মাতৃভাষায় শিৰা পাবে আদিবাসী শিশুরা, পাহাড়ে আনন্দ- জাতীয় কারিকুলামে অনত্মভর্ুক্তি দাবি

ওমর ফারম্নক শামীম, খাগড়াছড়ি মাতৃভাষায় শিৰালাভের সুযোগবঞ্চিত পাহাড়ের আদিবাসী শিশুরা প্রারম্ভিক শিৰাতেই পিছিয়ে রয়েছে। চাপিয়ে দেয়া ভাষাগত সমস্যার কারণে প্রাইমারী পযর্ায়ে অধিকাংশ আদিবাসী শিশু ঝরে পড়ছে।
তবে দেরিতে হলেও শানত্মি চুক্তি সম্পাদনকারী বর্তমান সরকার জাতীয় শিৰানীতিতে আদিবাসী শিশুদের মাতৃভাষায় শিৰা কার্যক্রম অনত্মর্ভুক্ত করায় খুশি পাহাড়ের আদিবাসীরা। পার্বত্য শানত্মি চুক্তির একযুগ পরে হলেও বাংলা ভাষার পাশাপাশি মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিৰা ব্যবস্থা চালুর উদ্যোগে সরকারের প্রশংসা করছেন পাহাড়বাসী সচেতন মানুষ। পাশাপাশি পাহাড়ের আদিবাসীরা অবিলম্বে মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিৰা কার্যক্রম চালু করতে জাতীয় শিৰা কারিকুলামে অনত্মভর্ুক্ত করতে জোর দাবি জানিয়েছেন।
উলেস্নখ্য, ১৯৮৯ সালে স্থানীয় সরকার আইন, ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শানত্মি চুক্তি কিংবা আইএলও কনভেনশন- কোনটাই আদিবাসী শিশুদের মুখে ফোটাতে পারেনি স্বকীয় বর্ণমালায় মাতৃভাষার বুলি। পার্বত্য চট্টগ্রাম শানত্মি চুক্তিতে প্রাইমারী সত্মরে মাতৃভাষায পাঠদান, পাঠ্যপুসত্মক প্রণয়ন এমনকি শিৰক নিয়োগের বিধান করা হলেও বাসত্মবায়নের কোন উদ্যোগ নেই এখন পর্যনত্ম। এ বিষয়ে অগ্রগতি বলতে শানত্মি চুক্তির এক যুগ পর বর্তমান সরকারের জাতীয় শিৰানীতিতে অনত্মর্ভুক্তিই মাত্র।
পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের ১৩টি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর শিশুরা প্রতিদিনই ভাষার সঙ্গে যুদ্ধ করে লেখাপড়া চালিয়ে আসছে। বাড়িতে একভাষায় কথা বললেও স্কুলে এসেই বাধার মুখোমুখি হতে হয় এ সকল আদিবাসী শিশুদের। কাসে একেবারে নতুন পরিবেশে বাংলা ভাষায় লেখাপড়া করতে বাধ্য করেন শিৰকরা। ফলে তাদের পৰে ভাল ফলাফল করা কঠিন হয়ে পড়ে।
জেলা সদরের দুর্গম এলাকার দেবেন্দ্রপাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৫ম শ্রেণীর ছাত্রী অঞ্জলিকা ত্রিপুরা তেমনই একজন। বাড়িতে নিজের ভাষায় কথা বলে স্কুলে এসে ভিন্নভাষায় পড়ালেখা করতে কষ্ট হচ্ছে। সে বলেছে, তাদেরকে মাতৃভাষায় লেখাপড়া করালে সহজ হতো।
পাহাড়ী শিৰকদের পাশাপাশি বাঙালী শিৰকরাও বলছেন, আদিবাসী শিৰাথর্ীদের লেখাপড়া করাতে গিয়ে তাদেরকে নানামুখী সঙ্কটের মুখোমুখি হতে হয়। প্রাইমারী শিৰিকা বিজুবালা দেবী জানান, আদিবাসী শিশুদের পড়ালে, বাংলা বোঝে না, তাই কাসের প্রতি অনীহা এসব শিশুদের। পড়াতে গিয়ে তাদের উপলব্ধি হলো সরকারী উদ্যোগে আদিবাসী শিশুদের মাতৃভাষায় পঠন-পাঠনের ব্যবস্থা করা হলে ভবিষ্যতের জন্য ভাল হতো। তবে দেরিতে হলেও সেভ দ্য চিলড্রেন এবং ইউএনডিপির সহযোগিতায় স্থানীয় একটি প্রতিষ্ঠান জাবারাং কল্যাণ সমিতি এনিয়ে কাজ করেছে ২০০৭ সাল থেকে। বহুভাষিক শিৰার ওপর কাজ করা গিতিকা ত্রিপুরা জানান, প্রাইমারী স্কুলে ভর্তি হওয়ার প্রাথমিক প্রস্তুতি হিসেবে দু বছরব্যাপী প্রি প্রাইমারীতে শিখানো হবে। প্রথম বছর মাতৃভাষায় ও পরের বছর মাতৃভাষার পাশাপাশি বাংলা- ইংরেজি ভাষায় লেখাপড়া করানো হয়। এ সকল প্রি-প্রাইমারীতে মূলত নিজস্ব বর্ণমালায় আশপাশের পরিবেশ-পরিচিতি সম্পর্কে ধারণা দেয়ার চেষ্টা চলে।
মাতৃভাষাভিত্তিক খুমতাই অংকুর প্রি স্কুলের কয়েক শিশু শিৰাথর্ী তাদের অনুভূতি প্রকাশ করে বলেছে, নিজের ভাষায় লেখাপড়া করতে ভাল লাগে। স্কুলটির শিৰিকা উপালী ত্রিপুরা জানান, তার শিশু শিৰাথর্ীদের বোঝাতে তেমন কষ্ট পোহাতে হয় না। খাগড়াছড়িতে মাতৃভাষা নিয়ে কাজ করা এনজিও জাবারাং কল্যাণ সমিতির, নির্বাহী পরিচালক ও আদিবাসী বিষয়ক গবেষক মথুরা ত্রিপুরা বলেন, জাতীয় শিৰানীতিতে আদিবাসী শিশুদের শিৰা কার্যক্রমের বিষয়টি অনত্মর্ভুক্ত হয়েছে, এজন্য সরকারের প্রশংসা করি, তবে শিৰা কারিকুলামে অনত্মর্ভুক্ত করে দ্রম্নত বাসত্মবায়ন হলে আদিবাসী শিশুদের শিৰা কার্যক্রমের যথেষ্ট উন্নতি হবে। সেভ দ্য চিলড্রেনের সহায়তায় তারা ২০০৭ সালের শুরম্নতে আদিবাসী জনপদে চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা সমপ্রদায়ের স্ব স্ব ভাষায় (বর্ণমালায়) পাঠদান কার্যক্রমের সূচনা করেন। এরপর এই সহযোগিতায় এগিয়ে আসে ইউএনডিপি। জেলার ৩টি উপজেলায় ৬০টি মাতৃভাষাভিত্তিক প্রি-প্রাইমারী স্কুল চালু করেছে। চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা আদিবাসী সমপ্রদায়ের ভাষায় এসব স্কুলে পাঠদান করা হচ্ছে। তিনি মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিৰা কার্যক্রম জাতীয কারিকুলামে অনত্মর্ভুক্তির আহবান জানান।
সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুযায়ী মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিৰা ব্যবস্থা সরকারী উদ্যোগেই চালু করা দরকার বলে মনে করে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান পার্বত্য জেলা পরিষদ। খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান রম্নইথি কার্বারী বলেন, এ লৰ্যে পার্বত্য জেলা পরিষদের ব্যবস্থাপনায় এ জেলায় ৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আদিবাসী ভাষায় প্রি প্রাইমারী শিৰা কার্যক্রম শুরম্ন করা হয়েছে। এই শিৰা কার্যক্রমের জন্য তিন লাখ টাকা বরাদ্দ রাখলেও আগামী বছর থেকে মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিৰার উন্নয়নে আরও বেশি বরাদ্দ করবেন। তবে তিনি এ বিষয়টি জাতীয় কারিকুলামে অনত্মর্ভুক্তির উপর গুরম্নত্বারোপ করেছেন।
অধ্যাপক মধু মঙ্গল চাকমা, শিৰাবিদ অননত্ম বিহারী খীসা বলেন, আমরা মনে করি মাতৃভাষা মানবাধিকার। তাই নিজের ভাষায় লেখাপড়া শেখার অধিকার প্রতিষ্ঠায় সরকারী উদ্যোগেই সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিৰা প্রবর্তন করা উচিত। আদিবাসীদের বর্ণমালা, ভাষা, সংস্কৃতি সংরৰণ ও বিকাশে মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিৰা চালুর কোন বিকল্প নেই।

No comments

Powered by Blogger.