কালের পুরাণ- নষ্ট গণতন্ত্রে বড় কষ্টে আছি by সোহরাব হাসান

গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত যদি হয় একটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন, সর্বজনীন ভোটাধিকার এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা (টিআইবির প্রতিবেদন অনুযায়ী যাঁদের ৫৩.৫ শতাংশ ‘অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে’ জড়িত) দেশ পরিচালনা, তা হলে বলতে হবে বাংলাদেশে গণতন্ত্র আছে, মাঝেমধ্যে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সেনাশাসনের বিরতি সত্ত্বেও।


কিন্তু গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত যদি হয় গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো আইনানুগভাবে চলা, নিজ নিজ সীমারেখা মেনে রাষ্ট্রের তিনটি বিভাগ পরিচালিত হওয়া, সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে ন্যূনতম কার্যসম্পর্ক বজায় থাকা, পরমতসহিষ্ণুতা এবং আলোচনা ও বিতর্কের মাধ্যমে সব সমস্যার সমাধান করা, তা হলে বলতে হবে সেই গণতন্ত্র বাংলাদেশে কখনো ছিল না, এখনো নেই।
অথচ বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মূলকথা ছিল গণতন্ত্র। পাকিস্তানিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মতামত অগ্রাহ্য করেছিল বলেই ১৯৭১ সালে এ দেশের মানুষ পাকিস্তানিদের পরাস্ত করে বিজয়ী হয়েছে। কিন্তু সেই বিজয় কার এবং কতটুকু বিজয়? আমরা প্রথামাফিক স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপন করি, বিজয় দিবস উদ্যাপন করি, শহীদদের স্মরণে জাতীয় স্মৃতিসৌধে গিয়ে পুষ্পমাল্য দিই। কিন্তু এসবের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য অনুধাবন করি না। আমরা গণতন্ত্রের কথা বলি। কিন্তু অন্যের সমালোচনা শুনতে চাই না। নিজের দলকে, নিজের নেতৃত্বকে, নিজের সিদ্ধান্তকে শ্রেষ্ঠ ভাবি। এর সমালোচনা মানে দেশদ্রোহিতা।
স্বাধীনতার অর্থ যদি হয় সবাই মিলে, সবাইকে নিয়ে বাঁচা, সেই স্বাধীনতা অধরাই রয়ে গেছে। স্বাধীনতার অর্থ যদি হয় আইনের শাসন, সব ধরনের গোঁড়ামি ও জবরদস্তি থেকে মুক্তি, সেই স্বাধীনতা দেশের সিংহভাগ মানুষের জীবনে এখনো আসেনি।
একটি জাতি ৬০-৭০ বছর ধরে রাজপথে আছে। গণতন্ত্রের জন্য, সামাজিক ন্যায়, রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য আমরা লড়াই করেছি। তার পরও দেশের গরিষ্ঠসংখ্যক মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে পারিনি। আমরা এমন একটি দেশে বাস করছি যেখানে কোরবানির পশু কেনার মানুষের যেমন অভাব নেই, তেমনি অভাব নেই সেই কোরবানির এক টুকরো মাংস নেওয়ার জন্য হাত পাতা মানুষেরও। নেতা-নেত্রীরা জনসংখ্যাকে জনসম্পদ বলে বড়াই করেন, অথচ পদে পদে সেই জনশক্তির অপচয় লক্ষ করি। আমরা এমন এক সমাজে বাস করছি যেখানে ন্যায় ও সত্য প্রায় নির্বাসিত, নীতি ও মূল্যবোধ প্রায় পরিত্যক্ত এবং সমাজের প্রতিটি স্তরে চলছে অসুস্থ প্রতিযোগিতা। যে যেখানে পারছে অন্যকে কোণঠাসা করছে। অপরের মুখ ম্লান করে দেওয়া ছাড়া যেন আমাদের আনন্দ নেই। অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘পাকিস্তান আমলে ছিল এক দেশ দুই অর্থনীতি আর বাংলাদেশ আমলে হয়েছে এক দেশ দুই সমাজ।’ একদিকে লাখ লাখ মানুষ ক্ষুধা জরার শিকার, অন্যদিকে গড়ে উঠছে বিত্তের পাহাড়। আমরা ১৯৪৬, ১৯৫০, ১৯৬৪, ১৯৭১, ১৯৯০, ১৯৯২, ২০০১ সালে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই করেছি। কিন্তু সেই লড়াইয়ে যে আমরা পুরোপুরি জয়ী হতে পারিনি, ভেতরের অন্ধকার দূর হয়নি, তার প্রমাণ রামুতে, উখিয়ায়, টেকনাফে বৌদ্ধবিহার ও বসতিগুলোর ওপর সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী হানা। আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেওয়ার চেয়ে এর থেকে রাজনৈতিক ফায়দা লাভের চেষ্টা চালাচ্ছে। প্রতিটি গণতান্ত্রিক সংগ্রামে-আন্দোলনে আমরা স্বজনদের হারাই, শহীদের তালিকা বাড়ে। কিন্তু যে স্বপ্ন তাঁরা দেখে গেছেন, সেই স্বপ্ন পূরণ হয় না। রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক হয় না। সমাজ আলোকিত হয় না। রাজনীতিতে জ্ঞান ও মেধার চেয়ে অর্থ ও পেশিশক্তির দৌরাত্ম্য বেশি। আমরা আন্দোলন করে, লড়াই করে পুরোনো স্বৈরাচারকে হটাই, আবার নতুন স্বৈরাচার জেঁকে বসে। ক্ষমতার হাতবদল হয়, মন্ত্রী ও সাংসদদের চেহারা বদল হয়। শাসনকাঠামোর চরিত্র বদল হয় না। নেতা-নেত্রীদের ভাগ্য বদলালেও সাধারণ মানুষের ভাগ্যের বদল হয় না।
আমাদের তরুণেরা স্বপ্ন দেখে। আমাদের যুবকেরা আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে নতুন কিছু করতে চায়। কিন্তু তাদের সঠিক পথে পরিচালিত করবে, এমন রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতৃত্ব দেখতে পাই না। কতগুলো মুখস্থ মানুষ দেখি, কতগুলো মুখস্থ কথা শুনি। যে নেতৃত্ব নিজেই দেউলিয়া, তারা অন্যকে পথ দেখাবে কী করে? যাঁরা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন এবং আছেন, তাঁরা বৃহত্তর মানুষের কথা ভাবেন না, নিজেদের নিয়ে বিভোর থাকেন। গণতন্ত্র ও স্বৈরাচারের ফারাকটি ক্রমশ ঘুচে যায়।
আমরা রাজপথে গণতন্ত্রের সংগ্রামে যতটা সফল হয়েছি, দেশ শাসন তথা গণতন্ত্র বিনির্মাণে তার সিকি ভাগও সফল হইনি। আমরা একসঙ্গে যুদ্ধ করলেও একসঙ্গে দেশ পরিচালনা করতে পারিনি। যুদ্ধের সিপাহসালারা একে অপরকে হত্যা করতে কুণ্ঠিত হননি। রাজনীতিকেরা পরস্পরের পিঠে ছুরি চালাতে দ্বিধা করেননি। ব্যক্তিস্বার্থে, গোষ্ঠীস্বার্থে কট্টর বাম নেতা ডান হয়ে গেছেন, জাতীয়তাবাদী বনেছেন মৌলবাদী। আমরা শত্রুমিত্র চিনতে বরাবর ভুল করেছি।
একদা সমাজতন্ত্রের নামে দেশের ও জনগণের সম্পদ লুণ্ঠন করা হয়েছে, শিল্প-কারখানাগুলো ধ্বংস করা হয়েছে। আর এখন দেশ লুণ্ঠিত হচ্ছে মুক্তবাজার অর্থনীতির নামে। আমরা এমন গণতন্ত্রে বাস করছি, যেখানে নিজের দলের না হলেই তাকে দেশদ্রোহী, গণবিরোধী বলে আখ্যা দিই। আমরা এমন গণতন্ত্রে বাস করছি, যেখানে মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখা হয় না, দেখা হয় সংখ্যা ও ভোটার হিসেবে। যেখানে মানবিক মূল্যবোধকে উৎসাহিত করা হয় না, অন্যকে অপমান করতে পান্ডা লেলিয়ে দেওয়া হয়। আমরা এমন অর্থনীতি গড়ে তুলেছি, যেখানে লুণ্ঠনকারী ও জালিয়াত চক্র দোর্দণ্ড প্রতাপ দেখিয়ে বেড়ায়, যেখানে ভুয়া কোম্পানি খুলে ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া যায়, আমরা এমন অর্থনীতি গড়ে তুলেছি, যেখানে জালিয়াত কোম্পানি কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার করতে পারে, আমরা এমন অর্থনীতি গড়ে তুলেছি, যেখানে ক্ষমতার বরপুত্ররা বিদেশে অর্থ পাচার করে ধরা পড়েন। আমরা এমন দেশে বাস করছি, যেখানে ধর্মের নামে, জাতিসত্তার নামে সব অন্যায়কে জায়েজ করা হয়, সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় বরাবর সংখ্যালঘুদের অধিকার হরণ করে। আমরা এমন এক সমাজে বাস করছি, যে দেশটিতে খরা-বন্যা ঘূর্ণিঝড়ের পাশাপাশি অশিক্ষা, অপুষ্টি, অনাহার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের নিয়ত সঙ্গী, যেখানে গণপিটুনিতে, র‌্যাবের-পুলিশের ক্রসফায়ারে মানুষ মারা যাচ্ছে, যেখানে অপারেশন ক্লিন হার্টে মৃত্যুর জন্য তাদের জবাবদিহি করতে হয় না। আমরা এমন গণতন্ত্রে বাস করছি, যেখানে ঈদের শুভেচ্ছা কার্ড বিনিময়ের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতার সৌহার্দ্য সীমিত। তাঁদের একজন সংসদে গেলে অপরজন সংসদ বর্জনকে অপরিহার্য মনে করেন। আমরা এমন গণতন্ত্রে বাস করছি, যেখানে সংসদে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা হয় না, গালাগাল হয়, নেত্রীর বন্দনা হয়। আমরা এমন গণতন্ত্রে বাস করছি, যেখানে আওয়ামী লীগের আমলে বিএনপি অফিস ও বিএনপির আমলে আওয়ামী লীগের অফিস পুলিশের বেষ্টনীতে থাকে। আমরা এমন গণতন্ত্রে বাস করছি, যেখানে সরকারের কাজের জন্য মন্ত্রীদের জবাবদিহি করতে হয় না, যেখানে বিরোধী দল সংসদে না গিয়েও বেতন-ভাতা ও শুল্কমুক্ত গাড়ি নেওয়াকে নেক কাজ মনে করেন। আমরা এমন গণতন্ত্রে বাস করছি, যেখানে একজন মন্ত্রী প্রকাশ্যে সাবেক মন্ত্রীর চোখ তুলে নেওয়ার হুংকার ছাড়েন, আবার বিরোধী দলের নেতারা তাঁকে রাস্তায় পেলে শায়েস্তা করার হুমকি দেন। এই গণতন্ত্রে সরকারের মহান দায়িত্ব বিরোধী দলকে নাজেহাল করা আর বিরোধী দলের একমাত্র কাজ হলো সরকার যে সিদ্ধান্তই নিক না কেন, তার বিরোধিতা করা। সরকার যদি বলে, সূর্য পূর্ব দিকে ওঠে তখনো তারা সরকারকে মিথ্যাবাদী প্রমাণ করতে বলবে, না, সূর্য একসময় পূর্বদিকে উঠলেও এখন পশ্চিম দিকে ওঠে, আবার তারা ক্ষমতায় এলে পূর্ব দিকে উঠতে পারে।
আমাদের গণতন্ত্রের মূল সমস্যা হলো নিজেকে শ্রেষ্ঠ দেশপ্রেমিক ও গণতন্ত্রপ্রেমিক প্রমাণ করা। একই সঙ্গে তাঁরা প্রতিপক্ষকে দেশবিরোধী, স্বাধীনতাবিনাশকারী হিসেবে চিহ্নিত করা। আজ যাঁরা ক্ষমতায় আছেন, তাঁরা ভাবেন দেশ ও গণতন্ত্রকে বাঁচাতে হলে চিরদিন তাঁদেরই ক্ষমতায় থাকতে হবে। যাঁরা বিরোধী দলে আছেন, তাঁরা মনে করেন, দেশ ও গণতন্ত্রকে বাঁচাতে হলে এই মুহূর্তে সরকারকে গদি থেকে টেনে নামাতে হবে। এই গদি রক্ষা আর গদি থেকে নামানোর গণতন্ত্রে রাজনীতিকেরা লাভবান হলেও দেশবাসী কিছু পায় না, তারা যেই তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই আছে। গণতন্ত্রের মূলকথা সবাইকে নিয়ে চলা, সবার সঙ্গে চলা। কিন্তু আমাদের নেতা-নেত্রীরা একে অপরের ছায়া মাড়ান না, পাছে গণতন্ত্রের পবিত্রতা নষ্ট হয়।
বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া ভারতে গিয়ে সে দেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে অঙ্গীকার করেছেন, ভারতের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করতে দেবেন না। কিন্তু তিনি বাংলাদেশের জনগণের কাছে এখন পর্যন্ত কোনো অঙ্গীকার করেননি। তিনি অঙ্গীকার করেননি তাঁর দল ক্ষমতায় এলে জঙ্গিবাদ ও মৌলবাদকে তোষণ করবে না, অঙ্গীকার করেননি তাঁর দল অতীতের মতো দেশকে নৈরাজ্যের দিকে ঠেলে দেবে না, দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হতে দেবে না।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মনে করেন, তাঁর সরকারের মতো এমন গণবান্ধব সরকার আর বাংলাদেশে আসেনি। কিন্তু সেই গণবান্ধব সরকারের আমলে কী করে শেয়ারবাজার, হল-মার্ক, পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন কেলেঙ্কারির মতো ঘটনা ঘটল, কী করে তাঁর ‘সৎ ও পরিচ্ছন্ন’ মন্ত্রিসভা কালিমালিপ্ত হলো, কী করে ছাত্রলীগের মাস্তানেরা শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস জিইয়ে রাখল, তার জবাব নেই।
আমরা এমন গণতন্ত্রে আছি, যেখানে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে কোনো কথাবার্তা নেই। ক্ষমতাসীনেরা মনে করেন, জনগণ পাঁচ বছরের জন্য তাঁদের নির্বাচিত করেছে, অতএব এই পাঁচ বছর তাঁরা যা খুশি করতে পারবেন, এই পাঁচ বছর তাঁদের শাসন-ত্রাসন সম্পর্কে কেউ কিছু বলতে পারবেন না। বললেই গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে সেটি মহা ষড়যন্ত্র হয়ে যাবে। আবার বিরোধী দল মনে করে, তারা ক্ষমতায় এলেই সব সমস্যার সমাধান হবে।
এই পাল্টাপাল্টির নামে যা চলছে, তা প্রকৃত গণতন্ত্র নয়, বড়জোর একে বলা যায় নকল বা নষ্ট গণতন্ত্র। এ নষ্ট গণতন্ত্রে দেশবাসী বড়ই কষ্টে আছে।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.