সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড-অযথা কেন সন্দেহ by মোহাম্মদ আলী

সাগর-রুনি পেশাদার কাজের কারণেই খুন হয়েছেন_ এটি সাংবাদিকসহ বিভিন্ন মহলের দৃঢ় বিশ্বাস। সেই কারণে বিভক্ত সাংবাদিক মহলও এ খুনের বিচার দাবিতে এক হয়েছে। নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর দায়িত্ব গ্রহণ করেই এ হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন।


আমরা কিছুটা হলেও আশান্বিত হয়েছিলাম। অথচ তিনি নিজেই ঘোষণার শুরুতে জজ মিয়ার কথা মনে করিয়ে দিলেন। নিজেই নতুন জজ মিয়া বানিয়ে বললেন, আমি খুনিদের সত্যিকার জজ মিয়া বানাতে চাই না।
সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন খুনিদের ধরার ব্যাপারে ৪৮ ঘণ্টা সময় নিয়েছিলেন। কিন্তু ঘটনার আট মাস পরও কোনো কূল-কিনারা হয়নি। নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর দায়িত্ব পাওয়ার পরই বলেছেন, ১০ অক্টোবরের মধ্যে সাগর-রুনি হত্যারহস্য উদ্ঘাটন করা সম্ভব হবে। তিনি একদিন হাতে থাকতেই তা করেছেন। তিনি অবশ্য আগের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মতো ওয়াদার বরখেলাপ করেননি। তিনি একজন দায়িত্বশীল মন্ত্রীর মতোই তার কথা রেখেছেন। সে জন্য তাকে ধন্যবাদ দিতেই হয়। তারপরও প্রশ্ন থেকেই যায়_ তিনি কি সঠিক কাজ করেছেন? যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন, না নতুন প্রশ্নের জন্ম দিয়েছেন? এ যেন নতুন নাটক। তিনি এক সপ্তাহের মধ্যে যে আসামিদের ধরার খবর দিলেন, তারা ৭ জনই সন্দেহভাজন খুনি। এত দিন পর আমরা আশা করেছিলাম, নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এমন একটা ঘোষণা দেবেন, যাতে প্রকৃত খুনি ধরা পড়ে। প্রকৃত অপরাধীদের যেন আড়াল করা না হয়। এত দিন আইন প্রয়োগকারী সংস্থা র‌্যাব ও পুলিশ যা বলে আসছে, তাতে জনমনে যে অবিশ্বাসের জন্ম হয়েছিল, তার অবসান ঘটবে। কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যে আমরা আরও হতাশ হলাম। বিচারের বাণী যেন নিভৃতে কাঁদছে। এ ঘটনার কারণে বিচারপ্রার্থীদের আর কোনো আশ্রয়স্থল থাকল না।
আগের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন খুনিদের আট মাসেও ধরতে পারলেন না কেন? এখন প্রশ্ন ওঠে_ তাহলে কি আগের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দায়িত্ব অবহেলা করেছেন? আবার আমাদের মনে এ প্রশ্নও জাগে_ নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে যদি চমক থেকেই থাকে, তাহলে ঘোষণা দিয়ে সন্দেহভাজন খুনিদের ধরলেন কেন? আসল অপরাধী ধরতে অসুবিধা কোথায়? তাহলে কি সন্দেহভাজন আসামিদের ধরে তিনি আই-ওয়াশ করার চেষ্টা করছেন? কেন এই হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত আসামি ধরা গেল না? সরকারি গোয়েন্দা সংস্থা, র‌্যাব, পুলিশ তাহলে কি সঠিকভাবে তদন্ত করে কোনো ক্লু বের করতে পারে না?
নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ঘোষণায় সন্দেহভাজনরা গ্রেফতার হলেও বড় ধরনের সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে। এমনকি যেখানে আসামি ধরা পড়লে ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যদের খুশি হওয়ার কথা, সেখানে সাংবাদিক সাগর সরওয়ারের মায়ের প্রতিক্রিয়ায় জানা গেছে_ সংবাদ সম্মেলনে সাজানো তথ্য দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে সাগর-রুনির ভাই বলেছেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য তাদের কাছে অস্পষ্ট মনে হয়েছে। সন্দেহভাজন ব্যক্তিরা যে দোষী_ এ ব্যাপারে চরম সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে। তাহলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আসামি গ্রেফতার 'জজ মিয়া' নাটকমুক্ত_ এ কথা আমরা বলি কীভাবে?
সাত-সাতজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে পাঁচজন পেশাদার খুনি। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তারা চিকিৎসক নারায়ণ চন্দ্র দত্তকে হত্যা করেছে। অথচ ময়নাতদন্তকারী ডাক্তার বলেছেন, অপেশাদার খুনির হাতে সাগর-রুনি খুন হয়েছেন। র‌্যাব বলছে, খুনিরা পেশাদার। তাহলে আমরা কার কাছে যাই? জনগণ কার কাছে বিচার চাইতে যাবে?
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাদের একজন সাগর-রুনির 'পারিবারিক বন্ধু' তানভীরকে গ্রেফতারের কথা বলেছেন। কিন্তু র‌্যাব বলেছে, তানভীর খুনের ঘটনায় জড়িত নয়। তাহলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কিসের ভিত্তিতে তানভীরকে গ্রেফতারের নির্দেশ দিলেন? এটা তো জজ মিয়া নাটকের চেয়েও বড় ট্র্যাজিক।
একটি সত্যকে আড়াল করতে যেমন দশটি মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয়। এও যেন তেমনি একটি ঘটনা। যেসব সাংবাদিকের কাছে সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে তথ্য আছে, তদন্তকারী সংস্থার কেউ তাদের কাছে যাচ্ছেন না কেন? তাদের দেখেও যেন তারা দেখছে না! আর তাদের কথা যদি বিশ্বাস করা না যায়, তাহলে তদন্তকারী সংস্থা কোনো ক্লু বের করছে না কেন? কেন ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে প্রথমেই আলামত সংগ্রহ করা হলো না? তারপর সাংবাদিকদের আন্দোলনের চাপে সাগর-রুনির লাশ কবর থেকে তোলা হলো। এবার বলা হচ্ছে, আমেরিকায় পরীক্ষার জন্য আলামত পাঠানো হয়েছে। র‌্যাবের ভাষায়, সব পরীক্ষা শেষ হয়নি। তাহলে এসব সন্দেহভাজন আসামি ধরে কেন জনমনে নতুন সন্দেহের সৃষ্টি করা হচ্ছে?
একটি হত্যাকাণ্ডের খুনিদের আড়াল করতে সরকারের দায়িত্বশীল একটি মহল কী ভীষণভাবে তৎপর! এ ঘটনা আমাদের দেশে নতুন নয়। ২০০৪ সালে বিএনপির শাসনামলে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনার জনসভায় গ্রেনেড হামলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে 'জজ মিয়া' নাটক সাজানো হয়েছিল। হুমায়ুন আজাদ হত্যাচেষ্টার ঘটনার পর ছাত্রলীগের এক নেতাকে ধরে 'বোমা আব্বাস' উপাধি দিয়ে নাটক মঞ্চস্থ করা হয়েছিল।
বর্তমান সরকারের আমলে নরসিংদীর মেয়র লোকমান হত্যাকারীদের পৃষ্ঠপোষক মন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু লোকমানের ভাইকে ঘরে আটকে রেখে হত্যা মামলার আসামিদের নিয়ে লোকমান হত্যার বিচার চেয়েছেন। এমন নাটক দেখতে দেখতে আমরা রীতিমতো অভ্যস্ত হতে বাধ্য হয়েছি। এভাবে আর কতদিন চলবে?
nanditaali@gmail.com
 

No comments

Powered by Blogger.