বহে কাল নিরবধি-সরকার ও ১৮ দলীয় জোট : উভয়ের শূন্যগর্ভ আস্ফালন by এম আবদুল হাফিজ

চাকরিজীবনের ঊষালগ্নে চাকরিতে জ্যেষ্ঠদের কাছ থেকে প্রায়ই একটি আপ্তবাক্য শুনতাম : Honest work, Modest talk, বাংলায় যার ভাবার্থ দাঁড়ায়- উচ্চবাচ্য নয়, নিবিষ্ট মনে কাজই লক্ষ্য। সম্প্রতি দেশে আইনশৃঙ্খলা সংশ্লিষ্ট কিছু ব্যর্থতার চিত্র উঠে এসেছে।


লোকে মনে করে- সততা, আন্তরিকতা ও নিষ্ঠা সাপেক্ষে সেগুলোতে সাফল্য অর্জন অসম্ভব নয়। দেশের বর্তমান দমননীতি ও মামলা-হামলায় জর্জরিত করে বিরোধী দল ও ভিন্নমতাবলম্বীদের কণ্ঠরোধ হলেও সাংবাদিক সম্প্রদায় ও বহুল আলোচিত সাগর-রুনির স্বজন এবং দেশের আপামর জনসাধারণ এই সাংবাদিক দম্পতি হত্যাকাণ্ডের দায়সারা তদন্ত ও তাতে অযৌক্তিক দীর্ঘসূত্রতা কর্তৃপক্ষের আন্তরিকতা ও নিষ্ঠাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যে ইস্যুতেই মুখ খুলেছেন বা তর্জনগর্জন করেছেন, তা সে সুরঞ্জিতের এপিএসের ড্রাইভারের ব্যাপারেই হোক বা সৌদি কর্মকর্তা খালাফের হত্যাকারী শনাক্ত করতেই হোক অথবা দেশ কাঁপানো ইলিয়াস নিখোঁজই হোক- মন্ত্রী মহোদয়ার সব দাবি ও আশ্বাস শূন্যগর্ভ প্রমাণিত হয়েছে। তিনি শুধু ধৈর্যধারণের পরামর্শ দিয়েছেন এ পর্যন্ত। কোনোটার জট খুলতে পারেননি তাঁর মন্ত্রণালয় বা তিনি।
তবে হ্যাঁ, সাফল্য তো তাঁর এক জায়গায় অনস্বীকার্য। সেটা বিরোধী দলকে ঠেঙানোয়। এবং তা এই মাত্রায় যে বিরোধী দল জনদুর্ভোগের অপবাদ নিয়ে হরতাল করলেও তা ছিল হরতালের নামে ইঁদুর-বিড়ালের লুকোচুরি। তাঁর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বদৌলতে ১৮ দলীয় জোট না পেরেছে হরতালের প্রতীকী চিহ্ন রাজপথে মিছিল বের করতে বা কোনো জমায়েত করে বক্তব্য দিতে। তাঁর দায়িত্ব যদিও নিরপেক্ষভাবে শৃঙ্খলা বজায়, তাঁর বাহিনী কিন্তু তাঁর দলের লাঠিয়ালদের সঙ্গে একীভূত হয়ে যৌথ বাহিনীর অ্যাকশনে প্রবৃত্ত হয়েছে। তবু এর জন্যও হয়তো তাঁর কৃতিত্ব প্রাপ্য এবং তাতে কেউ কোনো আপত্তি করত না, যদি তিনি একই রকম দক্ষতার সঙ্গে ওপরে আলোচিত ব্যর্থতাগুলো ঠেকিয়ে বিষয়গুলোর একটি সুরাহা করতে পারতেন।
কিন্তু তেমনটি হয়নি। কেননা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয়াকে তো দলের স্বার্থও সংরক্ষণ করতে হবে। জাতি ও জনগণের স্বার্থ মুলতবি থাকতে পারে। কিন্তু তাঁর দলের স্বার্থে দলকে অগ্রাধিকার দিয়ে তাঁকে আনুগত্য প্রকাশ করতে হবে। সাগর-রুনি থেকে শুরু করে অধুনা ইলিয়াসের নিখোঁজ ইস্যু পর্যন্ত- সব কিছুকে তিনি দুর্ভেদ্য চাদরে ঢেকে দিয়েছেন। তিনিসহ সরকারি দলের ধারণা হয়তো এই- দীর্ঘসূত্রতার মাধ্যমে সেগুলোকে গণমানস থেকে মুছে দিতে পারলেই সম্ভবত কেল্লাফতেহ। এই ইস্যুগুলোর কাঁটা থেকে তাঁদের আগামীর পথ নিষ্কণ্টক হবে।
তা হবে কিছু সময়ের জন্য। আমি সব সময়ই বলি যে আন্দোলন-বিক্ষোভ প্রশমিত করতে একটি সরকারের অনেক অস্ত্র হাতে থাকে, যা একটি সরকার একের পর এক প্রয়োগ করতে পারে না। এই যে সরকার বিরোধী দলের আন্দোলন ঠেকাতে তার দমননীতি প্রয়োগ করল, তাতে অভিনবত্ব খুব একটা নেই। অতীতে সেই পাকিস্তান আমল থেকে বহুবার তা প্রয়োগ হয়েছে। অনেকের দৃষ্টিতে হরতাল যেমন 'ভোঁতা' হয়েছে, তেমনি হয়েছে দমননীতি। আওয়ামী লীগের চেয়ে তা ভালো করে আর কেউ জানে না।
এই পর্যায়ে বিএনপি নেতা-কর্মীরা গা-ঢাকা দিয়ে পালিয়ে থাকবেন কিছুদিন। অতঃপর পুনঃসংগঠিত হয়ে মাঠে নামবেন। আমাদের পুরো স্বাধীনতা সংগ্রামটিই তো এভাবেই এগিয়েছিল। আওয়ামীরা কি তা জানে না? তা ছাড়া ১৮ দলীয় জোট তো সবেমাত্র প্রয়োজনীয় কিন্তু অপ্রধান ক্ষেত্রেই তাদের আন্দোলনকে সীমাবদ্ধ রেখেছে। আওয়ামীদের মতো তাদেরও চূড়ান্ত লক্ষ্য ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিজয় মুকুট ছিনিয়ে আনা।
এ কথা মনে রাখতে হবে যে বড় দুই দলের যেকোনো একটিকে ছাড়া এ দেশে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য কোনো নির্বাচন হবে না। কিভাবে কার অধীনে সে নির্বাচন হবে, সে ইস্যুতে কিন্তু এখনো কোনো ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কিন্তু সরকার ইতিমধ্যেই একতরফাভাবে সাংবিধানিক সংশোধনী এনে তাদের অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের ফন্দিফিকির করছে। এদিকে বিএনপির ধনুক ভাঙ্গা পণ যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহাল ছাড়া তারা নির্বাচনে যাবে না। চলমান অন্তর্দলীয় বিবাদে এটাই হলো কেন্দ্রীয় ইস্যু। একটি গতানুগতিক আলটিমেটাম বিএনপির তরফ থেকে দেওয়া থাকলেও এই ইস্যুতে কিন্তু এখনো আন্দোলন 'লাগাতার হরতাল'-এর পর্যায়ে পৌঁছেনি।
সমস্যা যে বড় দুটি দলের জন্যই। এই নির্বাচন পদ্ধতির বিতর্কে উভয়ের অস্তিত্বের প্রশ্ন জড়িত। সন্দেহ নেই যে বিএনপির অতীত ট্র্যাক রেকর্ড ভালো নয়। তাই তারা ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার নীলনকশা বানিয়েও শেষ পর্যন্ত জনরোষে পতিত হয় এবং ক্ষমতার বলয় থেকে ছিটকে পড়ে। আওয়ামী লীগের জন্য পরিহাসেরই বিষয় যে বিএনপির এত বড় বিপর্যয় থেকে তারা কোনো ধরনের শিক্ষা গ্রহণ না করে ওই একই পরিত্যক্ত পথ মাড়িয়েছে এবং প্রকাশ্য জনরোষে না পড়লেও একটি প্রচণ্ড বৈরী রাজনৈতিক ঝড়ের মুখে যে তারা পড়তে যাচ্ছে, তা তারা বুঝতে পেরেছে এবং সস্তা কিরাকসমে প্রবৃত্ত হয়েছে। অবিকল বিএনপি নেত্রীর স্টাইলে ভাষা ও শব্দচয়ন অবিকৃত রেখে শেখ হাসিনা জনতার উদ্দেশে বলে চলেছেন একই কথা। বলছেন যে তিনি তাঁর মেয়াদে বিভিন্ন খাতে কী অসাধ্য সাধন করেছেন, যা চলমান থাকবে- যদি তিনি তাঁর দলকে নিয়ে আবার ক্ষমতায় আসতে পারেন। সহস্রাব্দের প্রথম দশকে ম্যাডাম জিয়াও 'উন্নয়নের ধারা' অব্যাহত রাখতে তাঁকেই পুনর্নির্বাচিত করার কথা বলতেন। কিন্তু জনগণ ভ্রূক্ষেপও করেনি।
হায় রে ডিজিটাল বাংলাদেশ, ২০২০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়া এই ললিপপগুলো আমারও চুষতে ইচ্ছে করে। জানি না, অত দিন হয়তো বাঁচব না, তবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব যে পথে হাঁটছে, তা দেখতে বাঁচারও বড় একটা ইচ্ছা করে না। রাজনীতির আরো বিকৃতি দেখতে কারো সে ইচ্ছা করবে না।
সাগর-রুনির ভাগ্য, নিখোঁজ ইলিয়াসকে নিয়ে তাঁর পরিবারের শঙ্কা, দেশজুড়ে হত্যা, গুম ও নৃশংসতা যদি এ দেশের বাস্তবতা হয়- সেই বাস্তবতাকে পাল্টানোর উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে বলতে ইচ্ছা করে, শীর্ষ নেত্রীদ্বয়ের বস্তাপচা রাজনীতি ও দেশ শাসন থেকে আমাদের মুক্তি হোক। গণতন্ত্রের মানসপুত্র সোহরাওয়ার্দী, মুক্ত বাংলার ব্যাঘ্র কৃষক-বন্ধু এ কে ফজলুল হক এবং বঙ্গবন্ধুর মতো সুসাহসী নেতাদের দেশ ১৬ কোটি মানুষের আবাসভূমি এই বাংলাদেশে আমরা কি এর চেয়ে একটু প্রজ্ঞাবান দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্ব পাওয়ার বা তৈরি করার যোগ্যতা রাখি না?

লেখক : সাবেক মহাপরিচালক,
বিআইআইএমএস ও কলামিস্ট

No comments

Powered by Blogger.