চরাচর-সংগীতের এক রাজপুত্র by জাহাঙ্গীর হোসেন অরুণ

'না আইলো মোর প্রাণের পতি হাইহাইরে না আইলো/না আইলো মোর প্রাণের পতি, ডুইব্বা গেলো বেলারে, ডুইব্বা গেলো বেলা/রঙ্গীলা রঙ্গীলা রঙ্গীলারে রঙ্গীলা।' গান হচ্ছে বাণী ও সুরের খেলা, বাণীর বান ডাকবে মনে। মনের বান কণ্ঠের কারুকার্জের বাঁকে ঢেলে দিলে হবে গান।


এর মাঝখানে আবেগ ঢালার সুযোগ নেই। অথচ নিয়মের বাইরে গিয়ে কী সাবলীল সুষমায় কণ্ঠের আবেগ ঢেলে দেওয়া হলো_'হাইহাইরে'। এখানে অনিয়মটাই অলংকার হয়ে গেল। ডুবে বা ডুইবা (শব্দটাকে জোর দিয়ে করা হলো ডুইব্বা। এখানে শব্দের গ্রাম্য প্রয়োগেও গানের মান এতটুকু কমল না, বরং হৃদয়ে বেশি করে গেঁথে গেল)। এর কারণ হলো_গানখানি গেয়েছেন সংগীতের এক রাজপুত্র। কেউ কেউ সংগীতের এই রাজপুত্রকে ডাকেন শচীন দা, কেউ কেউ শচীন কর্তা, কেউ কেউ শুধু কর্তা। 'প্রাণের পতি আসলো না', আর কোনো কথা? হাইহাইরে! এমন সহজ কথায়, সহজ সুরে, পরম মমতায় গান করতেন শচীন কর্তা। তাঁর 'ডাকাতিয়া বাঁশি' গানটি আকুল করে দেয় মানুষের হৃদয়কে। ত্রিপুরার (বর্তমান কুমিল্লা) রাজপরিবারের ছেলে এই শচীন দেব বর্মণ। বাবা নবদ্বীপচন্দ্র ছিলেন নিপুণ সেতারশিল্পী। ধ্রুপদাঙ্গ সংগীতে নবদ্বীপের ছিল ধারালো কণ্ঠ। মা নিরুপমা দেবী ছিলেন মণিপুরি রাজবংশের মেয়ে। শচীন কর্তার মার্গ সংগীতের প্রথম গুরু হলেন স্বয়ং তাঁর বাবা। তাঁর জীবনীতে লিখে যাওয়া সাক্ষ্য অনুযায়ী, লোকগানে কর্তার প্রথম গুরু হলেন তাঁদের বাড়ির ভৃত্য মাধব ও আনোয়ার। মাধব সুর করে রামায়ণ পড়তেন আর আনোয়ার দোতারা বাজিয়ে ভাটিয়ালি গান গাইতেন। বালক শচীন তখনই লোকসংগীতের জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। পরবর্তীকালে পূর্ববঙ্গের তথা বাংলাদেশের এমন কোনো গ্রাম নেই, এমন কোনো নদী নেই, যেখানে তিনি গ্রামের মানুষের মুখে লোকসংগীতের সন্ধান করেননি। তাঁর 'ডাকিলে কোকিল রোজ বিহানে' এবং 'এ পথে আজ এসো প্রিয়' দুটি গান অসম্ভব জনপ্রিয়তা পায়। রাগের আশ্রয়ে যে লোকসংগীতের মমতা মিশিয়ে গান হয়, তা আমাদের শিখিয়ে গেছেন শচীন কর্তা। তাঁর জীবনসঙ্গিনী পেয়েছিলেন মীরা দেব বর্মণকে, সংগীতের আর এক অসামান্য প্রতিভা ছিলেন তিনি। 'শোন গো দখিনা হাওয়া প্রেম করেছি আমি', 'তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল' ইত্যাদি জনপ্রিয় গানের রচয়িতা ছিলেন কর্তার এই সংগীতসাধক পত্নী। ছেলে রাহুল দেব বর্মণ নাকি বাবা শচীন দেব বর্মণকেও সংগীতের প্রতিভায় ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন, এ কথা অনেকেই বলেন। অসামান্য সংগীতপ্রতিভা আশা ভোঁশলেকে সন্তানসহ রাহুল দেব বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু তাঁর ঔরসে কোনো সন্তান হয়নি। রাহুল দেবের মৃত্যুতে বর্মণ পরিবারের সংগীত ধারার সমাপ্তি হয়েছিল। হিন্দি সিনেমার সংগীতে এত ভেরিয়েশেন এনেছিলেন এই বাবা আর ছেলে, যার ধারাবাহিকতা আর কেউ ধরে রাখতে পারেনি। শচীন দেব বর্মণের জন্ম ১৯০৬ সালের ১ অক্টোবর আর মৃত্যু ১৯৭৫ সালের ৩১ অক্টোবর। বাংলার সংগীতজগতে তিনি চিরঞ্জীব।
জাহাঙ্গীর হোসেন অরুণ

No comments

Powered by Blogger.