‘প্রধানমন্ত্রীর কাছে ছেলের প্রাণ ভিক্ষা চাই’ by জাহাঙ্গীর সুমন

“আমার ছেলে ছাড়া সংসার অচল। তার নামে মামলা তো দূরের কথা, কোথাও একটা জিডি পর্যন্ত নাই। আমার ছেলেকে র‌্যাবে ধরে নিয়ে গেছে। আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার ছেলের প্রাণ ভিক্ষা চাই।”

এভাবে আকুতিভরা আহাজারি করতে করতে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন সাভারের আমিনবাজারের বড়দেশী পূর্বপাড়া গ্রামের নিখোঁজ মনির হোসেনের মা হালিমা খানম।
ছেলের শোকে অসুস্থ বাবা খলিল মিয়াও নির্বাক হয়ে গেছেন। সাংবাদিক এসেছে শুনে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন সবার দিকে। মনিরের মা হালিমা খানম জানান, গত ২৩ অক্টোবর দুপুর আড়াইটায় দুপুরের খাবার খেয়ে ঈদের কেনাকাটা করার কথা বলে পাশের বাড়ির সেলিম (২৬) আর বেগুনবাড়ী গ্রামের সাইফুলসহ (২৮) মিরপুর মার্কেটে যাওয়ার জন্য এক সাথে বের হয় মনির। দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়, মনিরের মোবাইলে ফোন করে বারবার বন্ধ পাওয়া যায়। মোবাইল বন্ধ পেয়ে সেলিমের বাড়িতে খোঁজ নেন তারা।

সেলিমের ভাই আবুল কালাম জানান, বিকালের পর থেকে সেলিমকেও খুঁজে পাওয়া যায়নি। এরপর তারা জানাতে পারেন বেগুনবাড়ী গ্রামের সাইফুলও (৩০) নিখোঁজ।

এর আগে গত ১০ অক্টোবর তাদেরই বাড়ির কাছ থেকে আব্দুস সাত্তারকে মাইক্রোবাসে করে তুলে নিয়ে যায় সাদা পোশাকধারীরা। সেদিন তিনি ৭ বছর বয়সী ছেলে রাতুলকে স্কুলে নিয়ে যাচ্ছিলেন।

সাত্তারের শিশুপুত্র রাতুল বাংলানিউজকে জানায়, লম্বা দু’জন লোক তার বাবার দু’পাশ থেকে দুই হাত ধরে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায়।

পূর্বপাড়া গ্রামের সাত্তারের বড় ভাই আবুল হোসেন বাংলানিউজকে জানান, ঘটনার পর থেকে তারা সাভার থানা , র‌্যাব-৪ এর নবীনগর ক্যাম্পসহ বিভিন্ন স্থানে খোঁজ করে না পেয়ে র‌্যাবের প্রধান কার্য‍ালয়ে লিখিত অভিযোগ করেছেন।

বরদেশী পশ্চিম পাড়ার নিখোঁজ সাইফুল ইসলামের স্ত্রী রুমা বেগম জানান, তার স্বামী বরদেশী গ্রামে থেকে ইলেকট্রিক মিস্ত্রির কাজ করতেন। কিছুদিন আগে চাঞ্চল্যকর ছয় ছাত্র খুনের ঘটনায় সিআইডি পুলিশ তাকেসহ ১৫ জনকে গ্রেপ্তার করেছিলো। প্রায় তিনমাস জেলে থেকে উচ্চ আদালতের নির্দেশে  তারা জামিনে মুক্ত হন।

তিন বন্ধু সেলিম, মনির হোসেন ও বেগুনবাড়ি গ্রামের সাইফুল ইসলাম ওই এলাকায় বালুর ব্যবসা করতেন। ২৩ অক্টোবর তারা নিখোঁজ হন। সেলিমের বড় ভাই কালাম ২৫ অক্টোবর সাভার থানায় লিখিত অভিযোগ করতে গেলে অভিযোগটি আমালে না নিয়ে তাদের ফিরিয়ে দেয়া হয়। পরে ২৯ অক্টোবর সেলিমের খালাতো ভাই দারুসসালাম থানায় একটি সাধারণ ডায়রি করেন (নং ১৫০৫)। এ ডায়রিটি তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয় এসআই মনিরুজ্জামানকে।


অভিযোগ নিতে সাভার থানা পুলিশের গাফিলাতি
আমিন বাজারের বিভিন্ন সময়ে ৫ জন নিখোঁজ হওয়ার পর প্রতিটি পরিবারের পক্ষ থেকে সাভার থানায় অভিযোগ করতে যায়। প্রতিটি পরিবারের অভিযোগকারীরা বাংলানিউজকে জানান, অভিযোগ নিয়ে গেলে থানার কর্তব্যরত কর্মকর্তারা বলেন, ‘ভালো করে খোঁজ করেন পেয়ে যাবেন’। আর কোনো জিডি বা অভিযোগ থানার রেকর্ডভুক্ত না থাকলে র‌্যাব কিংবা আইনশৃন্খলা বাহিনীর কোনো দপ্তর তাদের অভিযোগ নিতে চায় না।

এ ব্যাপারে মঙ্গলবার দুপুরে সাভার মডেল থানায় গিয়ে অফিসার ইনচার্জ মো. আসাদুজ্জামানকে পাওয়া যায়নি। মোবাইল ফোনে তিনি জানান, ব্যক্তিগত কাজে তিনি বাইরে। ৫ জন নিখোঁজের ব্যাপারে তিনি কিছুই জানেন না। তবে ওই থানার অপারেশন অফিসার সাজ্জাদ রোমন জানান, নিখোঁজ মনিরের মা  হালিমা একটি অভিযোগ নিয়ে এসেছিলেন। আমরা তা তদন্তের ব্যবস্থা করেছি।

র‌্যাব যা বলছে
নিখোঁজের ব্যাপারে র‌্যাব -৪ এর সিপিসি-১ এর কোম্পানি কমান্ডার স্কোয়াড্রন লিডার মোহম্মাদ মিরান হোসেন বাংলানিউজকে জানান, নিখোঁজ হওয়ার খবর আমরা শুনেছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে কেউ অভিযোগ করেনি। অভিযোগ দিলে আমরা ব্যাবস্থা নেব। এছাড়া নিখোঁজ হওয়ার সংবাদ পাওয়ার পর ওই এলাকায় গোয়েন্দা নজরদারী বাড়ানো হয়েছে বলে তিনি জানান।

নিখোঁজদের ব্যাপারে নানা অভিযোগ
স্থানীয় লোকজন জানায়, ২০১১ সালের ১৭ জুলাই শবে বরাতের রাতে ডাকাত সন্দেহে ছয় ছাত্রকে পিটিয়ে মারার ঘটনায় ওই এলাকার বালু ব্যবসায়ী  আবদুল মালেক নিহত ছাত্রদের বিরুদ্ধে  সাভার থানায় ডাকাতির  মামলা করেছিলেন। পরে হত্যাকারী সন্দেহে ওই মামলায় সিআইডি পুলিশ মালেককে গ্রেপ্তার করে। কয়েক দফা রিমান্ড শেষে মালেক আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। জবানবন্দিতে সর্বশেষ নিখোঁজ চার জন সাত্তার, সেলিম, মনির ও সাইফুলের নাম প্রকাশ করেছিলেন মালেক।

নিখোঁজ সাত্তারের ভাই আবুল হোসেন জানান, সাত্তার দীর্ঘ দিন থেকে মাদক সেবন ও অবৈধ মাদক ব্যবসা করে আসছিল। ২০০৫ সালে বিপুল পরিমান ফেন্সিডিলসহ গ্রেপ্তার হয়ে জামিনে বেরিয়ে এসে ৩/৪ বছর সিঙ্গাপুরে থেকে ২০১০ সালে দেশে এসে বালুর ব্যবসার পাশাপাশি পরিবহনের ব্যবসা শুরু করে সে।  এছাড়া বেগুনবাড়ির সাইফুল মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। মাদকের টাকার ভাগবাটোয়ারা নিয়ে সংঘর্ষের ঘটনার একটি মামলার আসামি সে।

No comments

Powered by Blogger.