খালেদা জিয়ার ভারত সফর-প্রতিবেশীর সঙ্গে সুসম্পর্ক সুদৃঢ় করবে

শান্তি, স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধির স্বার্থে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখাটা যেকোনো দেশের জন্য অত্যন্ত জরুরি। নিকটতম এবং বৃহত্তম প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক বাংলাদেশের অগ্রগতির স্বার্থেই প্রয়োজন।


ভারতও যে তাদের জাতীয় স্বার্থে একইভাবে সম্পর্ক রক্ষায় আগ্রহী, এরই প্রমাণ পাওয়া যায় বাংলাদেশের বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়াকে সে দেশে সফরের আমন্ত্রণ জানানোর মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশের মানুষ ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক চায়। তবে সেই সম্পর্ক হতে হবে সৎ প্রতিবেশীসুলভ, সার্বভৌম সমতা, একে অন্যের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করা, ন্যায্যতা এবং পারস্পরিক আস্থা ও শ্রদ্ধাভিত্তিক। ভারতীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে খালেদা জিয়া স্পষ্টতই তাঁর সেই সদিচ্ছার বিষয়টি তুলে ধরেছেন। আমরা মনে করি, দুই দেশের সম্পর্কোন্নয়নের ক্ষেত্রে এ সফর খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে এবং দুই দেশের সুসম্পর্ককে সুদৃঢ় করবে।
তিন দিক থেকে ভারতবেষ্টিত বাংলাদেশের ওই দেশের সঙ্গে দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই রয়েছে সীমান্ত বিরোধও। সীমান্তে দুই দেশের চোরাচালানি, সন্ত্রাসী ও অন্যান্য অপরাধীচক্র ব্যাপকভাবে সক্রিয়। অভিন্ন স্বার্থে এদের দমন করা প্রয়োজন। কেবল বিএসএফ গুলি চালিয়ে কিছু বাংলাদেশিকে হত্যা করলে এ সমস্যার সমাধান হবে না। বরং সীমান্তে একজন বাংলাদেশি নিহত বা নির্যাতিত হলে তা দুই দেশের সম্পর্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। খালেদা জিয়া তাঁর এ সফরকালে বিষয়টি ভারতীয় নেতাদের কাছে জোরালোভাবে উপস্থাপন করেছেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংও তাঁর সঙ্গে সহমত পোষণ করে অবিলম্বে সীমান্তে হত্যা বন্ধের উদ্যোগ নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। বাংলাদেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত নদীগুলোর ভারতীয় অংশে অনেক বাঁধ নির্মিত হওয়ায় নদীগুলো এখন মৃতপ্রায়। ফলে চাষাবাদ ও পরিবেশ-প্রতিবেশে চরম বিরূপ প্রভাব পড়ছে। খালেদা জিয়া ন্যায্যতার ভিত্তিতে অভিন্ন নদীগুলোর পানি বণ্টনের দাবি জানিয়েছেন। বহুল আলোচিত টিপাইমুখ জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের ব্যাপারে যৌথ নদী কমিশনের আওতায় একটি উপকমিটির মাধ্যমে যৌথ সমীক্ষার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় তিনি ভারত সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে তাতে দুই দেশের দক্ষ ও যোগ্য ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করার আহ্বান জানান। অতীতে ভারতে যেমন বাংলাদেশবিরোধী বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী আশ্রয়-প্রশ্রয় পেয়েছিল, বাংলাদেশেও তেমন ভারতীয় কিছু বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী আশ্রয়-প্রশ্রয় পেয়েছিল। ভবিষ্যতে কোনো দেশই তাদের মাটিতে এ ধরনের কোনো বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীকে আশ্রয়-প্রশ্রয় না দেওয়ার যে ঘোষণা দিয়েছে তা সম্পর্ক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে নির্ধারিত সময়ে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সরকার পরিবর্তন স্বাভাবিক ব্যাপার। তা ছাড়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিরোধী দল সরকারেরই অংশ এবং গুরুত্বপূর্ণ অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণে বিরোধী দলের পরামর্শ নেওয়া হয়। ভারত নিজ দেশে এ নীতি অনুসরণ করে। সে বাস্তবতা থেকেই ভারত বাংলাদেশের বিরোধী দলের নেতাকে সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছে। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আমরা বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক চাই, নির্দিষ্ট কোনো দল বা ব্যক্তির সঙ্গে নয়। খালেদা জিয়ার সঙ্গে ভারতের সরকারি ও বিরোধী দলের নেতা-নেত্রীদের আন্তরিক এবং খোলামেলা আলোচনার ভেতর দিয়ে সেই সত্যই আরো স্পষ্ট হয়েছে। আমাদের দেশে অন্ধ ভারতবিদ্বেষী অবাস্তব রাজনীতির দিন যে শেষ হয়ে এসেছে, খালেদা জিয়ার বর্তমান ভারত সফরের মধ্য দিয়ে সেই বার্তাটিই স্পষ্ট হয়েছে। ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ি বলেছিলেন, 'আমরা আমাদের বন্ধুদের বেছে নিতে পারি; কিন্তু প্রতিবেশী বেছে নিতে পারি না।' প্রতিবেশী বেছে নেওয়া যায় না। সে কারণেই প্রতিবেশীর সঙ্গে সৎ ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রক্ষার মাধ্যমে শান্তি, স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করতে হয়। আশা করা যায়, খালেদা জিয়ার এ সফরে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে নতুন মাত্রা যুক্ত হবে। খালেদা জিয়ার সম্মানে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া মধ্যাহ্নভোজে সে দেশের বিরোধী দলের শীর্ষ নেতাদের উপস্থিতিতে আমাদের সংঘাতময় রাজনীতির অসারতা আরেকবার প্রমাণিত হয়েছে। আমরা চাই, আমাদের দেশেও জাতীয় স্বার্থে ঐক্য ও সংহতির এ সংস্কৃতি অচিরেই চালু হবে।

No comments

Powered by Blogger.