ধানের দাম আশানুরূপ বাড়ছে না by ইফতেখার মাহমুদ

মাঠে ফলন হয়েছে ভালো। তাই হাটে ধানের সরবরাহ বেশি। কিন্তু সে তুলনায় ক্রেতা কম। তাই ধানের দাম আশানুরূপ বাড়ছে না। এর জন্য সরকার ও মিলমালিক দুই পক্ষের ধীরে চলাই দায়ী বলে মনে করা হচ্ছে।কৃষক যাতে ধানের ন্যায্য মূল্য পায়, তা নিশ্চিত করতে সরকার প্রতি মণ ধানের সংগ্রহমূল্য ৭২০ টাকা ঘোষণা করেছে।


কিন্তু তাতেও বাজারে মাঝারি মোটা ধানের মণ ৫৮০ থেকে ৬২০ টাকার ওপরে উঠছে না। এখন ধানের মূল ক্রেতা হওয়ার কথা চালকলের মালিক ও ধান ব্যবসায়ীরা। কিন্তু তাঁরা সেই অর্থে বাজারে সক্রিয় নন।
মাঠপর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকারের ধান-চাল সংগ্রহের ঘোষণায় ধানের দাম প্রতি মণে ৩০ থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। এবার প্রতি মণ ধানের উৎপাদন খরচ ধরা হচ্ছে ৬৫০ টাকা।
সরকারের ঘোষণায় দেশের অন্যতম ধানভান্ডার হাওরের চিত্র বদলে গেছে। হাওরের কৃষকেরা ধান বিক্রি কমিয়ে দিয়েছেন। সেখানে প্রতি মণ ধান বিকোচ্ছে মানভেদে ৫০০ থেকে ৫৭০ টাকায়। ওই অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা মনে করছেন, দাম আরও ৬০-৭০ টাকা না বাড়ালে গোলা থেকে ধান বাজারে আসবে না। প্রাপ্ত তথ্যমতে, হাওরের ৯০ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ৩০ লাখ টন ধান কাটা হয়ে গেছে।
বোরো মৌসুমে ১০ লাখ টন ধান-চাল সংগ্রহের ঘোষণা দিয়েছে সরকার। ৩ মে এই ঘোষণা দেওয়ার পর ১০ দিন পার হয়ে গেছে। এখনো সরকার ও চালকলের মালিকদের মধ্যে চুক্তি শেষ হয়নি। রাজশাহী জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক বলছেন, সংগ্রহ আদেশসহ মিলমালিকদের সঙ্গে চুক্তির কাগজপত্র না পাওয়ায় তাঁরা সংগ্রহ অভিযান শুরু করতে পারেননি। আর কুষ্টিয়া, দিনাজপুর, নওগাঁ ও জয়পুরহাটের বড় চাল ব্যবসায়ী ও ব্যবসায়ী সমিতির নেতারা জানান, সরকারের দিক থেকে এখনো চুক্তির কোনো আহ্বান জানানো হয়নি। সরকারের নির্ধারিত দাম ঠিক আছে। তাঁরা এই দামে সরবরাহ করতে পারবেন।
চাল ব্যবসায়ীরা বলছেন, গতবার বাম্পার বোরো ও আমনের সুফল হিসেবে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ লাখ টন চাল ব্যবসায়ীদের গুদামে রয়ে গেছে। সরকারি গুদামেও রয়েছে প্রায় ১২ লাখ টন চাল-গম। সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় যে চাল বণ্টন হতো, তার গতিও ধীর। আগামী মার্চের মধ্যে ১০ লাখ টন চাল বণ্টনের জন্য সরকারের কাছে বাজেট রয়েছে। কিন্তু চালের দাম কম থাকায় খোলাবাজারে বিক্রি, ফেয়ার প্রাইসসহ অন্যান্য কার্যক্রম প্রায় বন্ধ রয়েছে। তাই নতুন চাল তোলার জন্য গুদাম খালি করা কঠিন হয়ে পড়ছে।
রপ্তানির পরামর্শ: খাদ্য পরিধারণ ও মূল্যায়ন কমিটির সর্বশেষ সভায় সরকারি গুদাম দ্রুত খালি করতে ২০ টাকা কেজি দরে খোলাবাজারে চাল বিক্রির প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু সভায় উপস্থিত বিশেষজ্ঞরা এতে চালের দাম আরও কমে এর প্রভাব ধানের ওপরও পড়তে পারে বলে মত দেন। ধানের দাম বাড়ানোর জন্য চাল রপ্তানির সুপারিশ উঠলে তা বিবেচনা করার জন্য বলা হয়।
খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনামন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, রপ্তানির অনুমতি দেওয়ার চিন্তা-ভাবনা সরকারের তরফ থেকেও করা হচ্ছে। মে থেকে জুন পর্যন্ত দেশে ঝড়-জলোচ্ছ্বাস ও বন্যার আশঙ্কা বেশি থাকে। এই সময়ের মধ্যে যদি কোনো দুর্যোগ না হয়, তাহলে সরকার সীমিত পরিসরে চাল রপ্তানির অনুমতি দিতে পারে।
ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক মাহবুব হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে চালের কেজি ৩৫ থেকে ৪০ টাকা। আফ্রিকার দেশগুলোতে বাংলাদেশে উৎপাদিত মাঝারি মানের চালের চাহিদা রয়েছে। ধান-চালের দাম কম থাকার সুযোগে সরকার আগামী জুলাই মাস পর্যন্ত সীমিত পরিমাণে চাল রপ্তানির অনুমতি দিতে পারে। তিনি বলেন, এতে ধানের দাম কিছুটা বাড়ত। আর বাংলাদেশও কৃষির সাফল্য দেখিয়ে চাল রপ্তানিকারক দেশের সৌভাগ্যবান তালিকায় নাম লেখাতে পারত।
বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) ও যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিবিষয়ক সংস্থা ইউএসডিএ সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে প্রতি টন চাল ৪০৫ থেকে ৫৫০ ডলারে বিক্রি হচ্ছে। আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলো বর্তমানে বিশ্ববাজার থেকে চাল কিনছে।
ভৈরবে প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক সুমন মোল্লা জানান, আশুগঞ্জ ও ভৈরবের ধানের মোকামে গত শুক্রবার থেকে দর কিছুটা বাড়লেও সরবরাহ কিছুটা কমেছে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতিদিন এই দুই বাজারে সরবরাহ কমেছে ৭০ থেকে ৮০ হাজার মণ। সামান্য এই দাম বৃদ্ধিতে কৃষকের মুখের কষ্টের ছাপ দূর হচ্ছে না।
গত তিন দিনে বিশেষ করে বিআর ২৮, ২৯ শুকনা ধানের দাম বেড়েছে মণপ্রতি ৩০ টাকা। তার পরও উৎপাদন খরচ থেকে প্রতি মণে ১০০ টাকা পিছিয়ে আছেন কৃষক। এ অবস্থায় তাঁরা বিশেষ ব্যয় মেটানোর প্রয়োজন ছাড়া ধান বিক্রি করছেন না, গোলায় রেখে দিচ্ছেন।
ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জের ইটনা, নিকলী, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম, সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ, সাল্লা, দিরাই, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল, নাসিরনগরসহ হাওরের ৩২ উপজেলার প্রায় ৯০ শতাংশ ধান কেনাবেচা হয় আশুগঞ্জ ও ভৈরব মোকামে।
গতকাল রোববার আশুগঞ্জে ও গত শনিবার ভৈরব মোকামে গিয়ে জানা যায়, বাজারে আগের সপ্তাহের চেয়ে ক্রেতা-বিক্রেতা কম। নেই মেঘনাপাড়ে ধানবোঝাই ট্রলারের জটও।
আশুগঞ্জের ধান ব্যবসায়ী উজ্জ্বল মিয়া বলেন, ‘দাম বাড়ছে, তবে কৃষক ধান আটকাইয়া ফালাইছে। সরকারিভাবে ধান কেনা শুরু হইলে হয়তো দাম আরও কিছুটা বাড়ব। আজ (রোববার) বিআর ২৮ ও ২৯ শুকনা ধান ৫৬০ টাকা দরে কিনছি। এক সপ্তাহ আগে ওই ধান ৫২০ টাকা দিয়ে কিনছিলাম। ৪৭০ টাকার ভিজা ধান আজ কিনছি ৫১০ টাকা দরে।
ভৈরব ধান-চাল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির বলেন, হাওরের কৃষকেরা ধান আটকে দিয়েছেন। গোলার ধান বাজারে আনতে হলে মণপ্রতি দাম বাড়াতে হবে আরও ৭০ থেকে ৮০ টাকা।
রাজশাহীতে প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান শুরু না হওয়ায় কৃষক বিপাকে পড়েছেন। তানোর উপজেলার জিওল গ্রামের কৃষক হাবিবুর রহমান বলেন, তিনি ইতিমধ্যে বিআর-২৮ ধান ৬৪০ টাকা মণ দরে ৮০ মণ বিক্রি করেছেন। তিনি বলেন, ‘সার-কীটনাশক বাকি করে ধান আবাদ করেছি। তাই আগেভাগে বেচতে হচ্ছে।’

No comments

Powered by Blogger.