এইদিনে-বিশ্ব নাট্যদিবসের কথা by জাহিদ রিপন

২৭ মার্চ পৃথিবীর সব নাট্যকর্মীর জন্য একান্তভাবে বিশেষ এবং কাঙ্ক্ষিত একটি দিন—বিশ্ব নাট্যদিবস। দিবসটি নাট্যকর্মীদের দীর্ঘ নাট্য আন্দোলনের একটি অত্যন্ত উজ্জ্বল অর্জন এবং দেশ-ধর্ম-বর্ণ-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য-ভাষার সীমা প্রভৃতি ছাড়িয়ে নাট্যকর্মীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসব। সারা বিশ্বে ১৯৬২ থেকে তাই বিশ্ব নাট্যদিবস বিশেষ মর্যাদা এবং আন্তরিকতার সঙ্গে পালিত হয়ে আসছে।


জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংগঠন ইউনেসকোর উদ্যোগে এবং বিশ্বের কয়েকজন খ্যাতিমান নাট্যব্যক্তিত্বের সক্রিয় ভূমিকায় ১৯৪৮ সালে প্রাগে ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউট (আইটিআই) প্রতিষ্ঠিত হয়। আইটিআই প্রতিষ্ঠার পশ্চাতে বেশ কিছু উদ্দেশ্য সক্রিয় ছিল, যেমন—প্রদর্শনশিল্পের ক্ষেত্রে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার আন্তর্জাতিক বিনিময় বৃদ্ধি, নাটকের ক্ষেত্রে সৃষ্টিশীলতা ও সহযোগিতাকে উৎসাহ দান, উন্নয়নে সংস্কৃতির প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে জনমত সৃষ্টি, পারস্পরিক সম্পর্ক বৃদ্ধির মাধ্যমে মানুষে মানুষে সৌভ্রাতৃত্ব ও শান্তি নিশ্চিত করা, ইউনেসকোর উদ্দেশ্যসমূহ বাস্তবায়নে সহায়তা দান, সর্বপ্রকার বর্ণ-সামাজিক-রাজনৈতিক বৈষম্য দূর করা প্রভৃতি।
১৯৬১ সালে ভিয়েনায় অনুষ্ঠিত আইটিআইয়ের নবম বিশ্ব কংগ্রেসে আইটিআই, ফিনল্যান্ড কেন্দ্রের প্রস্তাব অনুযায়ী বছরের একটি নির্দিষ্ট দিনে বিশ্ব নাট্যদিবস হিসেবে বিশেষভাবে পালনের সিদ্ধান্ত সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। পরবর্তী বছর অর্থাৎ ১৯৬২ সালে আইটিআইয়ের প্যারিসে অনুষ্ঠিত থিয়েটার অব নেশনসের উদ্বোধনী তারিখ ছিল ২৭ মার্চ। অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এ দিনকেই বিশ্ব নাট্যদিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে প্রতিবছর ২৭ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্ব নাট্যদিবস উদ্যাপিত হয়ে আসছে।
আইটিআই প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যসমূহ অর্জনের উদ্দেশ্যে নবপ্রত্যয়ে দৃপ্তমান হওয়ার জন্যই বিশ্ব নাট্যদিবস পালন করা হয়। নাট্য তথা প্রদর্শনশিল্পের মাধ্যমে মানবিক সম্পর্কের উন্নয়ন, নাট্যকর্মীদের পারস্পরিক যোগাযোগ ও সহমর্মিতা বৃদ্ধি তথা নাট্যকর্মীর সঙ্গে দর্শকের সম্পর্ক জোরদার করার মধ্যেই প্রকৃতপক্ষে বিশ্ব নাট্যদিবসের সার্থকথা নিহিত।
১৯৮১ সালে বাংলাদেশ আইটিআইয়ের সহযোগী সদস্যপদ প্রাপ্তির পর ১৯৮২ থেকে বাংলাদেশে বিশ্ব নাট্যদিবস উদ্যাপন শুরু হয় (প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের স্বনামখ্যাত নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার আইটিআই, বিশ্বকেন্দ্রের বর্তমান নির্বাচিত সভাপতি, যেটি প্রকৃতই বাংলাদেশের নাট্যচর্চার অনন্যসাধারণ সম্মান)। আইটিআই, বাংলাদেশ কেন্দ্র এবং বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন যৌথভাবে প্রথম থেকে বাংলাদেশে বিশ্ব নাট্যদিবস পালন করছে। সম্প্রতি তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী।
বাংলাদেশে সাধারণত বিশ্ব নাট্যদিবসের অনুষ্ঠানমালার মধ্যে স্থান পায়—নাট্যকর্মীদের বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা, প্রীতি সম্মিলনী, সেমিনার বা বিশ্ব নাট্যদিবস বক্তৃতা, বিশ্ব নাট্যদিবস সম্মাননা প্রদান, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান প্রভৃতি। কিন্তু এর সমান্তরালে বিশ্ব নাট্যদিবস পালনে বৈচিত্র্য ও নবগতির জন্য নাট্যদল বা নাট্যকর্মীরা কিছু উদ্ভাবনীমূলক পদক্ষেপ নিতে পারেন:
ক. বিশ্ব নাট্যদিবস উপলক্ষে নাট্যকর্মীরা পরস্পরকে শুভেচ্ছা কার্ড প্রদান, নাট্যবিষয়ক গ্রন্থ উপহার বা অন্যান্য উপহার প্রভৃতি প্রদানের মাধ্যমে শুভেচ্ছা জানাতে পারেন।
খ. নাট্যকর্মীরা এ দিনে দূরবর্তী নাট্যকর্মী বা নাট্যদলকে ফোন, ই-মেইল, ফেসবুক বার্তা কিংবা মোবাইল বার্তা প্রভৃতির মাধ্যমে স্মরণ ও শুভেচ্ছা জানাতে পারেন।
গ. প্রতিটি দল বিশ্ব নাট্যদিবসে দলের একনিষ্ঠ নাট্যকর্মীদের স্বীকৃতি বা আনুষ্ঠানিক সংবর্ধনা জানাতে পারে।
ঘ. নাট্যদলগুলো এ দিন পরস্পরকে শুভেচ্ছা জানাতে পারে এবং সে সঙ্গে বাৎসরিক কার্যক্রম সম্পর্কে ছাপানো আকারে অবহিত করতে পারে।
ঙ. নাট্যদলগুলো স্মরণিকা বা নাট্যবিষয়ক ক্ষুদ্র পত্রিকা প্রকাশ করতে পারে।
চ. নাট্যদলগুলো নাট্যবিষয়ক কুইজ প্রতিযোগিতা ও পাঠচক্রের আয়োজন করতে পারে।
ছ. নাট্যদলগুলো বিশ্ব নাট্যদিবসের শোভাযাত্রায় পরস্পরকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানাতে পারে।
জ. নাট্যদলগুলো স্মারক টি-শার্ট প্রভৃতি প্রকাশ করতে পারে।
ঝ. শিল্পকলা একাডেমী বা সুবিধাজনক স্থানে বিভিন্ন দলের সমন্বয়ে দিনব্যাপী নাট্যমেলার আয়োজন করা যেতে পারে।
ঞ. নাট্যবিষয়ে দর্শকের প্রত্যাশা, এর সাপেক্ষে বর্তমান প্রাপ্তি এবং দর্শকের সাম্প্রতিক ভাবনা জানার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্ত আলোচনার ব্যবস্থা করা যায়।
ট. প্রবীণদের পাশাপাশি প্রতিশ্রুতিশীল নবীন দলগুলোর সমন্বয়ে বিশেষ নাট্যোৎসবের আয়োজন করা যেতে পারে এবং এ উৎসবে দর্শককে সম্মান জানাতে প্রবেশাধিকার অবাধ রাখা যায়।
ঠ. নাট্যদলগুলো সারা দেশে দর্শকের অবাধ প্রবেশাধিকার রেখে বিশেষ নাট্য প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করতে পারে।

No comments

Powered by Blogger.