সাক্ষাৎকার-নগর বাঁচাতে নদীর পানিই ভরসা by সুস্মিতা সেনগুপ্ত

সাক্ষাৎকার গ্রহণ : শেখ রোকন সমকাল : আমরা জানি, আপনার প্রতিষ্ঠান নগর পর্যায়ে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে। এ সম্পর্কে জানতে চাই। সুস্মিতা সেনগুপ্ত : সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট (সিএসই) বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ব্যাপারে কাজ শুরু করে সেই আশির দশকে।


আমরা তখন দেখছিলাম, মূলত ভূগর্ভস্থ পানি এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভূউপরিভাগের জলাশয় বা সারফেস ওয়াটারের ওপর নির্ভর করে পানি ব্যবস্থাপনার অভিমুখ তৈরি হচ্ছে। বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ও ব্যবহারের বিষয়টি অগ্রাহ্যই করা হচ্ছিল। আমরা উপলব্ধি করেছিলাম যে, এ কাজটি করা দরকার। তা না হলে দেশ পরবর্তীকালে ভয়াবহ পানি সংকটে পতিত হতে পারে। কারণ কোনো স্তরের পানিই অনন্ত নয়। জনসংখ্যা ও পানি ব্যবহার যেভাবে বাড়ছে, তাতে করে ভূগর্ভস্থ বা ভূউপরিস্থ পানিতে টান পড়তে বাধ্য। আমরা প্রথমেই আলোকপাত করেছিলাম পানি খাতের নীতিগত বিষয়াদিতে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের বিষয়টিকে মূলধারার সঙ্গে পরিচয় করানোর ব্যাপারে। পলিসি অ্যাডভোকেসির সাপোর্ট হিসেবে আমরা আগে সচেতনতামূলক কর্মসূচি নিয়েছি, সরকারি-বেসরকারি কর্মীদের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য কর্মশালা আয়োজন করেছি। আর বেশি জোর দেওয়া হয়েছিল বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ, এর প্রক্রিয়া ও সুফল সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত সবার জন্য সুলভ করার দিকে। যাতে করে সবাই বিষয়গুলো জানতে পারে।
সমকাল : ভারতের খরাপ্রবণ কোনো কোনো অঞ্চলে তো ঐতিহ্যগতভাবেই বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করা হতো...
সুস্মিতা সেনগুপ্ত : ঠিকই বলেছেন, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের এক সমৃদ্ধ ঐতিহ্য ছিল ভারতের। কিন্তু ব্রিটিশ শাসকরা আসার পর সেটা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। উপযুক্ত চর্চার অভাবে সেটা সবাই ভুলে গিয়েছিল। ব্রিটিশরা যখন প্রথম এলো, তখন দেখা গেছে ছোট ছোট কমিউনিটি ৫০০ মিলিলিটারেরও কম বৃষ্টির পানি ধরে রাখত। শহর-গ্রাম নির্বিশেষে এই চর্চা ছিল। যে কারণে সেগুলোকে ব্রিটিশরা বলত 'হাইড্রলিক সোসাইটি'। কিন্তু তারা এসে বলল যে এভাবে নয়, তারা পাইপলাইনে পানি সরবরাহ করবে। দূরে নদী থেকে এনে নগরে পানি সরবরাহ করবে। তাতে করে সবাই সেন্ট্রালাইজড একটি সিস্টেমে নির্ভরশীল হয়ে পড়ল। একই সময়ে আবার নদী, লেক দূষণ হতে শুরু করল। তখন একদিকে সেন্ট্রালাইজড সিস্টেম দূষিত হয়ে পড়ছে, অন্যদিকে ছোট ছোট কমিউনিটিভিত্তিক পানি সংরক্ষণ ব্যবস্থাও ভেঙে পড়েছে। পানি সরবরাহের বিকেন্দ্রীকরণই ফিরিয়ে আনতে কাজ করছে সিএসই।
সমকাল : আপনাদের উদ্যোগ কতটা সফল হয়েছে? বিশেষ করে ভারতের রাজধানী দিলি্লর কথা বলব। যেটা আপনাদের মূল কাজের জায়গা। বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ক্ষেত্রে সেখানকার পরিস্থিতি এখন কী?
সুস্মিতা সেনগুপ্ত : সিএসই চেয়েছিল বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ধারণাটি যথাসম্ভব ছড়িয়ে দিতে, যাতে করে পানি সংকটের একটি কারিগরি সমাধান হিসেবে একে সবাই গ্রহণ করে। এ ব্যাপারে আমরা আলাদা একটি ওয়েবসাইটই চালু করেছি। আর নীতিনির্ধারকদের দিক থেকে বেশ ভালো সাড়া মিলেছে। এখন নয়াদিলি্লতে যে কোনো নতুন ভবন তৈরি করতে হলে সেখানে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ব্যবস্থা রাখা বাধ্যতামূলক।
সমকাল : কিন্তু বৃষ্টির পানিতে নগরের বিপুল পানির চাহিদা কতটা মিটবে?
সুস্মিতা সেনগুপ্ত : সেজন্যই তো আমরা নগর সংলগ্ন জলাশয়গুলো সুরক্ষার ওপরও জোর দিয়েছি। এ ব্যাপারে আইন প্রণয়ন করতে বলছি। আপনি জানতে পারেন, দিলি্ল নগরীতে ছোট-বড় অনেক জলায়শয় ছিল। সেখান থেকে খাবার পানির বড় অংশ আসত কিন্তু সেগুলো দূষণ ও দখল হয়ে যাচ্ছিল। আমরা তখন আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলাম, যাতে করে লেকগুলো রক্ষা করা যায়। তখন আদালত নগরের বিভিন্ন কর্তৃপক্ষকে তলব করে। তাদের কাছে জানতে চেয়েছে নগরে কতটা জলাশয় রয়েছে। সেগুলোর অবস্থা কী? কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, দিলি্লতে ছোট-বড় ৬২৫টি জলাশয় আছে। কেবল দিলি্ল নয়, সারাদেশের অধিকাংশ নগরেই এমন জলাশয় আছে। যেমন গৌহাটিতে খাবার পানির একটি বড় উৎস হচ্ছে জলাশয়। খাবার পানি ছাড়াও জলাশয় হচ্ছে জীববৈচিত্র্য, বন্যা নিয়ন্ত্রণ এবং গ্রাউন্ড ওয়াটার রিচার্জের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। জলাশয় না থাকলে কোনো নগরের পরিবেশ-প্রতিবেশ ঠিক থাকতে পারে না।
সমকাল : আপনি জানেন, ঢাকাও একসময় ছিল খাল-নদীর নগর। এই শহরের বুক চিরে ৫৩টি খাল প্রবাহিত হতো। আমরা সেগুলোর প্রায় সবই ভরাট করে ফেলেছি। যে কয়টি টিকে আছে দূষণের কারণে সেগুলোর পানিও ব্যবহার অনুপযোগী। অথচ এগুলো আমাদের পানি ব্যবস্থাপনা ও পরিবেশের জন্য উপকারী হতে পারত।
সুস্মিতা সেনগুপ্ত : বৃহত্তর বাংলার আরেক নগরী কলকাতার চিত্রও ভিন্ন নয়। সেখানে গত ১০ বছরে একের পর এক পুকুর, লেক ভরাট করে বিল্ডিং, শপিংমল হচ্ছে। পূর্ব কলকাতার দিকে এক বিরাট জলাভূমি ছিল, সেটা ক্রমে কমে আসছে। ভরাট করে হাউজিং প্রকল্প হচ্ছে। ঢাকার মতো কলকাতায়ও বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেই। অথচ এ অঞ্চলে যে বৃষ্টিপাত হয়, তা পানি সংকট মোকাবেলায় কাজে লাগানো যেত। এখানকার মতো সেখানেও আর্সেনিক সমস্যা দেখা দিচ্ছে।
সমকাল : এখন ভরসা হতে পারে নদীর পানি। ঢাকার চারপাশেই নদী প্রবাহিত; কিন্তু দূষণের কারণে সেগুলোর পানির অবস্থাও করুণ। শোধনাগারের মাধ্যমে খুব সামান্যই আমরা ব্যবহার করতে পারি। দিলি্লর চিত্র আপনার কাছে জানতে চাইব।
সুস্মিতা সেনগুপ্ত : দিলি্লর পরিস্থিতি এখানকার তুলনায় খানিকটা ভালো। নাগরিক ব্যবহারের ৭০ শতাংশ পানি আসে যমুনা থেকে। যে যমুনা তাজমহলের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে। বাকিটা আসে ভূগর্ভস্থ পানি ও ভূউপরিস্থ লেক থেকে। দিলি্ল ওয়াটার বোর্ড এর ব্যবস্থাপনায় রয়েছে। কিন্তু সেখানেও সমস্যা হচ্ছে। কারণ অশোধিত পয়ঃনিষ্কাশনের কারণে যমুনার পানি দূষিত হচ্ছে। যে কারণে অনেক উজান থেকে পানি টেনে আনতে হচ্ছে। দিলি্ল থেকে যমুনার পরের অংশের পানি ব্যবহার করা যায় না। দূষণে কালো হয়ে গেছে। এজন্য সিএসই থেকে আমরা বলছি স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্লান্টের সংখ্যা বাড়াতে। স্যুয়ারেজ সিস্টেমের বিকেন্দ্রীকরণ করতে। যাতে করে বিশুদ্ধ পানির সঙ্গে অপরিশোধিত পানি মিশে না যায়। যাতে করে বৃষ্টির পানি আগেই আলাদা করে ফেলা যায়। এখন অনেক ক্ষেত্রে অপরিশোধিত পানির সঙ্গে বৃষ্টির পানি বা বিশুদ্ধ পানি মিশে যাচ্ছে। তারপর সেটা আবার শোধন করতে হচ্ছে। আবার জনসংখ্যা বাড়ার কারণে, শিল্প-উৎপাদনে পানির ব্যবহার বাড়ার কারণে নদীর পানিও বেশি ব্যবহার করতে হচ্ছে।
সমকাল :ঢাকায় তো ভূগর্ভস্থ পানির ওপরই সবচেয়ে বেশি নির্ভরতা।
নদী থাকতেও আমরা ব্যবহার করতে পারছি না।
সুস্মিতা সেনগুপ্ত : নগর বাঁচাতে হলে নদীর পানি ব্যবহারের দিকে নজর দিতেই হবে। লেক, পুকুর, জলাশয় সংরক্ষণ করতেই হবে। দীর্ঘমেয়াদে আর কোনো উপায় নেই। কারণ ভূগর্ভস্থ পানি সীমিত। এটা একসময় শেষ হয়ে যাবে। আবার পরিবেশ ও ভূমি বিপর্যয়ের শঙ্কাও আছে। এ কারণে নদীগুলোর সুরক্ষা, দূষণমুক্ত করতে সবাইকে কাজ করতে হবে। বৃষ্টির পানি সংরক্ষণও এখন খুবই জরুরি। মিডিয়া এসব বিষয়ে আলোকপাত করতে পারে। যাতে করে নাগরিকরা সচেতন হয়। আমি জানি, নদী কিংবা জলাশয় সংরক্ষণে বাংলাদেশে পর্যাপ্ত আইন রয়েছে। ভারতে জলাভূমি সংরক্ষণ আইন হয়েছে ২০১০ সালে। বাংলাদেশে তারও আগেই পরিবেশ ও জলাধার সংরক্ষণ আইন ছিল। এখন প্রয়োজন এসব আইন ও বিধানের সুষ্ঠু প্রয়োগ ও নাগরিক সচেতনতা।
সমকাল : আপনাকে ধন্যবাদ।
সুস্মিতা সেনগুপ্ত : ধন্যবাদ।

No comments

Powered by Blogger.