ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে খালেদা জিয়ার বৈঠক- সামনে তাকাতে চায় দুই পক্ষই

অতীত দূরে রেখে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন খালেদা জিয়া। দিল্লি সফরের তৃতীয় দিনে গতকাল মঙ্গলবার হায়দরাবাদ হাউসে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতে বাংলাদেশের বিরোধীদলীয় নেতা এ মত ব্যক্ত করেন।


তাঁকে সমর্থন করে সালমান খুরশিদ বলেন, ‘আমরাও গতকাল নয়, সামনের দিকে তাকাতে চাই।’
এই বৈঠকের পর বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সম্মানে মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন করেন সালমান খুরশিদ। সকালে খালেদা জিয়ার সঙ্গে হোটেল তাজ প্যালেসে দেখা করেন ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেনন। এ সময় শিবশঙ্কর মেনন সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চীনের সঙ্গে বিনিয়োগে ভারতের আগ্রহের কথা জানান। তাঁর এ প্রস্তাবকে স্বাগত জানান খালেদা জিয়া।
খালেদা-সালমান আলোচনার পর বৈঠক সম্পর্কে সাংবাদিকদের অবহিত করেন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সৈয়দ আকবরউদ্দীন। তিনি বলেন, অতীতকে দূরে রেখে ভবিষ্যৎ সম্পর্ক নতুনভাবে গড়ে তোলার ওপর জোর দিয়েছেন খালেদা জিয়া ও সালমান খুরশিদ।
খালেদা জিয়াকে উদ্ধৃত করে সৈয়দ আকবরউদ্দীন বলেন, তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলেছেন, ‘এই সফর নতুন দিনের সূচনা; পেছনে নয়, আমাদের তাকাতে হবে সামনের দিকে।’
বিএনপির এবারের পরিবর্তিত অবস্থানকে ভারত কীভাবে মূল্যায়ন করে—জানতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেন, ‘আমরা অতীতকে পেছনে ফেলে সামনের দিকে তাকাতে চাই।’
খালেদার সঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠকে অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন, সীমান্ত হত্যা, সন্ত্রাসবাদ, বাণিজ্য সম্প্রসারণ, দুই দেশের জনগণের মধ্যে যোগাযোগ বাড়ানো নিয়ে আলোচনা হয়। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, আলোচনার মাধ্যমে তিস্তাসহ অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন নিয়ে সমস্যার সমাধান হবে।
‘খালেদার প্রতিশ্রুতি অভিনন্দনযোগ্য’: বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বাংলাদেশের মাটিতে আশ্রয় না দেওয়া এবং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে নতুন যুগের সূচনার যে প্রত্যয় খালেদা জিয়া ব্যক্ত করেছেন, তাতে সন্তোষ প্রকাশ করেছে নয়াদিল্লি। বিশেষ করে অতীতকে দূরে ঠেলে বর্তমানে দুই প্রতিবেশীর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে এগিয়ে নিতে বিএনপির চেয়ারপারসনের মনোভাবকে যথেষ্ট ইতিবাচক হিসেবে দেখছে দিল্লি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, সন্ত্রাসবাদ দমনের বিষয়টি বিএনপির নেতা নিজেই গুরুত্বের সঙ্গে বিভিন্ন নেতার সঙ্গে আলোচনায় তুলেছেন। পরিবর্তিত বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে সন্ত্রাসকে প্রশ্রয় দেওয়া বাংলাদেশ কিংবা ভারত কারও জন্যই শুভকর নয়। এ সত্যটা দুই দেশের নেতারা উপলব্ধি করছেন। এমন এক পরিস্থিতিতে বিএনপির চেয়ারপারসনের আশ্বাসটা বাস্তবসম্মত।
অতীতে, বিশেষ করে বিগত বিএনপির শাসনামলে দুই প্রতিবেশীর সম্পর্ক সর্বনিম্ন পর্যায়ে ছিল। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বাংলাদেশ আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে—দিল্লি বারবার এ অভিযোগ করলেও বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তখন তেমন কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। তবে বর্তমান সরকারের আমলে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমনে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যে সহযোগিতা করা হচ্ছে, তার ভূয়সী প্রশংসা করে আসছে দিল্লি। এমন এক প্রেক্ষাপটে এবারকার সফরে খালেদা জিয়া যখন ভারতবিরোধী বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আশ্রয় না দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন, তখন সেটি আগামী দিনের সম্পর্ককে এগিয়ে নিতে দিল্লিকে নতুন ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মত।
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে দিল্লির একজন কূটনীতিক বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশের জনগণ ও সব রাজনৈতিক পক্ষের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার নীতিতে বিশ্বাসী। পারস্পরিক স্বার্থ অক্ষুণ্ন রেখে আমরা এ সম্পর্ককে এগিয়ে নিতে চাই।’
এখন এমন ধারণা তৈরি হয়েছে যে, বর্তমানে আওয়ামী লীগ সরকারের জনপ্রিয়তা কমছে আর বিএনপির ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হচ্ছে। এ জন্যই কি খালেদা জিয়ার সফরকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে? এ প্রশ্নের জবাবে ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে আমরা কখনোই হস্তক্ষেপ করি না। ভারত সব সময় একটি স্থিতিশীল, গণতান্ত্রিক ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ দেখতে চায়। দুই দেশের জনগণের কল্যাণে আমরা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে চাই।’
এদিকে বিএনপির প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান দিল্লিতে সাংবাদিকদের বলেন, ‘খালেদা জিয়ার সফরের মূল উদ্দেশ্য ছিল বিএনপি ও ভারতের মধ্যে অনাস্থা ও সন্দেহ দূর করে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলা। এ সফরের মধ্য দিয়ে আমাদের সে লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা সব ধরনের সন্দেহ-অবিশ্বাস দূর করে দুই দেশের সম্পর্কে নতুন দিগন্ত রচনা করতে চাই।’ এ ক্ষেত্রে বিএনপি ও ভারতের মধ্যে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হবে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা দুই দেশের সম্পর্ক আরও জোরদার করতে চাই। সেই সঙ্গে দুই দেশের জনগণ এবং বিভিন্ন মতাদর্শের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বন্ধন আরও সুদৃঢ় করতে চাই।’
এদিকে খালেদা জিয়ার সফরসঙ্গী ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, বিরোধীদলীয় নেতার সঙ্গে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি ও কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধীর সাক্ষাতের সময়সূচি এখনো চূড়ান্ত হয়নি।
এক সপ্তাহের সফর শেষে ৩ নভেম্বর খালেদা জিয়ার দেশে ফেরার কথা রয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.