চারদিক-সুবর্ণজয়ন্তীর মহড়া হলো ল্যাবরেটরি স্কুলে by ফেরদৌস ফয়সাল

টিফিনের সময়ে ঢাকা কলেজের পুকুরে নেমে গোসল করা, ফিরে এসে শিক্ষকের হাতে মার খাওয়া কিংবা নির্দিষ্ট সময়ে যাঁরা স্কুলের সমাবেশে (অ্যাসেম্বলিতে) উপস্থিত হতেন না, দেরি করে ক্লাসে ঢুকতেন, তাঁরাও ১৯ মার্চ সকাল ১০টায় প্রিয় স্কুল প্রাঙ্গণে অ্যাসেম্বলিতে উপস্থিত হয়েছেন।


শুক্রবার ঢাকার গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুল প্রাঙ্গণে স্কুলের প্রাক্তন ছাত্রদের সংগঠন ওল্ড ল্যাবরেটরিয়ানস অ্যাসোসিয়েশন (ওলসা) আয়োজন করেছিল পুনর্মিলনী-২০১০।
দীর্ঘদিন পর সহপাঠীর দেখা পেয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে কেউ বলে ওঠেন, কেমন আছিস, বন্ধু? সারা দিনই চলে এমন করে কুশলবিনিময়। কেউ চলে যান বন্ধুদের সঙ্গে তাঁদের প্রিয় শ্রেণীকক্ষে পুরোনো স্মৃতি খুঁজতে, কাজের ব্যস্ততায় বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে পারেন না অনেকেই। পাস করার পর সহপাঠীরা কে কোথায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন, সে খবরও রাখা হয় না; কিন্তু ওলসার পুনর্মিলনী এসে সেই পুরোনো দিনগুলোই যেন আবার নতুন হয়ে ধরা দিয়েছিল পুরোনো শিক্ষার্থীদের কাছে। স্মৃতি হাতড়ে তাঁরা চলে গিয়েছিলেন স্কুলের ধরাবাঁধা ক্লাস, পরীক্ষা আর কঠিন রুটিনের ক্লাসের ফাঁকে আড্ডার দিনগুলোয়। কিশোর বয়সের সেই বাঁধভাঙা দিনগুলোর কথা আর গল্পে মেতে ওঠেন সবাই। সবার মুখে ছিল হাসি আর বুকজুড়ে ছিল প্রিয় বিদ্যাপীঠ ও বন্ধুদের জন্য ভালোবাসা। সকালে স্কুলের প্রবেশমুখে প্রত্যেকে সংগ্রহ করেছেন নাম ও ব্যাচ-সংবলিত পরিচয়পত্র। সারা দিন প্রত্যেকের গলায় ঝুলেছে তা। সকাল ১০টায় অনুষ্ঠিত হয় ‘অ্যাসেম্বলি’। পতাকা উত্তোলন করা হয়। এরপর সমবেত দুই হাজার ৩০০ প্রাক্তন ছাত্র শপথবাক্য পাঠ করেন। স্কুল প্রতিষ্ঠা হয়েছে ৪৯ বছর। তাই ৪৯টি বেলুন আকাশে উড়িয়ে দেন স্কুলের সাবেক প্রধান শিক্ষক জহিরুল হক। এ সময় স্কুলের বর্তমান ও সাবেক শিক্ষকেরা উপস্থিত ছিলেন। সারা দিনে তিনবার র্যাফল ড্রয়ের ব্যবস্থা ছিল। প্রথমটা পরিচালনা করেন সানা, পরেরটা রাজীব। মঞ্চে দাঁড়িয়ে সাংসদ নাজমুল হাসান বলেন, ‘২০১১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর স্কুল প্রতিষ্ঠার ৫০ বছর। সুবর্ণজয়ন্তী। সেই অনুষ্ঠানের মহড়া হলো আজ।’ সুবর্ণজয়ন্তীতে দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে থাকা ল্যাবরেটরিয়ানদের যোগ দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি। ছাত্রদের কাছে ‘টাইগার স্যার’ নামে খ্যাত সাবেক প্রধান শিক্ষক জহিরুল হক বলেন, ‘ল্যাবরেটরিয়ানরা চিরসবুজ। যে যেখানেই থাকুক না কেন, তারা মনে-প্রাণে ল্যাবরেটরিয়ান। তোমরা যেখানেই থাকবে, সেখানেই তোমাদের আলোর বিচ্ছুরণ ঘটবে।’ স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক খান মুহাম্মদ সালেকসহ প্রয়াত সব শিক্ষককে স্মরণ করেন তিনি। নামাজ ও খাবারের বিরতির পর দড়িটানা খেলার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
সাংসদ আন্দালিব রহমান বলেন, ‘সবার সঙ্গে দেখা হচ্ছে, ভালো লাগছে। পুরোনো স্মৃতি মনে পড়ছে।’
নুরুল কবির বলেন, ‘আমরা যেমন দুষ্টু ছিলাম, তেমনি ছিলাম খেলাধুলায় পারদর্শী। দীর্ঘদিন পরে পুরোনো মুখগুলো দেখতে পারছি। সেই সময়ের নানা ঘটনার কথা মনে করে নতুন করে হাসছি।’
অনেকেরই মধ্যে দেখা গেছে এমন আবেগের প্রকাশ। স্মৃতিচারণায় তাঁরা ফিরে গেছেন সেই কৈশোরে। দীর্ঘ বছর পর সহপাঠীর সঙ্গে দেখার অনুভূতি কেমন জানতে চাইলে দস্তগীর মো. আদিল বলেন, ‘যেটুকু দেখলেন, তা বাইরের। ভেতরে যে কী আবেগ কাজ করছে, তা বলে বোঝাতে পারব না।’
দুপুরে একই শামিয়ানার নিচে মধ্যাহ্নভোজ করেন সবাই পুরোনো বন্ধু-সহপাঠীর সঙ্গে।
স্কুলের বর্তমান প্রধান শিক্ষক এ কে এম মোস্তফা কামাল জানান স্কুলের সাম্প্রতিক বছরের সাফল্যের খবরাখবর। ১৯৬১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর স্কুল প্রতিষ্ঠা হলেও ১৯৬৪ সাল থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়।
ব্যান্ড অর্থহীনের সদস্য ও প্রাক্তন ছাত্র সুমনের লেখা ও সুরে থিম সংগীত ‘আলো আরো আলো’ সংগীত ভিডিও প্রদর্শন করার সময় প্রায় সবারই চোখ ছলছল করছিল। গোপনে চোখ মোছেন অনেকে। শিক্ষকদের মধ্যে মুহাম্মদ জহিরুল হক, শরীফউদ্দিন আহমেদ, শহীদুর রহমান, জহিরুল ইসলাম খান, কাজী মোজাম্মেল হক, লালমোহন চক্রবর্তী, আবুল হাসনাত ফারুক, আব্দুল মালেক, মাহমুদুল্লাহ, আবুল খায়ের, মো. মোহসিন খান, ইনসান আলী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
এসএসসি পরীক্ষায় সম্মিলিত মেধাতালিকায় ১৯৬৪ সাল থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুলের ছাত্ররা ১৮ বার প্রথম স্থান অধিকার করেছেন। আর ১৯৯৩ সালে মেধাতালিকায় ২৭ জন স্থান করে নিয়েছিলেন।
যাঁদের সহযোগিতা ছাড়া এ আয়োজন সফল হতো না তাঁরা হলেন: বাদল (৬৫ ব্যাচ), কনা (৬৮), হুদা (৭০), কামরুজ্জামান (৭৩), শহীদ (৭৪) সাঈদ (৭৫), আব্বাস (৭৭), গাজী (৭৯), পিপুল, মারুফ (৭৮), মাসুম (৮০), সুজা (৮৪), সালাউদ্দিন (৮৯), তাজিম, সুজন, সুমন, অনীক (৯০), রুবেল (৯১), জুয়েল, মল্লিক (৯২), রাজীব, সানা, (৯৩)।
সন্ধ্যায় ৪৯টি ফানুস ওড়ানো হয়। প্রাক্তন ছাত্রদের ব্যান্ড দৃক, মেকানিক্স, অর্থহীন, ওয়্যারফেজ গান পরিবেশনা করে।
বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস এবং ভালো লাগা আর নতুন-পুরোনোর সহমিলনে স্কুল প্রাঙ্গণে এমন একটি দিন কেটে যায়। আগামী বছরের ৩ সেপ্টেম্বর দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে থাকা ল্যাবরেটরিয়ানরা স্কুলের সুবর্ণজয়ন্তী পালন করবেন। এ জন্য প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। ওলসার ওয়েবসাইটে (www. laboratorians.net) জানা যাবে বিস্তারিত। রাত প্রায় সাড়ে ১০টায় বহুপ্রতীক্ষিত মিলনমেলা যখন ভাঙল, স্কুল প্রাঙ্গণ থেকে যখন বের হচ্ছিলাম, গানের কথাগুলো বারবার মনে হচ্ছিল: ‘তোমার সেই কথায় দাঁড়াই উঠে/শিখিয়েছিলে যা আমাদের/আলো আরো আলো আজ আমরাই ছড়াবো/আলো আরো আলো সবই তোমার জন্য/আলোয় আলোকিত চারদিক সেতো তোমারই জন্য।’

No comments

Powered by Blogger.