জোনাকির আলো by একরামুল হক শামীম

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জোনাকিদের নিয়ে গান লিখেছিলেন_ 'কী সুখে ঐ ডানা দুটি মেলেছ, ও জোনাকি।' জোনাকিরা নিজের আলোকে সঙ্গী করে রাতের আঁধার কাটিয়ে এগিয়ে চলে। তবে নাগরিক আলোকোজ্জ্বল রাতে জোনাকি পোকারা যেন হারিয়ে গেছে।


জোনাকি পোকার আলোর মিছিলের সঙ্গে হয়তো অনেকেই পরিচিত। অদ্ভুত কৌশলে জোনাকিরা আলো জ্বালিয়ে চলে। নিকষ অন্ধকারেও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে চারপাশ। শহরের রাত থেকে জোনাকি পোকারা হারিয়ে গেলে তারা আছে গ্রামের রাতগুলোতে। জোনাকি পোকারা কীভাবে আলো সৃষ্টি করে তা নিয়ে বেশ গবেষণা হয়েছে। জানা গেছে, জোনাকির তলপেটের দিকে একটি উপাঙ্গ থাকে। এই উপাঙ্গ থেকে লুসিফেরিন নামের রাসায়নিক পদার্থ নিঃসরিত হয়। এটি আবার জোনাকির গৃহীত অক্সিজেন নিয়ে জারিত হয়। লুসিফারেজ নামের জৈব অনুঘটক এতে সহায়তা করে। জারণ বিক্রিয়ার মাধ্যমেই জোনাকির আলো জ্বলে। জোনাকির আলো কিছুক্ষণ পরপর জ্বলে আর নেভে। প্রজাতিভেদে তা দুই থেকে পাঁচ সেকেন্ড পর্যন্ত হয়ে থাকে। জোনাকির আলো জ্বলার পেছনে প্রজননগত কারণ রয়েছে। এর মাধ্যমে জোনাকিরা পরস্পরকে আকর্ষণ করে। এ ছাড়া খাবার খুঁজে পেতেও জোনাকিরা আলো ব্যবহার করে। তবে জোনাকির আলোতে তাপ উৎপাদন হয় খুবই কম। যে পরিমাণ আলো উৎপন্ন হয় তার শতকরা ২ ভাগ থাকে তাপ। এর ফলে জোনাকির আলো অনেক সি্নগ্ধ হয়। এ ব্যাপারটিই জোনাকির ব্যাপারে বিজ্ঞানীদের আগ্রহী করে তুলেছে। জোনাকি প্রাকৃতিক উপায়ে যেভাবে আলো তৈরি করে তার অনুসন্ধানে বিজ্ঞানীরা গবেষণা করেছেন।
সম্প্রতি দক্ষিণ কোরিয়ার বিজ্ঞানীরা জোনাকির আলোর ব্যাপারে সফলতা পেয়েছেন। তারা জোনাকির তলপেটের কাঠামো অনুকরণ করে তুলনামূলক সস্তা ও উন্নতমানের এলইডি লেন্স তৈরির কৌশল আবিষ্কার করছেন। বিজ্ঞানীরা গবেষণার সময় প্রকৃতির আলোর উৎস জোনাকির মাধ্যমে উৎসাহিত হয়েছেন। এলইডি লেন্স বিষয়ক একটি নিবন্ধ সম্প্রতি 'প্রসিডিংস অব দ্য ন্যাশনাল অ্যাকাডেসি অব সায়েন্সেস'-এ প্রকাশিত হয়েছে। এতে স্বল্প ব্যয়ে এলইডি লেন্স তৈরির কৌশল বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এরই মধ্যে বিজ্ঞানীরা পরীক্ষামূলকভাবে এলইডি লেন্স তৈরি করেছে। বর্তমানে এলইডি (লাইট এমিটিং ডায়োড) লেন্সের চাহিদা বেড়েই চলেছে। ধারণা করা হচ্ছে, জোনাকির আলো জ্বালানোর কৌশল অবলম্বনে নির্মিত এলইডি লেন্স স্মার্টফোন ও টেলিভিশনসহ অন্যান্য ইলেকট্রনিক পণ্যে ব্যবহার করা যাবে। তখন সেই পণ্যের দামও তূলনামূলকভাবে কমবে।
জোনাকির আলোর প্রসঙ্গ এতদিন গল্প-কবিতায় স্থান পেয়েছে। এমনকি রূপকথায়ও ছিল জোনাকির উপস্থিতি। সেই জোনাকি এখন বিজ্ঞানীদের গবেষণার দিকনির্দেশক। একসময় পাখি ওড়ার কৌশলকে অনুসরণ করে অ্যারোপ্লেন তৈরির কৌশল ঠিক করা হয়েছিল। তার মাধ্যমে এখন মানুষ সহজেই উড়ে বেড়ায় দেশ-বিদেশ। যে সুখে জোনাকি ডানা মেলেছে তা যেমন আমাদের বহু অনাবিল আনন্দময় সময়ের সাক্ষী করেছে, তেমনই বিজ্ঞানীদের জন্য দিয়েছে নতুন গবেষণার উপাত্ত।
 

No comments

Powered by Blogger.