্জনিয়া সফর শেষে একই বছরের (২০০৯ সালের) ১ জানুয়ারি সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের সচিব ইকবাল মাহমুদ জরুরি ভিত্তিতে গর্জনিয়ায় বিদ্যুৎ লাইন সম্প্রসারণের জন্য বিউবো চেয়ারম্যানকে চিঠি দেন। এরপর ২০০৯ সালে গর্জনিয়া বিদ্যুৎ লাইন সম্প্রসারণের জন্য রামু বিউবো একটি জরিপ প্রকল্প তৈরি করে। একই বছরের ৩১ ডিসেম্বর প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য ঊর্ধ্বতন মহলে পাঠানো হয়। তাতে ১১ কেভির ১৪ কিলোমিটার এবং ০ দশমিক ৪ কেভির ১৩ কিলোমিটার বিদ্যুৎ লাইন সম্প্রসারণ এবং ১০০ ও ২০০ কেভিএ ১১টি উপকেন্দ্র স্থাপনে দুই কোটি ৮১ লাখ ৪৮ হাজার ২৩০ টাকার ব্যয় ধরা হয়।
জানতে চাইলে বিউবো কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সামছুল আলম বলেন, আরবান প্রকল্পের মাধ্যমে গর্জনিয়া ইউনিয়নে বিদ্যুৎ লাইন সম্প্রসারণের চেষ্টা করা হয়েছিল।
কিন্তু আরবান প্রকল্প শহর ও উপশহরে বিদ্যুতায়নের কাজ করে বলে এতদিন তা সম্ভব হয়নি। এখন বিউবোর রাজস্ব খাতে প্রকল্পটি অন্তর্ভুক্ত করে গর্জনিয়ায় বিদ্যুৎ লাইন টানার চেষ্টা চলছে। আগামী অর্থবছরে এর কাজ শুরু হতে পারে।

No comments

Powered by Blogger.