পানি-সংকট-ন্যায়ভিত্তিক পানি ব্যবস্থাপনাই টেকসই পথ by জহির উদ্দিন চৌধুরী

পানি অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও সামাজিক অগ্রগতির অন্যতম চাবিকাঠি। টেকসই উন্নয়নের স্বীকৃত পদ্ধতি হলো ভবিষ্যত্ প্রজন্মের স্বার্থ ক্ষুণ্ন না করে বর্তমান প্রয়োজন ও আকাঙ্ক্ষা মেটানোর চেষ্টা। বর্তমান প্রয়োজন মেটাতে গিয়ে অন্যের এবং পরিবেশের ক্ষতি করা যাবে না। পানি ব্যবস্থাপনায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই সংযম অনুসৃত হচ্ছে না।


১৯৬৪ সালে একটি মাস্টার প্ল্যান প্রণয়নের মাধ্যমে পানি ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক বিনিয়োগ শুরু হয়। এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের সাহায্যে প্লাবনভূমিকে বন্যামুক্ত করে আমন ধানের উৎপাদন বাড়ানো। দেশের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ এলাকা এ ধরনের প্রকল্পের আওতায় আসে। কিন্তু বন্যানিয়ন্ত্রণ প্রকল্প ও আমন ধান উৎপাদনের ৩০ বছরের উপাত্ত নিয়ে গবেষণার ফল দেখায় যে সার্বিকভাবে আমন ধান উৎপাদন বাড়েনি। তবে বাংলাদেশে মোট ধান উৎপাদন ব্যাপকভাবে বাড়লেও তার কৃতিত্ব মূলত শুষ্ক মৌসুমে সেচব্যবস্থার। জলাভূমিসমৃদ্ধ বৃহত্তর জেলাসমূহে বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পের আওতাভুক্ত জমি অনেক বেশি, অথচ আমন ধান উৎপাদন বৃদ্ধি তুলনামূলকভাবে নগণ্য। অন্যদিকে, বাঁধের সাহায্যে প্লাবনভূমিকে বন্যামুক্ত করার কারণে বন্যার পানি জমার জায়গা কমে গিয়েছে। ফলে বৃদ্ধি পেয়েছে অন্য এলাকায় বন্যার উচ্চতা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এর বিরূপ প্রভাবের শিকার হয়েছে দরিদ্র জনপদ। এভাবে বন্যার ঝুঁকি এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় কেবল স্থানান্তর হচ্ছে, আসলে বন্যা কমছে না। বরং বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পের কারণে বহু জলাভূমি সংকুচিত বা ধ্বংস হয়েছে। অথচ প্লাবনভূমির পানিচক্র প্রক্রিয়ায় এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় জলাভূমির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। এটাই প্রমাণ যে, পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করে টেকসই উন্নয়ন হয় না।
বন্যানিয়ন্ত্রণ প্রকল্পের কারণে সমাজের অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর উল্লেখযোগ্য অংশের জীবিকা বিঘ্নিত হয়েছে। প্লাবনভূমিকে নদী থেকে বিচ্ছিন্ন করার ফলে মাছের চারণক্ষেত্র ধ্বংস ও মৎস্যসম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে দরিদ্র মানুষ হারিয়েছে প্রয়োজনীয় আমিষের উৎস। উপকূলীয় অঞ্চলে বন্যা নিয়ন্ত্রণ পোল্ডারের কারণে জোয়ারের পানি প্রবেশের পরিমাণ কমেছে। এতে নদীর তলদেশ ভরাট হয়েছে এবং সৃষ্টি হয়েছে মারাত্মক জলাবদ্ধতা। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত ভবদহ এলাকার জলাবদ্ধতা এর বড় উদাহরণ। বংশানুক্রমিক বসতভিটে ছাড়তে বাধ্য হয়েছে বহু লোক। নদীর গভীরতা কমে যাওয়ায় নৌচলাচল বিঘ্নিত হচ্ছে এবংড্রেজিংয়ের জন্য ব্যয় হচ্ছে প্রচুর অর্থ।
বেঁচে থাকার মতো পানি পাচ্ছে না নদীগুলো। ব্যাপকভাবে পানি উত্তোলনের ফলে মরে যাচ্ছে নদী এবং সংকুচিত হচ্ছে জলাভূমি। লোনা পানি উজানে অগ্রসর হচ্ছে। খাল, বিল, ঝিল, জলাশয়, হাওড়, বাঁওড়, নদী প্রভৃতির ওপর নির্ভরশীল বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ, কীটপতঙ্গ, পশুপাখি বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। জীববৈচিত্র্য মারাত্মকভাবে হুমকির সম্মুখীন। জলাভূমি ভরাটের ফলে শুষ্ক মৌসুমে পানিপ্রবাহ কমছে। কারণ বর্ষাকালে জলাভূমিতে ধারণকৃত পানির একটা অংশ শুষ্ক মৌসুমে নদীতে ফিরে আসে। কাজেই পরিবেশের জন্য প্রয়োজনীয় পানি নিশ্চিত করা খুবই জরুরি।
অগভীর নলকূপের মাধ্যমে শুষ্ক মৌসুমে ব্যাপকভাবে সেচ কার্যক্রমের ফলে অনেক জায়গায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর মারাত্মকভাবে নেমে গেছে। এর ফলে গ্রামাঞ্চলে অনেক অগভীর নলকূপ পানিশূন্য হচ্ছে এবং স্থানীয় জনগণ খাওয়ার পানি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। নদীতে আড়াআড়ি বাঁধ দিয়ে পানি সরিয়ে নেওয়ার ফলে ভাটির দিকের লোকজন পানিবঞ্চিত হচ্ছে। এসব কারণে সৃষ্টি হচ্ছে সামাজিক সংঘাত।
নগরজীবন ও কলকারখানা থেকে সৃষ্ট তরল বর্জ্য অপরিশোধিত অবস্থায় জলাশয়, খালে ও নদীতে ছেড়ে দেওয়ায় পানিদূষণও ভয়াবহ অবস্থায়। ঢাকার বুড়িগঙ্গা, বালু এবং চট্টগ্রামের কর্ণফুলী ও হালদা নদীর দূষণ বহুল আলোচিত বিষয়। ভয়াবহ নদীদূষণের ফলে বিপর্যস্ত হচ্ছে ২০০২ সালে চালু করা সায়েদাবাদ পানি শোধনাগার। পানিদূষণের প্রভাব অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। এভাবে জনস্বাস্থ্যের প্রতি হুমকি বেড়েই চলেছে।
রাস্তার কারণে পানিপ্রবাহের গতিপথ পরিবর্তিত হয়। রাস্তা নির্মাণ ভূমিরূপের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হলে, সঠিক স্থানে কালভার্ট বা সেতু না থাকলে পানিচক্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ন্যায়ভিত্তিক পানি ব্যবস্থাপনার অভাবে একই অববাহিকায় অবস্থিত ভাটির দিকের দেশও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৯৭৫ সালে ফারাক্কা বাঁধ দিয়ে ভারত কর্তৃক গঙ্গা থেকে পানি সরানো একটা উদাহরণ। এ ব্যারেজের দ্বারা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন। গঙ্গার শাখা নদী গড়াইয়ের মুখ শুকিয়ে যাওয়ায় ব্যাপক কৃষিভূমি সেচবঞ্চিত হয়েছে। নদীর লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় মিঠাপানির দুষ্প্রাপ্যতা পৌঁছেছে চরম পর্যায়ে। শিল্পকারখানায় পানিসংকট, সুন্দরবন হুমকির সম্মুখীন। ইতিমধ্যে ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পে ব্রহ্মপুত্র থেকে পানি স্থানান্তরের পরিকল্পনা করা হয়েছে। গঙ্গার উপনদীগুলো থেকেও পানি সরিয়ে নেওয়া হবে। এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে সমগ্র বাংলাদেশ বিরাট বিরূপ প্রভাবের সম্মুখীন হবে।
নদীর অববাহিকাভিত্তিক পরিকল্পনাকে সমন্বিত পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা পদ্ধতিতে খুবই গুরুত্ব দেওয়া হয়। এর জন্য একই অববাহিকায় অবস্থিত দেশসমূহের মধ্যে সহযোগিতা প্রয়োজন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মেকং নদী অববাহিকায় অবস্থিত দেশগুলো মেকং কমিশন গঠনের মাধ্যমে সমন্বিত পানি ব্যবস্থাপনায় অনেক অগ্রগতি অর্জন করেছে। সুদীর্ঘ আলোচনার ফলে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গার পানি বণ্টনসংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ১৯৯৬ সালে। গঙ্গা ছাড়া ব্রহ্মপুত্রসহ আরও ৫৩টি যৌথ নদী আছে। এসব নদীর ব্যবস্থাপনা নিয়ে চুক্তি স্বাক্ষর ছাড়া বাংলাদেশে সুষ্ঠুভাবে পানি ব্যবস্থাপনা করা কঠিন। এ প্রসঙ্গে গঙ্গা পানি চুক্তির ৯ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে: ‘সমতা, ন্যায্য হিস্যা ও কোনো পক্ষের ক্ষতি হয় না এমন নীতির ভিত্তিতে উভয় দেশের সরকার অন্যান্য অভিন্ন নদীগুলোর ব্যাপারেও পানিবণ্টন চুক্তি/সমঝোতা সম্পন্ন করতে সম্মত হলো।’ দীর্ঘসময় অতিবাহিত হওয়ার পরও এই অঙ্গীকার বাস্তবায়িত হচ্ছে না।
গত কয়েক দশকের অভিজ্ঞতা বলে, বর্তমান পানি ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি থেকে কিছু লোক উপকৃত হচ্ছে আর কিছু লোক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সমাজের অবহেলিত অংশ জীবিকা নির্বাহের প্রয়োজনীয় উপাদান থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাই সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভিত্তি হিসেবে শুধু অর্থনৈতিক যুক্তি নয়, সমাজ ও পরিবেশের ওপর সম্ভাব্য প্রভাবও বিবেচনায় নিতে হবে। প্রকল্প নির্বাচনকালে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা খুবই জরুরি। প্রকল্পের গ্রহণযোগ্যতা যাচাইকালে প্রকল্প-উৎসারিত উপকার ও ক্ষতি প্রকল্প দ্বারা প্রভাবিত জনগণের মধ্যে ন্যায়ের ভিত্তিতে বণ্টন করতে হবে। বিশুদ্ধ খাওয়ার পানি ও স্যানিটেশনকে মৌলিক অধিকার হিসেবে বিবেচনা করে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে।
পানিচক্রের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব রোধের লক্ষ্যে দরকার উপযুক্ত ভূমিব্যবহারবিধি প্রণয়ন। বসতি স্থাপন, রাস্তা নির্মাণ, নগরায়ণ, শিল্পাঞ্চল স্থাপন প্রভৃতি কার্যক্রমে এসব বিধি কড়াকড়িভাবে প্রয়োগ করতে হবে। কৃষি, শিল্প, নৌচলাচলসহ বিভিন্ন খাতে সুবিচারের মাধ্যমে পানি বণ্টন করতে হবে। এ ছাড়া সমাজ ও পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব রোধের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ প্রয়োজন। এমনভাবে পানি ব্যবহার করা যাবে না যাতে ভাটির দিকের জনগণ ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত হয়। বন্যার ঝুঁকি এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্থানান্তর করা যাবে না। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কৌশল এমন হওয়া উচিত যাতে করে জনগণ কাবু না হওয়ার সামর্থ্য অর্জন করতে পারে। পানি নিয়ন্ত্রণ অবকাঠামোগুলিকে বহুমুখী ব্যবহারের উপযোগী করে তৈরি করতে হবে, যাতে সমাজের বিভিন্ন জনগোষ্ঠী উপকৃত হয়। নগর ও শিল্প-কারখানার তরল বর্জ্য প্রয়োজনীয় শোধন ছাড়া নদীতে ছাড়া যাবে না। পরিবেশ রক্ষার জন্য নদীতে প্রয়োজনীয় প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে। জলাভূমি সংরক্ষণ ও প্লাবনভূমির মৎস্যসম্পদ রক্ষা করার জন্য জোর কার্যক্রম প্রয়োজন। জলাধার সংরক্ষণ আইন ও পরিবেশ সংরক্ষণ আইন বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও জলাভূমি ভরাট বন্ধে বা নদীদূষণ রোধে বা নদী দখল বন্ধে তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। নীতি ও আইন প্রণয়নই যথেষ্ট নয়। একই সঙ্গে প্রয়োজন সুচিন্তিত বাস্তবায়ন-কৌশল ও দৃঢ় পদক্ষেপ।
বাংলাদেশের আর্থিক বছর (জুলাই-জুন) পানিচক্র, ঋতুচক্র ও পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। আর্থিক বছরের শেষ পর্যায়ে নির্মাণ কর্মকাণ্ডের তোড়জোর একটা সচরাচর চিত্র। এ সময় বর্ষা শুরু হয়ে যাওয়ায় নির্মাণকাজ মানসম্মত হয় না। অনেক দেশেই পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ আর্থিক বছর (যথা এপিল-মার্চ) প্রচলিত আছে। বাংলা বর্ষ অতীতে আর্থিক বছর হিসেব চালু ছিল, এটা পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং স্থানীয় উৎপাদনব্যবস্থার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। জমির খাজনা এখনো বাংলা বর্ষভিত্তিতে আদায় করা হয়। এপ্রিল থেকে মার্চ বাংলা বর্ষের কাছাকাছি। এপ্রিল-মার্চ আর্থিক বছর হিসেবে গ্রহণ করা হলে উন্নয়ন কার্যক্রম-সম্পর্কিত অনেক সমস্যার আপনাআপনি সমাধান হবে।
অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও সামাজিক কল্যাণ সাধনে পানি ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব অপরিসীম। ন্যায়ভিত্তিক পানি ব্যবস্থাপনার জন্য পরিকল্পনা প্রণয়ন, বাস্তবায়ন ও পর্যবেক্ষণে সক্ষম সংস্থা দরকার। পানি ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন বিকল্প মূল্যায়নে মূল বিবেচনা হওয়া উচিত দারিদ্র্য হ্রাস, কর্মসংস্থান, জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন, পরিবেশ সংরক্ষণ প্রভৃতি। এভাবেই টেকসই উন্নয়নের দিকে পদার্পণের সূচনা হবে। ন্যায়ভিত্তিক পানি ব্যবস্থাপনার জন্য সহায়ক অবস্থা সৃষ্টির দায়িত্ব সরকারের। সেজন্য প্রয়োজন সুদৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকার।
জহির উদ্দিন চৌধুরী: অধ্যাপক, পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউট, বুয়েট।

No comments

Powered by Blogger.