রঙ্গব্যঙ্গ-ভুল, সবই ভুল! by মোস্তফা কামাল

শুরুতেই একটা গল্প বলি। ২০০৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে হামলা করার সিদ্ধান্ত নিল। ইরাকের বিরুদ্ধে অভিযোগ, দেশটিতে মানববিধ্বংসী মারণাস্ত্র রয়েছে। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন এ অভিযোগ সম্পর্কে খোলাসা করে কিছুই বলেননি। কারণ তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে একটা ভয়ের মধ্যে রাখতে চেয়েছিলেন।


যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে বড় শক্তির দেশ হলেও জুজুকে খুব ভয় পায়। সেটা সাদ্দাম ভালো করেই জানতেন। কারণ সাদ্দাম একসময় যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। ইরানের সঙ্গে যুদ্ধে ইরাককে অস্ত্র ও অর্থ সহায়তা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। কী কারণে যেন সাদ্দামকে যুক্তরাষ্ট্র অপছন্দ করতে শুরু করল। হয়তো তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সব আবদার রাখতে পারেননি। তাই তাঁকে সরাতে হবে। সেটা যেকোনো অজুহাতেই হোক।
যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ খতিয়ে দেখছিল জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞ দল। কিন্তু তারা ইরাকের কাছে মানববিধ্বংসী অস্ত্রের কোনো সন্ধান পায়নি। যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ তাতেও ক্ষান্ত হলেন না। তিনি বললেন, ইরাক যতই না বলুক, আমরা জানি ইরাকের কাছে মানববিধ্বংসী অস্ত্র রয়েছে। তখন বিশ্ববাসী ধরে নিয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্র হয়তো সেসব অস্ত্রের জোগানদাতা। তা না হলে যুক্তরাষ্ট্র এতটা নিশ্চিত হলো কী করে। মার্কিন গোয়েন্দাদের দিয়েও বারবার বলানো হলো, ইরাকের কাছে মানববিধ্বংসী অস্ত্র রয়েছে। সারা বিশ্বের প্রতিবাদের মুখেই যুক্তরাষ্ট্র শুরু করল ইরাকের ওপর আক্রমণ। যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম সহযোগী ছিল যুক্তরাজ্য। ইরাক পাল্টা আক্রমণ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে পাওয়া কিছু স্কাড ক্ষেপণাস্ত্র ছাড়ল। ওই পর্যন্তই।
বোঝাই যাচ্ছিল, যুক্তরাষ্ট্র তেলসমৃদ্ধ অঞ্চল মধ্যপ্রাচ্যে ঢুকতে চাচ্ছিল। ইরাকে বৃষ্টির মতো বোমা হামলা চালানো হলো। কিন্তু পাল্টা আক্রমণ করতে ব্যর্থ হলো ইরাক। যুক্তরাষ্ট্রের হামলায় ক্ষতবিক্ষত হলো দেশ, দেশটির মানুষ। অবসান ঘটল সাদ্দাম যুগের।
মানুষ যখন দেখল, ইরাকের কাছে আসলে মানববিধ্বংসী কোনো অস্ত্রই ছিল না তখন বিশ্ব গণমাধ্যম আমেরিকার কঠোর সমালোচনা করতে শুরু করল। যুক্তরাষ্ট্রের সিভিল সোসাইটিও বুশের সমালোচনা করে বলতে শুরু করল, বুশের ইরাক হামলার সিদ্ধান্ত ভুল ছিল। বুশকেও তারা সেই কথাটি বারবার স্মরণ করিয়ে দিল।
এর জবাবে বুশ কী বলেছিলেন! তিনি বললেন, ভুল! কিসের ভুল? আমি তো কোনো ভুল করিনি! আমার উদ্দেশ্য ছিল মধ্যপ্রাচ্যের তেল অঞ্চলে ঢোকা। আমরা ঢুকেছি। এতে আমরা লাভবান হয়েছি। কাজেই আমি ভুল করিনি।
শেষ পর্যন্ত বুশকে কিন্তু তাঁর ভুলের খেসারত দিতে হয়েছে।

২.
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শাজাহান সিরাজ বিএনপির শাসনামলে একবার পরিবেশমন্ত্রী হয়েছিলেন। তিনি ছাত্রজীবনে ছিলেন ডাকসাঁইটে নেতা। বঙ্গবন্ধুর চার খলিফার এক খলিফা। মুক্তিযুদ্ধে তিনি অসামান্য ভূমিকা রেখেছিলেন। সেই মানুষটি একসময় জাসদ রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। তারপর পল্টি খেয়ে বিএনপিতে যান। বিনিময়ে তিনি মন্ত্রীর আসনে বসতে সক্ষম হন।
শাজাহান সিরাজ যে উদ্দেশ্য নিয়ে বিএনপিতে ঢোকেন তাতে তিনি সফল হন। এখন আর বিএনপির কাছ থেকে তাঁর পাওয়ার কিছু নেই। তাই এখন তিনি বলছেন ভিন্ন কথা। তিনি বললেন, বিএনপিতে যোগ দেওয়া ছিল তাঁর বড় ভুল! এটা কি তাঁর মনের কথা? নাকি মান-অভিমান চলছে বিএনপির সঙ্গে!
শাজাহান সিরাজ বলছেন, বিএনপি জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষক। মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি। এ দলটি যুদ্ধাপরাধের বিপক্ষে কাজ করছে। এ জন্য তিনি বিএনপির রাজনীতি থেকে দূরে সরে গেছেন। বিএনপিতে যোগ দেওয়ার অপরাধে প্রয়োজনে তিনি জাতির কাছে ক্ষমা চাইবেন।
তাঁর এ বক্তব্য শুনে তাঁকে কিছু প্রশ্ন করার লোভ সামলাতে পারছি না। এত দিন পর তিনি তাঁর ভুল বুঝতে পারলেন! তিনি যখন বিএনপিতে যোগ দেন তখন তিনি কি জানতেন না, বিএনপি মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি? জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির নিবিড় সম্পর্কের কথা কে না জানে! তিনি যখন বিএনপিতে যোগ দিয়েছিলেন তখনো তো জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠই ছিল! তারা তো নতুন করে তাদের রাজনৈতিক গতিধারা পরিবর্তন করেনি!
শাজাহান সিরাজ অবশ্য বলেছেন, তিনি একটা ভালো উদ্দেশ্য নিয়ে বিএনপিতে যোগ দেন। বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করবেন। একসঙ্গে কাজ করবেন। তাতে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। আসলেই কি তিনি সে রকম কোনো উদ্যোগ নিয়েছিলেন? নাকি নিজের ফায়দা হাসিলে ব্যস্ত ছিলেন? বিত্তবৈভবের ঘোরে মত্ত ছিলেন?
আমরা জানি না, শাজাহান সিরাজের ভুলটা বুশের মতো ইচ্ছাকৃত কি না। তবে তিনি এখন বলছেন, তিনি তাঁর ভুল বুঝতে পেরেছেন। এখন তিনি ভুল শোধরাতে চাচ্ছেন। কিন্তু তিনি যখন বিএনপিতে যোগ দিয়েছিলেন তখন তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, আপনি হঠাৎ বিএনপিতে যোগ দিচ্ছেন কেন? বিএনপি তো কখনোই আপনার পছন্দের দল নয়।
শাজাহান সিরাজ এর জবাবে বলেছিলেন, 'আমি মনে করি বিএনপিতে যোগ দিলে আমি আমার রাজনৈতিক আদর্শ বাস্তবায়ন করতে পারব।'
মানুষ সেসব কথা যদি ভুলে গিয়ে থাকে তাহলে শাজাহান সিরাজ হয়তো পার পেয়ে যাবেন। অন্যথায় তাঁর ভুলের দায় তাঁকেই বহন করতে হবে।
আমরা জানি, কখনো কখনো ভুলের মাসুল দিতে হয়। আবার কখনো ভুল শোধরানো সম্ভব হয়ে ওঠে। শাজাহান সিরাজ ভুল শোধরানোর সুযোগ পাবেন কি না তা দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.