যশোরে উদীচীর অনুষ্ঠানে সেদিন যা ঘটেছিল by এ এন রাশেদা


কী ভয়ংকর ছিল সেই দুঃসংবাদ। ১৯৯৯ সালের ৬ মার্চ যশোর শহরে চলছিল বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর দ্বাদশ জাতীয় সম্মেলন। সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান যখন চলছিল, অনুষ্ঠানস্থল জনসমাগমে পরিপূর্ণ। ঠিক সেই সময়ে প্রকম্পিত হয়ে উঠল সভামঞ্চ। বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হলো বোমা, আর রক্তাক্ত হয়ে লুটিয়ে পড়ল কিছু তাজা প্রাণ।


রক্তের ফল্গুধারার মধ্যে আরো আহত শতাধিক। যারা মানবতার গান গায়, তাদের প্রতি কী নিষ্ঠুর, কী বর্বরোচিত হামলা! ১৯৯৯ থেকে ২০১১_চলে গেল ১১টি বছর। রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল তখন মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। আর উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী সংগঠন_কেউ গান গেয়ে, কেউ রাইফেল কাঁধে নিয়ে, কেউ সংগঠক হিসেবে। ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে উদীচীর ছিল সক্রিয় অবস্থান। যেখানেই গণজমায়েত, বিক্ষোভ সমাবেশ_সেখানেই ছোট ট্রাকে করে জনাকয়েক শিল্পী নিয়ে সদ্য-গঠিত উদীচীর ছিল অংশগ্রহণ_'আগুনের পরশমণি', 'ও আমার দেশের মাটি', 'আমার সোনার বাংলা', 'বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা_আজ জেগেছে সেই জনতা', এমন সব আগুনঝরা গান সমবেত জনতার মধ্যে জাগাত আরো উদ্দীপনা, সংগ্রামকে করত আরো বেগবান। ১৯৬৯-এর পথ ধরেই এল ১৯৭০-এর জাতীয় নির্বাচন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা। এল ১৯৭১_পাকিস্তানি প্রতারণা ও শোষণ-যন্ত্রণার বিরুদ্ধে ১ মার্চেই ফুঁসে উঠল জনগণ। ৭ মার্চ ১৯৭১ স্বাধীনতার ডাক দিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেই পথ ধরেই এল স্বাধীনতা। তারপর ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট_অত্যন্ত নিষ্ঠুর ও নৃশংসভাবে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার মধ্য দিয়ে জাতির জীবনে নেমে এল ঘোর অন্ধকার। জাতি কিংকর্তব্য বিমূঢ়। সেই দুঃসংবাদে উদীচী দিল যেন পথের দিশা। মাত্র ছয় মাসের মাথায় ১৯৭৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানে উদীচী গান ধরল সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতা অবলম্বনে 'এ দেশ বিপন্ন আজ', সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা থেকে 'প্রিয় ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য_ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা', মুকুন্দ দাসের 'ভয় কি মরণে রাখিতে সন্তানে'। বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো উঠে আসা জনতা করতালি দিয়ে বরণ করল উদীচীর অনুষ্ঠানকে। তারপর ১৯৭৬-এর ১৬ ডিসেম্বরেই উদীচী হাজির হলো_মাহমুদ সেলিম রচিত সাহসী ও সফল গীতি-আলেখ্য 'ইতিহাস কথা কও' নিয়ে। সে গীতি-আলেখ্যতে সনি্নবেশিত হলো_বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক সেই ভাষণ। উদীচীর সাহসিকতার ইতিহাসে যুক্ত হলো আরো নাম_সেন্টু রায়ের রচনা 'দিন বদলের পালা' সার্থক মঞ্চায়ন। আবার ১৯৭৭ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রমনার বটমূলে উদীচীর পরিবেশনায় উপস্থাপিত হলো গীতিনৃত্যনাট্য_'জানি রক্তের জোয়ারে জাগবে সুখের বান'। আর তাই উদীচী টার্গেটেড হলো স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের, যারা এ দেশকে পাকিস্তান বানাতে চায়। উদীচী সেই শক্তি, যারা মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে জনগণের মধ্যে দিন বদলের প্রেরণা জোগায়। এল ১৯৯০। সামরিক জান্তা এরশাদের পতনের মধ্য দিয়ে মানুষ স্বাধীনতার মর্মমূলে পেঁৗছানোর স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল। কিন্তু না, আবার সেই সামরিক বাহিনীর কোল থেকে উঠে আসা দলেরই জয়যাত্রা। সঙ্গে যুক্ত পাকিস্তানি ধ্যান-ধারণা। কিন্তু উদীচী কর্মকাণ্ড থামায়নি_অসাম্প্রদায়িক ও সাম্যের বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখিয়ে চলেছে অকুতোভয়ে। এল ১৯৯৬; ক্ষমতা ফিরে পেল মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ, সুদীর্ঘ একুশ বছর পর। উদীচী উদ্যোগ নিল দেশব্যাপী ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে স্বাধীনতার ইতিহাস রচনা প্রতিযোগিতার, যা তাদের জানতে দেওয়া হয়নি এবং মিথ্যা ও কাল্পনিক তথ্য দিয়ে সত্যকে চাপা দেওয়া হয়েছিল। ড. মো. হান্নান রচিত বই 'মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের কিশোর ইতিহাস'। লাখ লাখ কপি ছেপে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিতরণ করে পরীক্ষাপদ্ধতির মাধ্যমে আয়োজন করা হয়েছিল প্রতিযোগিতার। এ এক বিশাল কর্মকাণ্ড। একমাত্র উদীচীর পক্ষেই তা সম্ভব হয়েছিল, যার আছে দেশব্যাপী সংগঠন। এই যখন চলছিল উদীচীর কর্মকাণ্ড, তখন ১৯৯৯ সালের ৬ মার্চ হায়েনার দল ঝাঁপিয়ে পড়ল উদীচীর ওপর। ছিন্নভিন্ন হয়ে ছিটকে পড়ল নিথর ১০টি দেহ। নাজমুল হুদা, রতন বিশ্বাস, শাহ আলম মিলন, রামকৃষ্ণ, সৈয়দ বুলু, সন্ধ্যা রানী ঘোষ, নুরুল ইসলাম প্রমুখ। আজ ৬ মার্চ শ্রদ্ধাভরে তাঁদের স্মরণ করি। সমবেদনা জ্ঞাপন করি তাঁদের স্বজনদের আর শতাধিক পঙ্গুত্ববরণকারীকে, যাঁরা অভিশপ্ত জীবন যাপন করছেন। মনে পড়ছে আজ বিশেষভাবে শিল্পী সংগঠক ফয়সল মাহমুদকে। দিন নেই, রাত নেই_অক্লান্তভাবে যিনি আহত শিল্পীদের সেবা দান করেছিলেন শেরে বাংলা হাসপাতালে। তিনিও আজ নেই। এবার প্রশ্ন করতেই হয়, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল বঙ্গবন্ধুর দল যখন ক্ষমতায়, তখন অপরাধীদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়া হলো অপরাধ প্রমাণিত না হওয়ার চালে। তাই পরবর্তী সময়ে তারা যখন বেকসুর খালাস পেল, তখন বিচারকরা নিরুপায় হয়ে সেই কথাই বললেন। এতগুলো জীবন প্রদীপ নিভে গেল অকল্পনীয় বর্বরতা ও নির্মমতার শিকার ছাড়িয়ে, কিন্তু কেউ অপরাধী হলো না_এ কি সুবিচার!
২০১১ সাল। যখন বঙ্গবন্ধুর স্বীকৃত খুনিদের কেউ কেউ মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হলেন, যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়াধীন_তখন উদীচী কী ৬ মার্চের হত্যাকাণ্ডের পুনঃ বিচার আশা করতে পারে না? পুনঃ বিচার কি অসম্ভব? পঙ্গুত্ববরণকারী এবং নিহতদের পরিবারগুলো কি এতটুকু সান্ত্বনা পেতে পারে না, ন্যায়বিচারের প্রত্যাশায়!

লেখক : শিক্ষা গবেষক

No comments

Powered by Blogger.