ব্যাপক সংঘর্ষ, ৩০ কারখানা ও শতাধিক যানবাহন ভাঙচুর-গতকালও উত্তাল ছিল আশুলিয়া

হা-মীম গ্রুপের প্রতিষ্ঠান দ্যাটস ইট প্যাকেজিং লিমিটেডের ভান্ডাররক্ষক সালমানকে ঘিরে গতকাল রোববারও উত্তাল ছিল রাজধানীর উপকণ্ঠ আশুলিয়ার শিল্পাঞ্চল। শ্রমিকেরা অন্তত ৩০টি কারখানা ও শতাধিক যানবাহন ভাঙচুর করেছেন। এ নিয়ে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে আহত হন শতাধিক শ্রমিক।


গত শনিবার লুট হওয়া শিল্প পুলিশের শটগানটি গতকাল দুপুরে আশুলিয়ার বুমাইল এলাকা থেকে উদ্ধার হয়েছে। শটগান লুট ও পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগে শিল্প পুলিশের পক্ষ থেকে গতকাল আশুলিয়া থানায় মামলা হয়েছে। মামলায় সাড়ে চার হাজার অজ্ঞাতনামা শ্রমিককে আসামি করা হয়েছে। এদিকে শ্রমিকদের দাবির মুখে গতকাল সালমানকে তাঁর কর্মস্থলে উপস্থিত করা হলেও তিনি আসল না নকল সালমান—এ নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়।
জানতে চাইলে শিল্প পুলিশের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) আবদুস সালাম বলেন, গতকাল কাজে যোগ দেওয়ার পর দ্যাটস ইট প্যাকেজিং লিমিটেডের শ্রমিকেরা ভান্ডাররক্ষক সালমানকে তাঁদের মাঝে দেখতে না পেয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। এর পরই বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে গোটা শিল্পাঞ্চলে। পরে সালমানকে তাঁর কর্মস্থলে উপস্থিত করা হলেও অনেকে চিনতে না পারায় সমস্যা থেকেই যায়। বিক্ষোভ, ভাঙচুরে কেউ কোনো উসকানি দিচ্ছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
গতকালের ঘটনা যেভাবে শুরু: সকাল আটটার মধ্যে আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলের সব কারখানার শ্রমিক কাজে যোগ দেন। কাজ শুরু হওয়ার পরও দ্যাটস ইট প্যাকেজিং লিমিটেডের শ্রমিকেরা ভান্ডাররক্ষক সালমানকে তাঁদের মাঝে না পেয়ে কাজ বন্ধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন। একপর্যায়ে তাঁরা কারখানা থেকে বের হলে তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন একই গ্রুপের আর্টিস্টিক ডিজাইন লিমিটেডের কয়েক হাজার শ্রমিক। খবর পেয়ে হা-মীম গ্রুপের নরসিংহপুরের আরও কয়েকটি কারখানার হাজার হাজার শ্রমিক সকাল সোয়া আটটার দিকে কাজ বন্ধ করে একযোগে কারখানা থেকে বেরিয়ে কারখানাসংলগ্ন আবদুল্লাহপুর-বাইপাইল সড়কে অবস্থান নেন। এ সময় ওই সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
আশুলিয়া থানা ও শিল্পপুলিশসহ প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যমতে, হা-মীম গ্রুপের শ্রমিকেরা রাস্তায় নামার পর আতঙ্কে আশপাশের সব কারখানায় ছুটি দেওয়া হয়। ওইসব কারখানার অনেক শ্রমিক হা-মীম গ্রুপের শ্রমিকদের সঙ্গে যোগ দিয়ে এলোপাতাড়ি কারখানা ও যানবাহন ভাঙচুর শুরু করেন। পুলিশ বাধা দিলে শ্রমিকেরা পুলিশের ওপরও হামলা চালান। এর পরই শ্রমিক-পুলিশ সংঘর্ষ শুরু হয়।
সকাল সাড়ে নয়টার মধ্যে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে আশুলিয়ার ইউনিক থেকে জিরাব পর্যন্ত আড়াই কিলোমিটার এলাকাজুড়ে। রণক্ষেত্রে পরিণত হয় নরসিংহপুর ও বাংলাবাজার এলাকা। পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল, রাবার বুলেট ও জলকামান থেকে গরম পানি ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে। শ্রমিকেরা ইটপাটকেল ছুড়ে পাল্টা জবাব দেন।
শিল্পপুলিশ আশুলিয়া জোনের পরিদর্শক মোখলেছুর রহমান বলেন, পুলিশের তাড়া খেয়ে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে শ্রমিকেরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েন। এ সময় শিল্পাঞ্চল অনেকটা শান্ত হয়ে আসে।
পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলে দুপুর ১২টার দিকে র‌্যাবের সুসজ্জিত দল পাহারা দিয়ে আবদুল্লাহপুর-বাইপাইল সড়কে যানবাহন চলাচলে সহায়তা করে।
সালমান নাটক: হা-মীম গ্রুপের আশুলিয়া অঞ্চলের প্রকল্প পরিচালক ব্রিগেডিয়ার (অব.) মোহাম্মদ আলী মণ্ডল বলেন, সালমান কারখানায় উপস্থিত হন সকাল ১০টার দিকে। এ বিলম্বের কারণেই শ্রমিকেরা ধারণা করেন, সালমান জীবিত নেই। এ বিশ্বাস থেকেই গতকালও শ্রমিকেরা বিক্ষোভ শুরু করেন। তবে গতকাল তাঁরা তেমন ভাঙচুর করেননি।
পুলিশ পাহারায় সালমানকে উপস্থিত করার সময় কর্মীদের অনেকেই তাঁকে সালমান নয় বলে মন্তব্য করেন। অনেকে আবার সালমানকে তাঁদের সহকর্মী বলে নিশ্চিত করেন। এ মতপার্থক্য থেকে শ্রমিকদের মধ্যে বিতর্ক ও আরও ক্ষোভের সৃষ্টি হলে পুলিশ সালমানকে থানায় নিয়ে যায়। সালমানের সহকর্মী কামাল হোসেন জানান, পুলিশ তাঁদের সহকর্মী সালমানকেই তাঁদের মাঝে উপস্থিত করেছে।
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন শ্রমিক জানান, এই সালমান সেই সালমান নন। পুলিশ পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে নকল সালমানকে হাজির করেছে।
তবে আশুলিয়ার গুমাইল এলাকার সালমানের বাসার মালিক আমজাদ হোসেন তাঁকে আসল সালমান বলেই নিশ্চিত করেছেন।
নানা জল্পনার পর গতকাল বেলা একটার দিকে পুলিশ ওই সালমানকে সাংবাদিকদের মুখোমুখি করে। এ সময় সালমান দাবি করেন, তিনিই আসল সালমান। মুঠোফোনে কথা বলা নিয়ে মারধরের পর উৎপাদন পরিচালক মোফাখখারুল ইসলাম তাঁকে পুলিশে সোপর্দ করেন। এরপর একটি চুরির মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে তাঁকে আদালতে পাঠিয়ে রিমান্ডে নেওয়া হয়। পরে তিনি জামিনে মুক্তি পান।
সালমান বলেন, ‘অতি তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে কর্তৃপক্ষ আমার ওপর কঠোর আচরণ করেছেন। এ কারণেই আজ এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এটা অনাকাঙ্ক্ষিত।’
জামিনে মুক্ত হওয়ার পরও সালমানকে পুলিশ হেফাজতে রাখার কারণ জানতে চাইলে ঢাকার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শেখ রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘সালমানকে নিয়ে তৃতীয় পক্ষ কোনো গেম খেলতে পারে। এ কারণেই তাঁকে পুলিশি নিরাপত্তায় রাখা হয়েছে।’
উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ঢাকার পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান বলেন, একটি স্বার্থান্বেষী মহল শিল্পাঞ্চলে বিশৃঙ্খলতা সৃষ্টি করতে চাচ্ছে। তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা অব্যাহত আছে।

No comments

Powered by Blogger.