রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা-বিশ্ব সম্প্রদায় সক্রিয় ভূমিকা নিক

বাংলাদেশের মতো জনবহুল স্বল্পোন্নত দেশে শরণার্থীরা বড় ধরনের বোঝা_ তুর্কমেনিস্তানের রাজধানী আশগাবাগে ওআইসি মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলনে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই বক্তব্যে অংশগ্রহণকারীদের দ্বিমতের অবকাশ থাকতে পারে না। দীর্ঘ অস্থিতিশীলতার শিকার মুসলিম বিশ্বের আরও কয়েকটি দেশও এমন সংকটের মুখোমুখি। কিন্তু বাংলাদেশের পরিস্থিতি অন্য ভ্রাতৃদেশের তুলনায় বেশি জটিল।


মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীরা আর পাঁচটি দেশের বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠীর মতো আশ্রয়দাতার অর্থনীতিতেই কেবল বোঝা হয়ে নেই। দুই দশক ধরেই তারা বৃহত্তর চট্টগ্রামের সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় ইন্ধন জুগিয়ে চলছে। স্থানীয় প্রভাবশালীদের বুলেট ও ব্যালটের জোগান হিসেবে তারা কাজ করছে বলে প্রমাণিত অভিযোগ রয়েছে। ভিন দেশে অন্যের দয়ায় নির্ভরশীল একটি জনগোষ্ঠীর টিকে থাকার এটাই সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি, সন্দেহ নেই। সবচেয়ে বড় সংকট, জাতিসংঘ স্থাপিত অস্থায়ী শিবিরের বাইরেও তাদের ব্যাপকমাত্রায় ছড়িয়ে পড়া। যতসংখ্যক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী শিবিরে স্থান পেয়েছে, তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি মিশে গেছে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় বিভিন্ন জনপদে। রোববার সমকালেই প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, কক্সবাজারের টেকনাফে মিয়ানমার থেকে বিতারিত এই নাগরিকদের কেউ কেউ ভোটার তালিকায় নাম ওঠানো কিংবা পাসপোর্ট সংগ্রহের পাশাপাশি জমি-জমা কিনছে। তৈরি করছে বহুতল ভবন। এটা ঠিক, ধর্ম, নৃতাত্তি্বক ও ভাষাগত মিলের কারণে তাদের আলাদা করা কঠিন। কিন্তু এর বিকল্পও নেই। দুই দশকের অসতর্কতায় সীমিত পরিমাণে হলেও রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য অংশেও রোহিঙ্গারা বসতি গড়ছে। এমনকি তাদের কারণে বিশ্বে আমাদের জনশক্তি বাজারও হুমকির মুখে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি পাসপোর্টধারী রোহিঙ্গারা যে অপরাধকর্ম করছে, তার দায় বহন করতে হচ্ছে প্রবাসী বাংলাদেশিদের। চলতি মাসের গোড়ার দিকে হত্যা ও চুরির দায়ে সৌদি আরবে যে দুই 'বাংলাদেশি' শিরশ্ছেদের শিকার হয়েছে, তারা আসলে রোহিঙ্গা। ঘরে-বাইরে সংকট সৃষ্টির এই চোরা প্রবাহ থামাতেই হবে। শরণার্থী বিষয়ক কনভেনশন ও প্রটোকলে স্বাক্ষর না করেও বাংলাদেশ নিজের অনেক বোঝার ওপর রোহিঙ্গা শাকের আঁটি অনন্তকাল বয়ে চলতে পারে না। ওআইসি বিলম্বে হলেও যে শরণার্থী ইস্যুতে নজর দিয়েছে, সেজন্য ধন্যবাদ পেতেই পারে। আশগাবাগের সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী যথার্থই বলেছেন, আন্তঃমুসলিম দেশের পাশাপাশি ওআইসি বহির্ভূত দেশগুলোকে সংযুক্ত করেও সংলাপ জরুরি। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে রোহিঙ্গা শরণার্থীর ভার বহনেও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার যে প্রস্তাব তিনি রেখেছেন, তাও সমর্থনযোগ্য। একই সঙ্গে অভ্যন্তরীণ কিছু পদক্ষেপও জরুরি হয়ে পড়েছে বলে আমরা মনে করি। প্রথমত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বাংলাদেশি পাসপোর্ট ও ভোটাধিকার প্রাপ্তি যে কোনো মূল্যে ঠেকাতে হবে। সংশ্লিষ্টরা সতর্ক হলে এই কাজ কঠিন হতে পারে না। ইতিমধ্যে যারা আশ্রয় নিয়েছে, তাদের নির্ভুল তালিকা করার বিষয়টি সরকারের অগ্রাধিকারে থাকতে হবে। স্থানীয় রাজনৈতিক ও সামাজিক গোষ্ঠীগুলোর সচেতনতা ও ইতিবাচক সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করতে হবে প্রশাসনকে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সীমান্ত অতিক্রমের প্রশ্নে দেখাতে হবে শূন্য সহিষ্ণুতা। তাদের ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে মিয়ানমার সরকারের সঙ্গেও আলোচনায় গতি আনা জরুরি। অধিকারবঞ্চিত ও নিপীড়িত একটি জনগোষ্ঠীর বিষয় আমরা নিশ্চয়ই সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করব। কিন্তু সেটা নির্বিচারে, নিজের স্বার্থ ক্ষুণ্ন করে কোনোভাবেই নয়। এই বাস্তবতা খোদ রোহিঙ্গারাও বুঝবে এবং শান্তি ও স্থিতিশীলতার সঙ্গে নিজভূমে ফেরার বিষয়টিকেও সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
 

No comments

Powered by Blogger.