সদরে অন্দরে-যন্ত্রণার ডেমু ও রেলওয়ের দুর্গতি by মোস্তফা হোসেইন

অনেক নামডাক তাঁর। শিক্ষক হিসেবেও জুরি নেই। সব মা-বাবা চান তাঁদের ছেলে যেন ওই হুজুরের কাছ থেকেই শিক্ষাজীবন শুরু করে। তো সেই হুজুরের ঘরে ছিল দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী। ছিল মা মরা একটি সন্তানও।
হুজুর মক্তবে সফল হলেও ঘরটা ছিল অগোছালো। সৎমা ছেলেকে দেখতে পারত না। ছেলেটাও ছিল দুষ্টের শিরোমণি। তার পরও হুজুরের কাছে সবাই ছেলেদের পাঠাত প্রাথমিক শিক্ষা নেওয়ার জন্য। হুজুরকে সবাই জানত ভালো মানুষ হিসেবে।
এক কৃষক তাঁর ছেলেকে হুজুরের সেই মক্তবে পাঠালেন। এক দিন-দুই দিন এমনি করে কয়েক মাস হয়েছে ছেলের মক্তবে ভর্তির বয়স। কৃষক বাবা একদিন ছেলের খবর নিতে গেলেন। কিন্তু ছেলে কই? বাসায় ফিরে বকাঝকা করলেন ছেলেকে। এমনি করে বকা দেওয়াটা নিত্যঘটনা হয়ে গেল। একদিন দেখা গেল, দুষ্ট ছেলেটা আর বাড়ি ফিরছে না। কী ব্যাপার? খোঁজ খোঁজ। কোথাও নেই ছেলে তাঁর। গেলেন হুজুরের কাছে। জিজ্ঞেস করলেন, ছেলে কোথায়? হুজুর আর কী বলবেন। কৃষকের দিকে তাকিয়ে রইলেন তিনি। বললেন, আপনি তো আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার ছেলের কথা। আমি জিজ্ঞেস করব কাকে? কৃষককে তাকিয়ে থাকতে দেখে হুজুর বললেন, ভাইজান, আপনার ছেলের সঙ্গে আমারটাও কেটে পড়েছে। কৃষক বাবা হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরলেন। বলতে থাকলেন, 'বালা পোলা নষ্ট করলাম মিয়াজীর কাছে দিয়া'। গল্পের উপসংহার এটা। নারায়ণগঞ্জবাসী রেলযাত্রীদের এখন সেই অবস্থা। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা ১৩ জোড়া ট্রেন বাতিল হলেও তারা আফসোস করল না। কারণ তাদের সামনে ইউরোপ-আমেরিকায় চলা ট্রেনের চেহারা। নাম ডেমু। প্রচণ্ড গতিতে চলে। নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকা যেতে সময় লাগবে মাত্র কুড়ি মিনিট। সেও রাস্তা খারাপ বলে। তা না হলে ১০-১৫ মিনিটেই যেতে পারত। এমন আশ্বাস পেলে কি আর অখুশি হওয়ার কথা। তারা খুবই আশ্বস্ত হয়েছিল সরকারি প্রতিশ্রুতি পেয়ে। তারা বিশ্বাস করেছিল, সত্যিই বুঝি নারায়ণগঞ্জের রেলযাত্রীদের ভাগ্যোন্নয়নে কিছু করতে যাচ্ছে সরকার। কিন্তু সরকার তাদের সুবোধ বালক উপহার দেওয়ার মতো তুলে দিয়েছে রং চকচকে ডেমু। পুরনো আমলের রেলগুলো না হয় বাতিল হয়ে গেছে কয়েকটি। তাতে কী। হায় হায়! মিথ্যা সবই। হুজুরের ছেলের হাত ধরে কৃষকের ছেলে উধাও হওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে। রেলযাত্রীরা এখন সেই ডেমুতে চড়ে ঘামে জবজবে হয়। ঘামতে ঘামতে ঘরে ফেরে আর ভাবে, এমন ইউরোপ-আমেরিকা মার্কা ডেমু ট্রেন যে আমাদের দুনিয়াতেই নরকের স্বাদ পাইয়ে দিল। এই নরক থেকে কি উদ্ধার পাওয়া যাবে না?
অথচ দুই বছর আগে থেকেই ঢাকঢোল পেটানো হয়েছিল ডেমু ট্রেনের গুণকীর্তন গেয়ে। আধুনিক বিশ্বের ট্রেনের মতো দেখতে এই ডেমুতে চড়তে গিয়ে প্রথমেই বাধা পেল যাত্রীরা। দরজা দিয়ে গাড়িতে চড়তে পা উঁচু করতে হয় আগের চেয়ে আরো ছয় ইঞ্চি বেশি। পা উঁচিয়ে কোনোমতে ঠেলেঠুলে ভেতরে ঢুকতেই দেখে নরকের চুল্লি জ্বলছে গাড়ির ভেতর। মাত্র ৩০০ যাত্রী ধারণক্ষমতা ট্রেনগুলোর (পরে চার বগি দিয়ে দ্বিগুণ ধারণক্ষমতা করা হয়েছে)। সুতরাং অর্ধেক যাত্রীকেই পা গুটিয়ে নিতে হয়, ঢাকা যেতে গিয়ে। দিনের শেষে দেখা গেল আগে যেখানে ৪০ হাজার যাত্রী টানত লক্কড় মার্কা ট্রেনগুলো, সেখানে চকচকে ট্রেন টানছে অর্ধেকের কিছু বেশি। মাত্র ১৮ কিলোমিটার দূরত্বের পথ পাড়ি দিতে ৪০ মিনিটেরও বেশি সময় ব্যয় করতে হচ্ছে এই ট্রেনকে। তাহলে ঘণ্টায় ৯০ কিলোমিটার যাওয়ার স্বপ্ন কোথায় গেল? কর্তৃপক্ষ বলছে, আমরা কী করব, রেলের জায়গা দখল করে রেখেছে ফেরিওয়ালা ও বস্তিগুলো। সেখানে ডেমুর গতি থাকবে কোথায়। প্রশ্ন হলো ডেমু যখন ডামি পর্যায়ে ছিল অর্থাৎ ডেমু আমদানির পরিকল্পনা হচ্ছিল তখন কি এই বস্তিগুলো সেখানে ছিল না? নাকি বস্তি ও হকার উচ্ছেদ করার পরিকল্পনাও ছিল ডেমু ট্রেন কেনার পরিকল্পনাকালে?
সেই চিন্তা মাথায় না আসার কারণ নেই। বস্তিগুলো হঠাৎ করে হয়নি। আর রেলপথের অবকাঠামোগত অসুবিধাগুলোও নতুন নয়। তবে কর্মকর্তাদের চার মাসের চীনপ্রবাসে রেখে মগজ ধোলাই করে দেওয়া হয়েছে, এই অভিযোগের উত্তর পায়নি কেউ। ডেমু চালানোর কলাকৌশল, এর সুবিধা-অসুবিধা দেখার জন্য আট কর্তার চার মাসের চীনপ্রবাস কাটানোর পর তাঁরা সব ভুলে গিয়ে ডেমু আমদানি পাকাপোক্ত করে ফেলেন। এই আটজনই নয়। তার আগে-পরেও গেছেন বেশ কয়েকজন। চীনে ডেমু চলা দেখে এসে রিপোর্ট দিয়েছেন বাংলাদেশের রেললাইনকে চীনের রেললাইনের মতো চিন্তা করে। সুতরাং এখন না হয় কিছুটা অসুবিধা হলোই। ১৬ টাকার টিকিটে চড়ে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ আসা-যাওয়ার সুযোগ দিতে পেরেই যেন তাঁদের বড় তৃপ্তি। কিন্তু ১০ টাকায় যে সেবা পাওয়া যেত সেটুকুও কি ১৬ টাকায় পাওয়া যাবে না? এই প্রশ্নের জবাব কে দেবে?
ব্যাপক কারচুপির অদৃশ্য খেলা যে ডেমুতে চড়েছে তা বোঝা যায় এর পেছনে তাকালে। শীতপ্রধান দেশের জন্য প্রযোজ্য এমন ডেমু কেন উষ্ণ বাংলাদেশে আমদানি হলো? সাধারণ ট্রেন চালানোর লাইনে কোন যুক্তিতে অস্বাভাবিক নকশায় তৈরি এই ট্রেন ছাড়া হলো? আমদানীকৃত ২০ সেট ডেমুর মূল্য ৪২৬ কোটি টাকা। অথচ একই টাকা ব্যয় করে ১০০ কোচ এবং চারটি শক্তিশালী ইঞ্জিন কেনা যেত অনায়াসে। যাত্রী বহনক্ষমতা কতগুণ বৃদ্ধি পেত তা কি একবার ভেবে দেখেছেন কেউ? এসব বাদ দিয়ে কম যাত্রী ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন এবং বাংলাদেশের আবহাওয়া ও অবকাঠামোগত অবস্থায় অপ্রযোজ্য হওয়ার পরও কেন এই ডেমু মাথায় চেপে বসে বাংলাদেশের রেলওয়ে বিভাগের? জবাব কি শুধু চার মাস চীনে বেরিয়ে আসা কর্তারাই দেবেন, নাকি এর পেছনে আরো কোনো হুজুরপত্নী আছেন সেটাও বের করে আনতে হবে।
রেলওয়ের প্রতি এই বৈমাত্রেয় ভাব নতুন কোনো বিষয় নয়। স্বাধীন বাংলাদেশে এই খাতকে গলা টিপে হত্যা করছে সরকার ও রেলকর্মীরা। লুটের মাল হিসেবে দেখতে চায় সবাই। যে যেভাবে পারে দখলের রাজত্ব কায়েম করে। প্রায় তিন হাজার কিলোমিটার রাস্তায় চলা ট্রেনে বাংলাদেশের মোট যাত্রীর মাত্র ৭ শতাংশ চলাচলের সুবিধা পায় কোন কারণে? প্রায় সমান পরিমাণ বড় পাকা রাস্তা আছে বাংলাদেশে। নৌ, বিমান আর সড়কপথ দিয়ে চলে বাকি যাত্রী। অথচ একটু নজর দিলে রেলওয়ে হতে পারত বিশাল সহযোগী প্রতিষ্ঠান। দুর্নীতি আর স্বচ্ছতা আনলেই তা সম্ভব। কেউ কি নতুন করে ভাবতে চান? একটু ভাবুন না রেলকে নিয়ে।
রেলযাত্রীদের এই অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে নারায়ণগঞ্জের মানুষের মুখ থেকে। এখন তারা হিসাব কষতে শুরু করেছে, পুরনো গাড়ি হাতছাড়া করে আম-ছালা দুই-ই যে হারিয়েছে। ইউরোপ-আমেরিকার রঙিন চকচকে ট্রেনের মতো সুদৃশ্য ট্রেন দেখে উল্লসিত যাত্রীরা এখন বলতে শুরু করেছে, আগের সেই মুড়ির টিনমার্কা ট্রেনই যে অনেক ভালো ছিল। ডেমু নামের হুজুরপুত্র যে নিজের পোলাকেই ভাগিয়ে নিয়ে গেছে।
mhussain_71@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.