বিদেশি গণমাধ্যমে বাংলাদেশের কিছু মূল্যায়ন by মিল্টন বিশ্বাস

বিখ্যাত কলামিস্ট সদানন্দ ধুমে ৪ মে আমেরিকাভিত্তিক ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে বাংলাদেশকে একটি উদার ও দ্রুত উন্নয়নশীল সম্ভাবনাময় দেশ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হয়েও এ দেশের মুসলমানরা আক্রমণাত্মক নয় বরং অনেক বেশি সহনশীল।


তা ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ইসলামী জঙ্গিবাদ দমনে এগিয়ে বর্তমান সরকার। 'সাউথ এশিয়া টেরোরিজম পোর্টাল'-এর মতে, বর্তমান সরকারের সময় মাত্র ৯ জন জঙ্গিদের হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন। সেখানে বিএনপি-জামায়াত জোট আমলে ৫৬ জন জঙ্গি হামলায় নিহত হন। জোট সরকারের প্রত্যক্ষ মদদে জঙ্গি গ্রুপ ও দেশ-বিদেশে সক্রিয় মৌলবাদী সংগঠন হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী (হুজি) তাদের উদ্দেশ্য হাসিলে তৎপর ছিল। তাদের শীর্ষ নেতাদের ফাঁসি দেওয়ার পর নাশকতা কমে গেছে। এ দেশের মানুষ একদিকে মুসলিম, অন্যদিকে গর্বিত বাঙালি হওয়ায় জঙ্গিবাদকে কঠোর হাতে দমিয়ে রাখা গেছে। তবে জঙ্গিবাদ কমে এলেও একেবারে নির্মূল হয়নি। বিরোধী দল বিএনপি এখনো কট্টরপন্থীদের প্রতি সদয়। তবে জাতীয় রাজনীতিতে সেনাবাহিনী বর্তমানে নিষ্ক্রিয়। সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলে উপহাস করেছিলেন এবং বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর সেই মন্তব্যকে মিথ্যা প্রমাণ করে বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। কিসিঞ্জারের উত্তরসূরি হিলারির সফর সেই সত্য প্রকাশ করেছে।
ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের মতো পৃথিবীর অনেক খ্যাতনামা পত্রিকা এবং অনলাইন সংবাদে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের সফর নিয়ে মন্তব্য প্রকাশের পাশাপাশি বাংলাদেশ সরকারের সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে অবস্থানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। হিলারির সফরকে বিশ্বশান্তি ও আঞ্চলিক সহযোগিতার গুরুত্বপূর্ণ দিগন্ত হিসেবে তুলে ধরেছেন অনেকেই। সন্ত্রাসীদের ক্ষেত্রে আসাম, মিজোরাম, ত্রিপুরা, মেঘালয় প্রভৃতি সেভেন সিস্টারসকে ব্যবহার করে ভারতকে অস্থিতিশীল করার জন্য বাংলাদেশের ভূখণ্ড প্রয়োজন। এ জন্য এ অঞ্চলে সন্ত্রাস দমন ও শান্তি প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব অপরিসীম। হিন্দুস্তান টাইমস পত্রিকায় ৫ মে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বরাদ দিয়ে বলা হয়েছে, সন্ত্রাস দমন, বিশ্বশান্তি এবং স্বাস্থ্য ও খাদ্যনিরাপত্তাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে হিলারির সফরকে কেন্দ্র করে। আরো বলা হয়েছে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকলে ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ একটি মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হবে। এ জন্য বিরোধী দলের হঠকারিতা বন্ধ হওয়া জরুরি। আগের দিন বিদেশি পত্রিকাগুলো (মারকিউরি নিউজ ডটকম, যুক্তরাষ্ট্র) বলেছে, ২০১৪ সালের মধ্যে আফগানিস্তানের মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার করতে চায় আমেরিকা। সে ক্ষেত্রে এ অঞ্চলের শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের অবদান থাকতে হবে। ৪ মে হিলারির সফর সম্পর্কে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের বিষয় তুলে ধরেছে গালফ নিউজ। দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের মতো এখানেও বাংলাদেশকে অগ্রগামী ও উন্নয়নে গতিশীল দেশ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ৫ মে চ্যানেল নিউ এশিয়া সংবাদে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ মধ্যপন্থী, গণতান্ত্রিক, সহিষ্ণু মুসলিম অধ্যুষিত দেশ, যারা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। সেখানে একটি মন্তব্য ছিল এ রকম- Bangladesh is �a voice for regional stability in a troubled region|� Bangkok Post article একই কথা লিখেছে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সত্ত্বেও বাংলাদেশ একটি মধ্যপন্থী গণতান্ত্রিক মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ ও সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রের সহযাত্রী এবং বিশ্বের মধ্যে এ দেশেরই কেবল জাতিসংঘের বৃহত্তম শান্তিরক্ষী বাহিনী রয়েছে।
হিলারির আগমনকে উপলক্ষ করে যেমন সংবাদ পরিবেশিত হয়েছে, তেমনি আবার ৬ মে ঢাকা ত্যাগ করার পর দেশ-বিদেশের পত্রপত্রিকায় তাঁর সফর নিয়ে বিচিত্র মত ও মন্তব্য প্রকাশিত হয়েছে। কোনো কোনো পত্রিকা মনে করে, তাঁর সফরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ইস্যু উপেক্ষিত হয়েছে; প্রাপ্তি নেই বললেই চলে। কেউ কেউ বলেছেন, প্রভাবশালী দুই দেশের মন্ত্রীদের সফরের মধ্যে রাজনৈতিক অঙ্গনে সমঝোতা প্রতিষ্ঠার চাপ বেড়েছে। নির্দলীয়-নিরপেক্ষ ও সব দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে সর্বগ্রাহ্য নির্বাচনের দাবিটিও প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। কয়েকজন বিশ্লেষক মনে করছেন, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন তাঁর দেশের স্বার্থেই নিজ উদ্যোগে ঢাকায় এসেছিলেন। ঢাকা সফরকালে তিনি মার্কিন স্বার্থরক্ষা করেই ফিরে গেছেন। অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, অবকাঠামো উন্নয়ন না হলে বিনিয়োগ নয়, দুর্নীতি দূর করতে হবে, মানবাধিকারের প্রতি সম্মান দেখাতে হবে, রাজনৈতিক সংঘাতের পরিবর্তে সংলাপ জরুরি এবং দল নয়, রাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বড় করে দেখেছেন হিলারি। আর এগুলো বাস্তবায়ন করলেই অর্থনীতিতে গতি আসবে। আবার কেউ কেউ বলছেন, বাংলাদেশি পণ্যে শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা দেওয়ার ব্যাপারে তিনি কোনো আশার কথা আমাদের জানাননি। আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরীও হিলারি-প্রণব কেন এসেছিলেন, সে সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিয়ে কলাম লিখেছেন ৮ মে একটি পত্রিকায়। নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে কথা উঠলেও হিলারি ক্লিনটন এ ইস্যুতে কোনো পক্ষ নেননি। বরং তিনি জাতীয় ইস্যুতে মতৈক্য প্রতিষ্ঠার ওপর জোর দিয়েছেন; রাজনীতিকরা আলোচনার টেবিলে বসে দেশের সংকট নিরসনে ভূমিকা নেবেন বলেও মন্তব্য করেছেন। অনেকেরই ধারণা, আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ন্যাটোর সামরিক তৎপরতায় বাংলাদেশকে যুক্ত করতে চায় আমেরিকা। এ জন্য বিভিন্ন বৈঠকে হিলারি বাংলাদেশের উন্নতি ও অগ্রগতির প্রশংসা করেছেন। গণতন্ত্রকে সুসংহত করতে সংলাপের কোনো বিকল্প নেই বলেছেন। বাংলাদেশ সম্পর্কে হিলারির ইতিবাচক মনোভাবের কারণে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা ফোরাম চুক্তি (টিকফা) স্বাক্ষরের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু এসব ছাপিয়ে আমাদের কাছে সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় বর্তমান সরকারের সাফল্যের স্বীকৃতি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৫ মে হিলারিকে বলেছেন, তিনি সন্ত্রাসের কারণে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পরিবারের ১৮ জনকে হারিয়েছেন; তিনি নিজে সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়েছেন ১৯ বার। এ কারণেই সন্ত্রাসবাদের বিপক্ষে তাঁর অবস্থান। ৯ মে আবার তিনি আধুনিক বিশ্বের ভীতিকর সন্ত্রাসবাদ, মৌলবাদ এবং অন্যান্য চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার কথা বলেছেন। ঢাকায় অনুষ্ঠিত সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যবিষয়ক এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলনে (সিডিএমএফ) তিনি বলেন, সন্ত্রাসবাদ ও মৌলবাদের মতো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে বিশ্বশান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার জন্য সব সংস্কৃতির মানুষকে নিজেদের ঐতিহ্য ভাগাভাগি করে নিতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর এ কথা বিশ্ব মিডিয়ায় বাংলাদেশকে ইতিবাচক রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত করার প্রসারিত মতাদর্শ। আবার বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের কাছে বর্তমান সরকারের স্বীকৃতি পাওয়ার ফলও এটি। বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন অব্যাহত থাকবে বলে হিলারি ৫ মে ঢাকায় জানিয়েছেন এবং বলেছেন, আইনের শাসন ও স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজনে কঠোর হওয়াকে তারা সমর্থন করে। অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো উপলব্ধি করছে। এ জন্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সহায়তার প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে হিলারির কাছ থেকে। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ কোনোভাবে সন্ত্রাসের চারণভূমি হয়ে উঠুক- এটা কেউ দেখতে চান না। সন্ত্রাসের প্রতি জিরো টলারেন্স বা নূ্যনতম ছাড় না দেওয়ায় বাংলাদেশের অবস্থানের প্রশংসা করেন তিনি। তা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশ বাণিজ্যিক সম্পর্কে গভীরভাবে জড়িত। এ দেশে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ এক বিলিয়ন ডলারেরও বেশি; উত্তরোত্তর তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০১০-১১ অর্থবছরে বাংলাদেশ রপ্তানি করেছে ৪ দশমিক ৫৯ বিলিয়ন ডলার, যা মোট আয়ের ২৫ শতাংশ। পক্ষান্তরে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানি ব্যয় ছিল ১ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার। এ বছরের এপ্রিলের মধ্যে তারা অর্থ সহায়তা করেছে ৫ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার। ইউএস এইড-পরবর্তী পাঁচ বছরে আরো ৪০ মিলিয়ন ডলার সহায়তা দেবে, যা দেশের স্বাস্থ্যসেবার মান বৃদ্ধিতে কাজে লাগানো হবে বলে জানা গেছে।
সন্ত্রাস দমনে বাংলাদেশের সাফল্যের স্বীকৃতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে অব্যাহত থাকবে বলে আমরা মনে করি। কারণ বাংলাদেশ কোনোভাবে সন্ত্রাসীদের চারণভূমি হয়ে উঠুক হিলারির কাছে যেমন আকাঙ্ক্ষিত নয়, তেমনি আমাদের কাছেও। ৮ মে নয়াদিলি্লতে তিনি পাকিস্তানকে জঙ্গি তৎপরতা দমনে আরো সক্রিয় হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র হলেও পাকিস্তানের বর্তমান কর্মকাণ্ডে তাদের আস্থা নেই; তারই প্রকাশ ঘটেছে এ আহ্বানে। কারণ পাকিস্তানে আশ্রয় নেওয়া সন্ত্রাসীদের হামলায় খোদ সে দেশেরই ৩০ হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। এ রকম অবস্থার শিকার আমরা হতে চাই না। তাই সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা সমুন্নত থাকবে- এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
email-dr.miltonbis@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.