মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার-গোলাম আযমের বিচার শুরু-অভিযোগ গঠন, ৫ জুন সাক্ষ্যগ্রহণ

একাত্তরে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় অভিযোগ গঠন করা হয়েছে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আযমের বিরুদ্ধে। এর মধ্য দিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হলো।
বাংলাদেশে ৩০ লাখ নিরস্ত্র বাঙালি হত্যা, দুই লাখ নারীকে ধর্ষণ, এক কোটি মানুষকে দেশান্তর করাসহ


মানবতাবিরোধী অপরাধের মূল পরিকল্পনাকারী, ষড়যন্ত্রকারী, উসকানিদাতা, প্ররোচনাকারী এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মুক্তিযোদ্ধা সিরু মিয়াসহ ৩৮ ব্যক্তিকে হত্যাকারী হিসেবে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের ৩(২)(এ, জি, এইচ, এফ) এবং ৪(১ ও ২) ধারায় এসব অভিযোগ গঠন করা হয়। গণহত্যাসহ পাঁচ ধরনের অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে অভিযুক্ত শীর্ষ ব্যক্তির বিচার শুরু হলো।
বিচারপতি নিজামুল হকের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ গতকাল রবিবার এ অভিযোগ গঠন করে আদেশ দেন।
ট্রাইব্যুনাল গোলাম আযমের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে আগামী ৫ জুন সাক্ষ্যগ্রহণ এবং রাষ্ট্রপক্ষের সূচনা বক্তব্য উপস্থাপনের দিন ধার্য করেছেন। একই সঙ্গে গোলাম আযমের পক্ষে যদি কোনো সাক্ষী থাকে তবে তার তালিকা ও ডকুমেন্ট এদিনের মধ্যে ট্রাইব্যুনালে দাখিল করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় এ নিয়ে তিনজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হলো। এর আগে জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ও বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়।
গোলাম আযম অবশ্য নিজেকে নির্দোষ দাবি করে বলেছেন, 'আমি যুদ্ধাপরাধী নই। এ ছাড়া ১৯১ জন যুদ্ধাপরাধীকে ক্ষমা করে দেওয়ার পর শেখ মুজিবুর রহমান সরকার দালালদেরও সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। দালালদের তালিকায় আমার নাম থাকায় সে হিসেবে আমি ক্ষমাপ্রাপ্ত।'
তবে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী (প্রসিকিউটর) জেয়াদ আল মালুম সাংবাদিকদের বলেন, স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী যেসব অপরাধ হয়েছে তার মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন গোলাম আযম। তিনি নাটের গুরু।
গোলাম আযমের আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক সাংবাদিকদের বলেন, 'ট্রাইব্যুনালের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, আইনের দৃষ্টিতে সঠিকভাবে অভিযোগ গঠন করা হয়নি। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। আর রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বিচার করা হলে সেটা ন্যায়বিচার হয় না।'
গত বছরের ১২ ডিসেম্বর গোলাম আযমের বিরুদ্ধে ৫২টি ঘটনায় শতাধিক অভিযোগে ফরমাল চার্জ দাখিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। এ ফরমাল চার্জ যথাযথ হয়নি উল্লেখ করে ট্রাইব্যুনাল ২৬ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপক্ষকে তা ফেরত দেয়। এরপর গত ৫ জানুয়ারি নতুন করে ৬২টি অভিযোগে ফরমাল চার্জ দাখিল করা হয়। ফরমাল চার্জের সঙ্গে দাখিল করা হয় ৩০ খণ্ডে কয়েকশ ডকুমেন্ট। ট্রাইব্যুনাল সব কিছু বিবেচনা করে রাষ্ট্রপক্ষের ৬১টি অভিযোগ বিচারের জন্য গত ৯ জানুয়ারি ফরমাল চার্জ আমলে নেন। এরপর ১১ জানুয়ারি গোলাম আযমকে ট্রাইব্যুনালে হাজির হওয়ার নির্দেশ দিলে সেদিন তিনি হাজির হয়ে জামিনের আবেদন করেন। ট্রাইব্যুনাল আবেদন খারিজ করে তাঁকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। এরপর অসুস্থতার কারণে তাঁকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের প্রিজন সেলে নেওয়া হয়। এখনো তিনি সেখানেই রয়েছেন।
রাষ্ট্রপক্ষের অভিযোগ, ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যা, একাত্তরের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যদের হাতে হত্যা, গুম, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও নারীর সম্ভ্রমহানিতে 'প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ' সহায়তা করা, দলীয় সদস্যদের দিয়ে রাজাকার-আলবদর-আলশামস প্রভৃতি বাহিনী গঠনের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁর পরিবার, সংখ্যালঘুদের হত্যা-গুমসহ যাবতীয় মানবতাবিরোধী অপরাধে প্ররোচনা দেওয়া, ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে উন্মাদনা সৃষ্টির মাধ্যমে রক্তাক্ত হানাহানি সৃষ্টি ও জনপদ ধ্বংস করার অপরাধ করেছেন। এসব মানবতাবিরোধী অপরাধের মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন গোলাম আযম।
তাঁর নেতৃত্বেই সহযোগী বাহিনী : ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান সকাল ১০টা ৩৫ মিনিট থেকে বেলা পৌনে ১টা পর্যন্ত অভিযোগ গঠনের আদেশ পড়ে শোনান। আদেশে বলা হয়, রাষ্ট্রপক্ষ থেকে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে ফরমাল চার্জে যেসব তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করা হয়েছে সেগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও যাচাই-বাছাই করে দেখা গেছে, গোলাম আযমের নেতৃত্বে দেশের বিভিন্ন জায়গায় শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর, আলশামসু, মুজাহিদ কমিটির নামে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগী হিসেবে একাধিক সংগঠন গঠন করা হয়। এ ছাড়া দেশ স্বাধীন হওয়ার পর 'পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটি' নামে একটি কমিটি গঠন করে তিনি মধ্যপ্রাচ্যসহ মুসলিম দেশগুলোতে বাংলাদেশের বিপক্ষে জনমত গঠনের চেষ্টা করেন। তিনি লন্ডন থেকে 'সোনার বাংলা' নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করে সেখানে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের অপপ্রচার চালাতেন। ১৯৭৫ সালে সৌদি আরব ভ্রমণ করে সেখানে গোলাম আযম আভিযোগ করেন, একাত্তর সালে বাংলাদেশের হিন্দুরা মুসলমানদের হত্যা করেছে, কোরআন পুড়িয়েছে, মসজিদ ভেঙেছে। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের দুষ্কৃতকারী ও অনুপ্রবেশকারী হিসেবে উল্লেখ করেন। তাঁর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধ, গণহত্যাসহ রাষ্ট্রপক্ষের অভিযোগে বিচার চালানোর মতো প্রাথমিক উপাদান থাকায় অভিযোগ গঠন করা হলো।
আদেশে আরো বলা হয়, তাঁকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার আবেদন আইনের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য না হওয়ায় তা খারিজ করা হলো। এরপর ট্রাইব্যুনাল একটি একটি করে অভিযোগ পড়ে শোনান এবং শেষে অভিযোগ গঠন করে আদেশ দেন।
নিজেকে দোষী মনে করেন না গোলাম আযম : এরপর ট্রাইব্যুনাল গোলাম আযমের কাছে জানতে চান, তিনি এসব অভিযোগে অভিযুক্ত কি না। জবাবে গোলাম আযম বলেন, 'এত অল্প সময়ে এত কথা বলা যাবে না। তবে আমি নিজেকে দোষী বলে মনে করি না।' এরপর তিনি চারদলীয় জোট গঠন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কারাবরণ ইত্যাদি বিষয়ে রাজনৈতিক বক্তব্য দেওয়া শুরু করেন। ট্রাইব্যুনাল তাঁকে এসব বক্তব্য না দিয়ে বসার অনুরোধ করেন। কিন্তু তিনি বক্তব্য দেওয়া অব্যাহত রাখতে চান। শেষ পর্যন্ত ট্রাইব্যুনাল তাঁকে থামিয়ে দেন।
অভিযোগগুলো যাতে ভালোভাবে শুনতে পারেন সে জন্য গোলাম আযমকে এজলাসের কাছে সাক্ষীর কাঠগড়ায় বসতে দেওয়া হয়। অভিযোগ গঠনের বিষয়ে লিখিত আদেশ পড়া শুরু হলে গোলাম আযম মাথার টুপি খুলে টেবিলে রাখেন। অভিযোগ পড়ে শোনানোর পর আদালত তাঁর বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি টুপি পরে নেন এবং দাঁড়িয়ে বক্তব্য দেওয়া শুরু করেন। ওই সময় তাঁর স্ত্রী আফিফা আযম, ছেলেসহ (সাবেক সেনা কর্মকর্তা) কয়েকজন আত্মীয় ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত ছিলেন।
যত অভিযোগ : গোলাম আযমের বিরুদ্ধে অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বরের নির্বাচনের আগে থেকেই পাকিস্তানের সামরিক জান্তার সঙ্গে গোলাম আযমের যোগাযোগ ছিল। নির্বাচনের পরও এই যোগাযোগ অব্যাহত ছিল। ওই অবস্থায় ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চ লাইট শুরু হয়। পাকিস্তানি সামরিক জান্তা এ অভিযানের মাধ্যমে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর হামলা চালাতে থাকে। এর কয়েক দিন পর ৪ এপ্রিল গোলাম আযমসহ কয়েকটি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ও 'খ' অঞ্চলের সামরিক আইন প্রশাসক টিক্কা খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সেখানে তাঁরা ২৫ মার্চ সার্চ লাইটের নামে সেনা অভিযানের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেন। ওই বৈঠকেই পাকিস্তানি বাহিনীকে সব ধরনের সহযোগিতা করতে তাঁরা অঙ্গীকার করেন। এ অভিযানের প্রতি জনমত গঠন করতে একটি নাগরিক কমিটি গঠন করারও প্রস্তাব করেন তাঁরা।
অভিযোগে আরো বলা হয়, ৬ এপ্রিল গোলাম আযম সাবেক মন্ত্রী হামিদুল হক চৌধুরীকে নিয়ে টিক্কা খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সেখানে শান্তি কমিটি গঠন করা নিয়ে আলোচনা হয়। এর কয়েক দিন পর খাজা খায়ের উদ্দিনকে আহ্বায়ক করে ১৪০ সদস্যের শান্তি কমিটি হয়। এ কমিটির দৈনন্দিন কাজ তদারক করতে ছয় সদস্যের একটি উপকমিটি করা হয়। এই উপকমিটিতে ২ নম্বরে ছিল গোলাম আযমের নাম।
সহযোগী বাহিনীর ক্যাম্পে ক্যাম্পে ঘুরে সালাম গ্রহণ : অভিযোগে বলা হয়, সারা দেশে শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর, আলশামস, পাইওনিয়ার ফোর্স, মুজাহিদ বাহিনী গঠনে মূল ভূমিকা ছিল গোলাম আযমের। এসব সংগঠনকে অস্ত্র সরবরাহ করা এবং এ বিষয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কাছে সুপারিশ করার দায়িত্ব গোলাম আযমই পালন করতেন। জামায়াতে ইসলামী, তাদের ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘ এবং জমিয়তে তালাবায়ে আরাবিয়ার মাধ্যমে এসব বাহিনীতে লোক নিয়োগ করা হতো। তিনি সারা দেশ ঘুরে এসব বাহিনীর সামরিক প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ ও কুচকাওয়াজ পরিদর্শন করে সালাম নিয়েছেন। রাজাকার বাহিনীতে সদস্য ও অস্ত্র সরবরাহ বাড়ানোর আবেদন করেছেন।
মুক্তিযোদ্ধা সিরু মিয়াসহ ৩৮ জনকে হত্যায় সম্পৃক্ততা : অভিযোগে আরো বলা হয়, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ঈদের দিন গভীর রাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কারাগার থেকে মুক্তিযোদ্ধা সিরু মিয়া, তাঁর ছেলেসহ ৩৮ জনকে কারাগার থেকে বের করে কৈরতলা এলাকায় নিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় গোলাম আযম সম্পৃক্ত ছিলেন।
দলীয় লোকদের বিরত না রেখে অপরাধের নেতৃত্বদান : অভিযোগে বলা হয়, একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান হয়ে তাঁর উচিত ছিল ওই সব অপরাধের সঙ্গে সস্পৃক্ত না হওয়া এবং তাঁর দলের লোকদের বিরত রাখা। তা না করে উল্টো তিনি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে অপরাধের নেতৃত্ব দিয়েছেন।
অভিযোগে আরো বলা হয়, স্বাধীনতাবিরোধী কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখার অংশ হিসেবে গোলাম আযম মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন মুসলিম দেশ সফর করেন। সেখানে প্রায় ৪৫ লাখ টাকার সমপরিমাণ ওই দেশের অর্থ জোগাড় করে তার কিছু অংশ লন্ডন থেকে বাংলাদেশে (পূর্ব পাকিস্তান) পাঠান।
অভিযোগে আরো বলা হয়, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও গোলাম আযম দেশের স্বাধীনতা মেনে নিতে পারেননি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ার জন্য মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে প্রকাশ্যে তদবির চালান। এ জন্য তিনি ১৯৭৫ সালে সৌদি বাদশাহর সঙ্গে রাজপ্রাসাদে বৈঠক করেন।
অভিযোগে বলা হয়, ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশে ফিরে তিনি জামায়াতে ইসলামীর আমির পদে বসেন। তিনি দেশে ফিরে একাত্তরে তাঁর অপরাধের জন্য ক্ষমা চাননি। বরং তাঁর অবস্থান সঠিক ছিল- এটা প্রমাণের চেষ্টা করেছেন বারবার।

No comments

Powered by Blogger.