জাবি পরিস্থিতি নিয়ে ধূম্রজাল by এ কে এম শাহনাওয়াজ

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম সুনির্দিষ্ট কয়েকটি দাবি নিয়ে এবং পরে সৃষ্ট অবধারিত পরিণতিতে ছাত্র-শিক্ষকদের ভিসি পদত্যাগের দাবি সামনে চলে আসে। এভাবে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে ক্যাম্পাস। আন্দোলন গড়ায় চার মাস। বরাবরের মতো সরকারের শীতঘুমের কারণে শেষ এক মাস আন্দোলন কর্মসূচিতে ক্লাস বর্জন যুক্ত হয়।


শিক্ষকসমাজের ধারণা ছিল যেহেতু তাদের দাবি যৌক্তিক এবং ভিসির বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রামাণ্য ও প্রকাশ্য তাই অবস্থা জটিল হওয়ার আগেই সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করে সংকটের অবসান ঘটাবে। ফলে ক্লাস বর্জনের মতো অপ্রিয় সিদ্ধান্তে যেতে হবে না। এর মধ্যে ভিসি অনুসারী শিক্ষক ও ছাত্রলীগ প্রচারে নামল- এই আন্দোলন বিএনপি-জামায়াতের আন্দোলন। সরকারকে অস্থিতিশীল করার জন্য 'গুটিকয়েক শিক্ষকের অপপ্রয়াস'। যা ক্যাম্পাসের ছাত্র-শিক্ষকদের কাছে বিস্ময়কর ও হাস্যকর মনে হয়েছিল। তার পরও সবার বিশ্বাস ছিল যেহেতু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ভিন্ন গ্রহে নয়। এবং সত্য যাচাই করার জন্য সরকারের অনেক অবলম্বন আছে. তাই ভুল প্রচারে বিভ্রান্ত হবেন না নীতিনির্ধারকরা। কিন্তু অবস্থা সঙ্গিন না হওয়া পর্যন্ত বোধ হয় সরকারের গাড়ি স্টার্ট নেয় না। ক্লাস বর্জনের মতো শেষ অস্ত্র প্রয়োগ করতে বাধ্য করানো হলো। বাধ্য করানো হলো শিক্ষকদের অবস্থান ধর্মঘটে যেতে। শেষ দিকে ছাত্র আন্দোলন ছিল না। জুবায়ের হত্যার প্রাথমিক বিচারের পর ছাত্ররা ক্লাসে ফিরে গিয়েছিল। কিন্তু নিজেকে রক্ষা করতে গিয়ে ভিসি গ্রীষ্মের ছুটি এক মাস এগিয়ে দিয়ে পরিস্থিতি আবার উত্তপ্ত করে তুললেন। সাংস্কৃতিক জোটের ব্যানারে ছাত্ররা অগ্রিম ছুটির সিদ্ধান্ত বর্জন করে পথে নামলেন। এ সময়ও সতর্ক হওয়া উচিত ছিল সরকারের। কিন্তু তখনো সরকারের ঘুম ভাঙেনি। নানা অঘটনঘটনপটীয়সী ভিসির আতঙ্ক ছাত্র বিক্ষোভ শিক্ষকদের সঙ্গে একাত্ম হলে অবস্থা বেগতিক হবে। তাই ভিসিলীগ নামে পরিচিত ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা এক বিকেলে চড়াও হলো। সাংস্কৃতিক জোটের ১০-১২ জন ছাত্রকে পিটিয়ে গুরুতর আহত করল। কিন্তু দমানো গেল না ছাত্রদের। বন্ধুদের হসপিটালে ভর্তি করিয়ে তাঁরা প্রতিবাদী মিছিল দীর্ঘ করলেন। ভিসি ভবনের কাছে অবস্থান নেওয়া শিক্ষকদের কাছাকাছি তাঁরাও অবস্থান নিলেন। প্রতিবাদী সংগীত পরিবেশন করতে থাকলেন। ক্যাম্পাসে প্রচার পেল ভিসির অঙ্গুলি হেলনে ছাত্রলীগ বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া করবে প্রতিবাদী ছাত্রদের। একই রাত ৯টায় বাতি বন্ধ করে পুলিশ সরিয়ে দিয়ে ছাত্রদের ওপর আঘাত হানতে এগিয়ে এলো সন্ত্রাসীরা। অবস্থা বুঝে ত্বরিত সিদ্ধান্ত নেন শিক্ষকরা। তাঁরা মানবঢাল রচনা করেন। পরিকল্পনা সফল না হওয়ায় কয়েকজন শিক্ষককে আহত করে ফিরে যায় ছাত্রলীগ নামধারী সন্ত্রাসীরা। এ ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় ছাত্ররা ভিসি পতনের একদফা দাবিতে শিক্ষকদের সঙ্গে এক মঞ্চে চলে আসেন।
আমরা মনে করি, এর পরও ধূম্রজাল না ছড়িয়ে সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু সে পথ বন্ধ থাকায় শেষ পর্যন্ত ছাত্র-শিক্ষকদের অনশনে যেতে বাধ্য করা হলো। এই পর্যায়ে এসে টনক নড়ে সরকারের। প্রধানমন্ত্রী আন্দোলনরত শিক্ষক নেতৃত্বের সঙ্গে বৈঠক করেন। শিক্ষকরা জানিয়ে দেন, ভিসি অপসারণের এক দফা দাবি ছাড়া তাঁদের আর চাওয়ার কিছু নেই। প্রধানমন্ত্রী দাবি পূরণের আশ্বাস দিলেন। প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসের ওপর পূর্ণ আস্থা রেখে ফিরে এলেন নেতারা। স্বাভাবিকভাবেই ক্যাম্পাসে আন্দোলনরত ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হলো। আন্দোলন প্রত্যাহার প্রশ্নে মতবিভেদও দেখা দিল। সবার সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠকের পর শিক্ষক সমাজ প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাস দেওয়াকে সম্মান জানিয়ে আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিল। ছাত্রলীগের হাতে মার খাওয়া ভিসি কর্তৃক অপমানিত ছাত্ররা আন্দোলন চালিয়ে গেলেন। দুদিন পরে প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাস নিয়ে এলেন সাংসদ সারাহ বেগম কবরী। ভিসিকে পদত্যাগ করানো হবে এই ভরসা দিয়ে অনশন ভাঙালেন তিনি। ছাত্ররাও আন্দোলন প্রত্যাহার করলেন।
এরপর স্বাভাবিকভাবেই সবার প্রত্যাশা ছিল স্বল্পতম সময়ের মধ্যে ভিসির পদত্যাগ কার্যকর করে সরকার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনবে। কিন্তু এক সপ্তাহ পার হওয়ার পরও সরকারপক্ষ নিশ্চুপ। ফলে স্বাভাবিকভাবে একটি ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে ক্যাম্পাসে। প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে আশ্বাস নিয়ে এসে যে শিক্ষক প্রতিনিধি আন্দোলন প্রত্যাহারে ভূমিকা রেখেছিলেন- তাঁরা এখন নানা প্রশ্নবাণে জর্জরিত হচ্ছেন।
অবস্থা আরেকটু নাজুক হলো গত ১২ মে। এদিন গ্রীষ্মকালীন অবকাশের পর অফিস খুলেছে বিশ্ববিদ্যালয়। খবর এলো বহাল তবিয়তে অফিস করছেন ভিসি মহোদয়। অনুগতদের নিয়ে সভা করছেন। সরকারের পরবর্তী সিদ্ধান্ত না আসা পর্যন্ত রুটিন দায়িত্ব পালন ছাড়া নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত না নেওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে লিখিতভাবে অনুরোধ জানিয়েছেন শিক্ষক সমাজের নেতারা। কিন্তু খবর রটে যায় অফিস খোলার প্রথম প্রহরেই ভিসি মহোদয় অ্যাডহক ভিত্তিতে একজন অফিসার নিয়োগ দিয়েছেন। এ ধরনের আরো কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। এ অবস্থায় শিক্ষকদের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। একই দিনে অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য শিক্ষকসমাজ সাধারণ সভায় মিলিত হয়েছেন। সভায় অনেকেই মত প্রকাশ করেছেন এক সপ্তাহ ধরে সব কিছু ফাইল বন্দি করে সরকার যে ধূম্রজাল সৃষ্টি করে চলছে তা অনভিপ্রেত। তার পরও সবাই বিশ্বাস রাখতে চান যে প্রধানমন্ত্রী তাঁর কথা রাখবেন। সভা থেকে নেতাদের জানানো হয়. চলতি সপ্তাহটি তাঁরা পর্যবেক্ষণ করবেন। না হলে তাঁদের পরবর্তী সিদ্ধান্তে যেতে হবে। এর মধ্য আন্দোলনকারী ছাত্ররা জানিয়েছেন, সরকার যদি ভিসির পদত্যাগ কার্যকর না করে, তবে ছুটির পর তাঁরা দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলবেন।
এই বাস্তবতায় আমরা মনে করি সরকারের এই কালক্ষেপণ অনভিপ্রেত। প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আস্থা হারাতে চান না কেউ। কিন্তু সরকারি সিদ্ধান্তহীনতা বা দীর্ঘসূত্রতাকেও ভালো চোখে দেখছেন না ক্যাম্পাসবাসী। বিশ্ববিদ্যালয়ের এ ধরনের আন্দোলনের চরিত্র ভিন্ন। বিরুদ্ধ পক্ষ যেভাবেই প্রচারণা করুক না কেন। রাজনৈতিক রং যতই চড়ানো হোক বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সদস্যরা জানে নৈতিকতার ভিত্তি থেকেই এই আন্দোলনে শক্তি সঞ্চিত হয়েছে। অন্যায় আর স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়েই এই আন্দোলন প্রাণশক্তি পেয়েছে। তাই সরকারি আশ্বাস যদি দ্রুত কার্যকর না হয়, তবে যেকোনো সময়ই ফুঁসে উঠতে পারে ক্যাম্পাস।
তাই নানা কাজে ব্যস্ত সরকারকে আন্দোলন প্রত্যাহার হয়েছে বলে নিশ্চুপে বসে থাকার অভ্যাস থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বিকল্প কোনো পথ খোঁজাও বাস্তব চিন্তা হবে না। বর্তমান বাস্তবতায় ভিসি অপসারণের সিদ্ধান্তটি যত দ্রুত দেওয়া যাবে ক্যাম্পাসে সুস্থতা তত দ্রুত ফিরে আসবে।

লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.