অনুসন্ধান- ব্যবসায়ী জিয়া হত্যায় পুলিশও জড়িত! by কাজী আনিছ

মিরপুরের মধ্য পীরেরবাগের ব্যবসায়ী কাজী জিয়া হায়দার হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে একজন পুলিশ কর্মকর্তা জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে। পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা চেয়ে না পেয়ে ঘরে ঢুকে জিয়াকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ওই হত্যাকাণ্ডে পাঁচ থেকে সাতজন অংশ নিয়েছেন।


প্রথম আলোর অনুসন্ধানে এ অভিযোগের সপক্ষে অন্তত ছয়টি তথ্য পাওয়া গেছে। হত্যাকাণ্ডের সময় ঘটনাস্থলের পাশে ছিলেন সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) জামিল আহমেদ ও পুলিশের সোর্স (তথ্যদাতা) মনির। হত্যাকাণ্ডের পরপরই এলাকার রাস্তায় মনিরের সঙ্গে ওই পুলিশ কর্মকর্তাকে কথা বলতে দেখেন একাধিক এলাকাবাসী।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, এএসআই জামিল আহমেদ এই মামলার তদন্তের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। কিন্তু একজনকে ধরে নিয়ে মামলায় ফাঁসানোর ভয় দেখান তিনি। পরে টাকা দিয়ে ছাড়া পান বলে অভিযোগ করেন ওই ব্যক্তি। কিন্তু অভিযোগ অনুযায়ী, ‘হত্যায় অংশ নেওয়া’ মনিরের ভাই নয়নকে না ধরায় তিনি বিদেশে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। হত্যাকারীদের আড়াল করতে হত্যাকাণ্ডের পরপরই পুলিশের বরাতে এর পেছনে নিহতের স্ত্রীর পরকীয়ার গল্প প্রচার করা হয়। ছিল মামলার তদন্তে মিরপুর থানার গাফিলতি।
অনুসন্ধানে পাওয়া এই ছয় তথ্যকে ভিত্তি ধরে এই প্রতিবেদক এএসআই জামিলসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলেন। তাতে ওই হত্যাকাণ্ডের পেছনে পুলিশ কর্মকর্তা জামিল ও পুলিশের তথ্যদাতা মনিরের উপস্থিতির কিছু চিত্র পাওয়া যায়। মনির কারাগারে থাকায় তাঁর সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
এলাকার একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী নাম প্রকাশ না করার শর্তে দাবি করেন, ব্যবসায়ী জিয়া হত্যার পরপরই পুলিশের সোর্স মনির মোটরসাইকেলে এলাকা ত্যাগ করেন। পথে জিয়ার বাসা থেকে প্রায় ১০০ গজ দূরের মজিনার বাসার পাশে এএসআই জামিলের সঙ্গে কয়েক সেকেন্ড কথা বলেন তিনি। মনিরের সঙ্গে কথা বলার পর জামিল জিয়ার বাসায় যান।
ব্যবসায়ী জিয়ার মেয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘গুলিবিদ্ধ বাবাকে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য আমরা যখন গাড়িতে তুললাম, তখনই সাদা পোশাকে এক লোক আমাকে বললেন, ‘আমি পুলিশের লোক, আমাকে বলো কী হয়েছে?’
এই মামলার মিরপুর থানার তখনকার তদন্ত কর্মকর্তা উপপরিদর্শক ইয়াছিন গাজী প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা মনে আছে, জিয়া হত্যার খবর প্রথম থানায় জানান এএসআই জামিল। তবে তিনি ঘটনার সঙ্গে জড়িত কি না, তা বলতে পারব না।’
জিয়া হত্যাকাণ্ডের সময় এএসআই জামিল এলাকায় মজিনার বাসায় অবস্থান করার কথা প্রথম আলোর কাছে স্বীকার করলেও হত্যার ঘটনার সঙ্গে জড়িত নন বলে দাবি করেন। পুলিশের তথ্যদাতা হিসেবে মনিরের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ থাকার কথাও স্বীকার করেন তিনি।
জিয়া হত্যার সময় মজিনার বাসায় কেন গিয়েছিলেন জানতে চাইলে এএসআই জামিল বলেন, ‘ওই এলাকায় একটা ছিনতাই হয়েছিল। সে সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে গিয়েছিলাম।’ সেখানে সোর্স মনিরের সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছিল কি না—জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আপনার কাছে তথ্য থাকলে আপিন রিপোর্ট করেন। আর ওদের কাছে (জিয়ার পরিবার) তথ্য থাকলে মামলা করতে বলেন।’
জানতে চাইলে সম্প্রতি মজিনা বলেন, ‘এএসআই জামিল আমার ভাইয়ের মতো। ঘটনার সময় জামিল আমার বাসায় ছিলেন। তবে আসার কিছুক্ষণ পর মুঠোফোনে কল এলে বাইরে বের হয়ে যান তিনি।’
জিয়া হায়দারকে গত ২১ জানুয়ারি নিজ বাসায় গুলি করে হত্যা করা হয়। হত্যায় অংশ নেওয়া ইমরান হোসেন ওরফে জিতু গ্রেপ্তার হওয়ার পর সাংবাদিকদের সামনে পুলিশকে জানান, মিরপুর থানা-পুলিশের সোর্স স্থানীয় মনির ব্যবসায়ী জিয়ার কাছে পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন। চাঁদা না দেওয়ায় তাঁকে খুন করা হয়। ঘটনার সময় মনির বাসার বাইরে অবস্থান করছিলেন।
সম্প্রতি ওই হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে মো. মামুন নামের আরেকজনকে এলাকাবাসী ধরে ডিবি পুলিশের কাছে সোপর্দ করে। পুলিশে সোপর্দের আগে মামুন প্রথম আলোকে বলেন, নয়নের ভাই মনির ঘটনার পরিকল্পনাকারী। ঘটনার দিন তাঁরা কয়েকজন জিয়ার বাসায় ঢুকেন। বাইরে ছিলেন মনির ও আরেক ব্যক্তি। আরেক ব্যক্তি কে—জানতে চাইলে মামুন বলেন, ‘ওই ব্যক্তির নাম জানি না। তবে পুলিশসহ মনিরের দোকানে মাঝেমধ্যে বসতেন ওই ব্যক্তি।’
জিয়ার পরিবার ও স্থানীয়রা জানান, মনির ও এএসআই জামিলের ‘বন্ধুত্ব’ এলাকার সবারই জানা। মধ্য পীরেরবাগে মনিরের দোকানে মাঝেমধ্যেই আড্ডা দিতেন জামিল। সেই সূত্রে এলাকার অনেকে জামিলকে চেনেন।
জিয়া হত্যাকাণ্ডের কিছুদিন পর এএসআই জামিল আহমেদকে রূপনগর থানায় বদলি করা হয়।
বর্তমানে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ঘটনার তদন্ত করছে। ডিবির সহকারী কমিশনার বলেন, ‘ওই হত্যা মামলার তদন্তে থানা-পুলিশের অবহেলা ছিল, এটা বলা যায়। তবে মিরপুর থানার কারও কোনো সম্পৃক্ততা নিয়ে আমাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। আমরা তা তদন্ত করিনি।’
মামলার বাদী জিয়ার স্ত্রী কাজী সেলিনা আজমী বলেন, ‘ঘটনার পর থেকেই আমি জড়িতদের ব্যাপারে মিরপুর থানার পুলিশকে তথ্য দিয়ে আসছি। পুলিশ কোনো গুরুত্ব দেয়নি। বরং এক আসামিকে বিদেশ পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। মামলাকে ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন পুলিশ কর্মকর্তা জামিলসহ কয়েকজন।’
জিয়ার পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ, এএসআই জামিল এই হত্যাকাণ্ডকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করেছিলেন। পুলিশ ও আসামিরা হত্যার কারণ হিসেবে জিয়ার স্ত্রীর পরকীয়া সম্পর্কের মিথ্যা কাহিনি প্রচার করেছে।
স্থানীয়রা জানান, এলাকার এক কেব্ল টিভি (ডিশ) ব্যবসায়ীর কর্মচারী মোহাম্মদ মামুনকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। তাঁকে দিয়ে ওই ব্যবসায়ীর সঙ্গে নিহতের স্ত্রীর পরকীয়ার গল্প প্রচারের চেষ্টা চালানো হয়। শেষমেশ না পেরে টাকার বিনিময়ে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
যোগাযোগ করা হলে মামুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘটনার কয়েক দিন পর এক রাতে মনির ও এএসআই জামিল আমার বাসায় আসেন। তাঁরা আমারে থানায় নিয়া গিয়া আলো ভাইয়ের (কেব্ল টিভি ব্যবসায়ী) ব্যাপারে বেশ কিছু তথ্য জিজ্ঞাসা করতে থাকেন। আমাকে মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার ভয় দেখান। এ সময় মনির আমার বাসায় লোক পাঠান। তাঁরা আমার স্ত্রীকে বলেন, ১০ হাজার টাকা দিলে আমাকে ছেড়ে দেবে। আমার স্ত্রী ১০ হাজার টাকা দিয়ে দেয়। ওই টাকা নিয়ে থানায় যাওয়ার কিছুক্ষণ পর আমাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।’
কাজী সেলিনা আজমী বলেন, ‘ঘটনার পর থেকেই আমি পুলিশকে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে মনির ও নয়নের (সহোদর) জড়িত থাকার কথা বলেছি। কিন্তু পুলিশ বিশেষ করে এএসআই জামিল আমাকে বলেন, নয়ন জড়িত নয়। বরং তাঁর ভাই মনির এ মামলায় তাঁদের (পুলিশকে) সহযোগিতা করছে।’
সেলিনা আজমী বলেন, ‘তার পর থেকে পুলিশের প্রতি আমার সন্দেহের সৃষ্টি হয়। এ ব্যাপারে আমি ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার ও বর্তমান তদন্তকারী সংস্থা ডিবিকেও জানিয়েছি।’
মামলার সাবেক তদন্ত কর্মকর্তা মিরপুর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) ইয়াছিন গাজী বলেন, ‘মনিরের সঙ্গে জামিলের বন্ধুত্ব ছিল। কিন্তু ঘটনার সঙ্গে জামিল জড়িত কি না, তা আমরা জানি না’।
মনিরকে চেনেন কি না—জানতে চাইলে এএসআই জামিল প্রথমে বলেন, ‘আমি এমন কাউকে চিনি না।’
—আপনি তো সেদিন মধ্য পীরেরবাগে গিয়েছিলেন।
—‘ওই দিন ওখানে একটা ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছিল, সে জন্য গিয়েছিলাম।’
—ওই এলাকার মনিরের সঙ্গে তো আপনার সম্পর্ক, যোগাযোগ আছে?
—‘আগে সে পুলিশের সোর্স ছিল বলে তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিল। এখন তার সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।’
সম্পর্ক না থাকলে আপনি মনিরকে নিয়ে কীভাবে মামুনকে আটক করলেন
—‘আগের পরিচিত বলে মনিরকে ফোন করে এনে মামুনকে সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। পরে সম্পৃক্ততা না থাকায় তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।’
—মামুনের কাছ থেকে তো ১০ হাজার টাকা নেওয়া হয়েছিল?
—‘এ ব্যাপারে আমি কিছু জানি না।’
একপর্যায়ে এএসআই জামিল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি ঘটনার সঙ্গে জড়িত নই। মনির ও নয়ন যে এ ঘটনায় জড়িত ছিল, তা আমি আগে জানতাম না।’ তবে মনিরকে নিয়ে এই মামলার ‘তদন্ত করায়’ কোনো ভুল হয়নি বলেও দাবি করেন জামিল।
মিরপুর থানায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২১ জানুয়ারি উপপরিদর্শক (এসআই) রকিবুল ইসলাম খানের অধীনে মিরপুর এলাকায় সাদা পোশাকে দায়িত্ব পালন করেছিলেন এএসআই জামিল। কী দায়িত্ব তাঁকে দেওয়া হয়েছে—জানতে চাইলে রকিবুল ইসলাম বলেন, ‘ওই দিন সকালে জামিল বলছিল, শেওড়াপাড়ায় মাদকের কাজ আছে। দুপুরের দিকে সে শেওড়াপাড়ায় দিকে চলে যায়। অনেকক্ষণ পর সে থানায় ফোন করে মধ্য পীরেরবাগে জিয়া হায়দার খুন হওয়ার তথ্য দেয়।’
অবশ্য জামিল প্রথম আলোকে বলেছেন, মধ্য পীরেরবাগে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছিল, তিনি সেখানে তা তদন্ত করতে গিয়েছিলেন।
জামিল একা না ফোর্স নিয়ে গিয়েছেন—জানতে চাইলে রকিবুল ইসলাম বলেন, ‘যতদূর মনে পড়ে জামিল একাই গিয়েছিল।’
মামলাটি হস্তান্তরের পর ডিবি মনিরকে গ্রেপ্তার করেছিল। পরে তিনি জামিনে বের হয়ে আসেন। কিছুদিন পর চাঁদাবাজির অভিযোগে মনির র‌্যাবের হাতে ধরা পড়েন। বর্তমানে তিনি কারাগারে।
মামলার বর্তমান তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির সহকারী পুলিশ কমিশনার তৌহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ ঘটনার তদন্তে থানা-পুলিশের অবহেলা ছিল এটা সত্য। তবে এ ঘটনায় কোনো পুলিশ জড়িত থাকার বিষয়ে কিছু বলতে পারব না।’ তিনি বলেন, কেউ যদি এ ব্যাপারে অভিযোগ দেয় তা হলে কর্তৃপক্ষের নির্দেশ অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মামলার সর্বশেষ অবস্থা: এই মামলায় ডিবির হাতে গ্রেপ্তার জিতু, মামুন ও বগা সজীব নামে তিনজন কারাগারে আছেন। এই মামলায় জিয়ার বাড়ির ভাড়াটিয়া আবদুল মজিদও আসামি।
মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা ডিবির অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) মশিউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, হত্যায় জড়িত অন্যদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা করা হচ্ছে। এএসআই জামিলে ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রয়োজনে তাঁকে ডেকে জিজ্ঞাসা করা হবে।

No comments

Powered by Blogger.