সপ্তাহের হালচাল-ছাত্রলীগকে হতে হবে ছাত্রদের লীগ by আব্দুল কাইয়ুম

আপনি যদি কোনো গুরুতর ব্যাপারে কথা দিয়ে কথা না রাখেন, তাহলে সমাজে হেয় হতে হবে। এটা রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রেও খাটে। যদি প্রভাবশালী রাজনৈতিক দল প্রতিশ্রুতির খেলাপ করে, তাহলে তো ছি ছি পড়ে যাওয়ার কথা।


ঠিক এ রকমই এক লজ্জাজনক ব্যাপার ঘটে চলেছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মতো প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো এই সেদিন নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন করিয়েছে এই বলে যে ছাত্রদের মধ্যে তাদের কোনো অঙ্গসংগঠন থাকবে না; অথচ এর পর থেকে মনে হচ্ছে, অঙ্গসংগঠন ছাড়া বোধহয় তাদের আর কিছু নেই। সম্মেলন থেকে শুরু করে সন্ত্রাসী ঘটনায় সাংসদ ও দলীয় নেতাদের সম্পৃক্ততা এত বেশি যে নির্বাচন কমিশনের পক্ষেও নিশ্চুপ থাকা কঠিন। তারা চিঠি দিয়ে ব্যাখ্যা দাবি করেছে। এখন রাজনৈতিক দলগুলো কী বলবে?
তাত্ক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম দাবি করেছেন যে ছাত্রলীগ তাঁদের একটি ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন, অঙ্গসংগঠন নয়। এটা সত্যের অপলাপ। আওয়ামী লীগ এখনো ছাত্রলীগকে তাদের আজ্ঞাবহ একটি সংগঠন হিসেবে ব্যবহার করছে এবং তাদের আদেশ অনুযায়ীই ছাত্রলীগ চলছে। সম্প্রতি ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র আবু বকর সিদ্দিক নিহত হলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওই ঘটনার কারণ বের করা ও করণীয় নির্ধারণে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানকসহ দুজনকে দায়িত্ব দেন। এরই ভিত্তিতে গত ৬ ফেব্রুয়ারি তাঁরা ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। প্রশ্ন হলো, ছাত্রলীগের সঙ্গে তো আওয়ামী লীগের কোনো সাংগঠনিক সম্পর্ক থাকার কথা নয়। কোন এখতিয়ারে তাঁরা গেলেন সেখানে? আর প্রধানমন্ত্রী নিজে কীভাবে মন্ত্রী-নেতাদের সেখানে পাঠালেন? এরপর আওয়ামী লীগ কি দাবি করতে পারে যে ছাত্রলীগ নিজেদের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী চলছে? তারা স্বাধীন?
ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী ঘটনায় যদি মন্ত্রী মীমাংসা করতে যান, তাহলে পুলিশ কি কোনো আসামির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সাহস পাবে? আবু বকর সিদ্দিক হত্যার ঘটনা তো ইতিমধ্যেই প্রায় ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে। কয়েকজন অভিযুক্তকে জেলখানায় পাঠিয়ে এবং তাদের কয়েকজনকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাময়িক বহিষ্কার করেই যথেষ্ট দায়িত্ব পালন করা হয়েছে বলে তাঁরা ধরে নিয়েছেন।
সম্প্রতি যশোরে ছাত্রলীগের সম্মেলনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সহিংসতা ও জেলা ছাত্রলীগের নেতা রিপন হোসেনকে হত্যার পেছনে আওয়ামী লীগের দুই নেতার দ্বন্দ্ব কাজ করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। একদিকে দলীয় নেতা খালেদুর রহমান টিটো, অন্যদিকে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আলী রেজা ও সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদারের জোট। তাঁদের মধ্যে দলীয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লড়াই চলছে, আর প্রাণ দিতে হচ্ছে ছাত্রলীগের নেতার। উভয় পক্ষই বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের দরপত্র নিয়ন্ত্রণ ও মাদক ব্যবসার মতো অবৈধ বাণিজ্যের বখরা আদায়ে একক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে চায়। অভিযোগ রয়েছে যে তাঁরা এসব অনৈতিক ও অপরাধমূলক তৎপরতায় ছাত্রলীগকে ব্যবহার করেন এবং তাই অনুগত ছাত্রনেতাদের নেতৃত্বে আনার জন্য খুনোখুনি করতেও তাঁরা দ্বিধা করছেন না। এগুলো কোনো মনগড়া অভিযোগ নয়। যশোর আওয়ামী লীগের নেতারাই প্রকাশ্যে এসব আলোচনা করছেন। পত্রিকায়ও এসব কাহিনী বেরিয়েছে।
আওয়ামী লীগ এখন ক্ষমতায়। তাই ছাত্রলীগের সহিংস ঘটনা বড় হয়ে সামনে আসছে। ছাত্রদল তুলনামূলকভাবে নিশ্চুপ। কারণ নির্বাচনে বিপুল পরাজয়ের পর তারা এক কথায় নির্জীব হয়ে পড়েছে। যদি ছাত্রদলের সঙ্গে বিএনপির সম্পৃক্ততা না থাকত, তাহলে নির্বাচনের ফলাফল তো তাদের ওপর খুব বেশি প্রভাব ফেলতে পারত না। হয়তো বিএনপি দুর্বল হয়ে পড়ত, কিন্তু ছাত্রদল মাঠে থাকতে পারত। আজ ছাত্রদলের নির্জীব অবস্থান প্রমাণ করে যে তারাও বিএনপির কার্যত অঙ্গসংগঠন হিসেবেই চলছে। বিএনপির উত্থান-পতনের সঙ্গে তাদের ভাগ্যও ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। অবশ্য অঙ্গসংগঠন না রাখার বিষয়টি এসেছে সম্প্রতি। এর আগে ছাত্রদল ছিল ঘোষিতভাবে বিএনপির অঙ্গসংগঠন। সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আমলে ১৯৭৬ সালে রাজনৈতিক দলবিধি (পিপিআর) আইনে সব দলের ছাত্র ও অন্যান্য সংগঠনকে অঙ্গসংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করতে হয়েছে। তখন যুক্তি দেখানো হয়েছিল যে রাজনৈতিক দলগুলো ছাত্র ও অন্যান্য সংগঠনের কার্যকলাপের পূর্ণ দায়দায়িত্ব না নিলে তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে না। বিশেষভাবে ছাত্র সংগঠনের ব্যাপারে জিয়াউর রহমান অতিমাত্রায় সতর্ক ছিলেন। কারণ ছাত্ররা সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সব সময় সোচ্চার। তাই তাদের দায়দায়িত্ব রাজনৈতিক দলের ঘাড়ে চাপানো হয়।
রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ছাত্র সংগঠন আগেও সম্পর্ক রাখত, কিন্তু সেটা ছিল মূলত আদর্শগত। আওয়ামী লীগের সঙ্গে ছাত্রলীগ, ন্যাপ-সিপিবির সঙ্গে ছাত্র ইউনিয়নের সম্পর্ক ছিল সর্বজনবিদিত। কিন্তু সংগঠন হিসেবে তারা ছিল অলাদা। কোনো ছাত্র সংগঠন তাদের সম্মেলনে বা অনুষ্ঠানে রাজনৈতিক নেতাদের আমন্ত্রণ জানাত না। জিয়াউর রহমানের আইনের ফলে সংগঠন আর দল একাকার হয়ে গেল। ছাত্রলীগের অফিস নিউমার্কেটের কাছে বলাকা ভবন থেকে সোজা আওয়ামী লীগ অফিসে চলে গেল। স্বয়ং সেনাশাসক জিয়াউর রহমানের আমন্ত্রণে মেধাবী শিক্ষার্থীদের হিজবুল বাহার জাহাজে করে সমুদ্র ভ্রমণে নিয়ে যাওয়া হলো। এধরনের প্রমোদ ভ্রমণের আয়োজন চললো আরো কয়েক বছর। তারপর শুরু হলো তাদের দলে ভিড়ানোর পালা। এদেরই উত্তরসূরি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সশস্ত্র ক্যাডার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। দলীয় ছাত্র সংগঠনের নেতাদের চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়।
বিগত বিএনপি সরকারের সময়, ২০০২ সালের ৮ জুন ব্যুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্রদলের ক্যাডারদের দুই প্রতিপক্ষ গ্রুপ টেন্ডার ছিনতাইয়ের জন্য বন্দুকযুদ্ধে লিপ্ত হয়। গোলাগুলির মধ্যে পড়ে দ্বিতীয় বর্ষের মেধাবী ছাত্রী সাবিকুন্নাহার সনি নিহত হন। সে সময় খুনি চক্রের বিরুদ্ধে যে তাত্ক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি, তার কারণ ওই দলীয় সম্পৃক্ততা। ক্ষমতাসীন বিএনপি বহু দিন পর্যন্ত অভিযুক্ত খুনিদের প্রশ্রয় দিয়েছে। এরপর মাসখানেক না যেতেই, ২৩ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন্নাহার হলে সিট দখলের জন্য ছাত্রদলের নেত্রীরা ছাত্রলীগের কর্মী ও সাধারণ ছাত্রীদের ওপর সহিংস হামলা চালায়। এ কাজে বিএনপির নেতাদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ছিল বলে অভিযোগ ওঠে। সরকারি ক্ষমতা ব্যবহার করে রাতের বেলায় পুলিশ ছাত্রীদের হলে ঢুকে নির্যাতন চালায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক অধ্যায় সেদিন রচিত হয়।
দলীয় সম্পৃক্ততার এসব ভয়াবহ পরিণতি এড়ানোর জন্যই ২০০৯ সালের গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে ছাত্র ও শ্রমিক সংগঠনকে মূল রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠন না রাখার বিধান করা হয়েছে। বিএনপি সেটা মেনেও নিয়েছে। এরপর এটাই স্বাভাবিক যে তারা প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবে। কিন্তু তারা তো আগের ধারাতেই চলছে। এমনকি বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সম্প্রতি এক সমাবেশে ছাত্রদলকে বিএনপির সংগঠন বলে উল্লেখ করেছেন। যদি অভ্যাসবশে বলে থাকেন, তাহলে তো পরে কোনো উপলক্ষে সেটা উল্লেখ করা যেত। কিন্তু সেটা করা হয়নি। তাতে মনে হয় বিএনপি সচেতনভাবেই ছাত্রদলকে নিজেদের সঙ্গে জড়িয়ে রাখছে। নানা ঘটনায় এই মনোভাব প্রকাশও পাচ্ছে। বিগত ১৭ ফেব্রুয়ারি ছাত্রদলের বর্ধিত সভা উদ্বোধন করেন বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। খালেদা জিয়া ছাত্রদলের কমিটিতে ছাত্র ছাড়া অন্য কাউকে না রাখা, বয়স্কদের স্থান না দেওয়া প্রভৃতি বিষয়ে নীতিনির্ধারণী বক্তব্য দেন এবং পরবর্তী তিন মাসের মধ্যে ছাত্রদলের একটি স্থায়ী গঠনতন্ত্র করার ‘নির্দেশ’ দেন। প্রশ্ন হলো, একটি স্বাধীন সংগঠন কীভাবে চলবে, সে ব্যাপারে নির্দেশ কেন খালেদা জিয়া দিচ্ছেন? বিএনপির গঠনতন্ত্রে তো ছাত্রদলকে অঙ্গসংগঠন হিসেবে রাখা হয়নি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া দেশের মূল নেতা। ছাত্র সংগঠন ও ছাত্রনেতাদের ভালোর জন্যই তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। শুধু মুখের কথায় নয়, বাস্তব ক্ষেত্রেও ছাত্র সংগঠনগুলোর সঙ্গে দলের সমস্ত সংশ্লিষ্টতা ত্যাগ করা উচিত। প্রথম কাজ হবে নিজেদের দূরে রাখা। ছাত্র সংগঠনের সম্মেলন বা সভায় তাঁরা যাবেন না। কোনো নেতা বা মন্ত্রীর সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ উঠলে তাঁদের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে কারণ দর্শানোর আদেশ দিতে হবে। ছাত্রনেতাদের ওপর দলীয় মন্ত্রী-নেতাদের প্রভাব বিস্তারের যেকোনো অপচেষ্টাকে দলীয় শৃঙ্খলাবিরোধী কাজ হিসেবে গণ্য করে এর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রশ্ন হলো তাঁরা নিজেরা সরে দাঁড়াতে কতটা প্রস্তুত? নিজেরা সরে না দাঁড়ালে কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া যাবে না।
ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের মতো সংগঠনগুলো অবশ্যই থাকবে, কিন্তু ছাত্রলীগ হবে কার্যত ‘ছাত্রদের লীগ’ আর ছাত্রদল হবে ‘ছাত্রদের দল’। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এই সরল সমীকরণটি মানতে রাজি কি না, তার ওপর নির্ভর করছে ভবিষতে ছাত্র সংগঠন অতীতের গৌরবোজ্জ্বল ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনতে পারবে কি পারবে না।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.