বাজারদর-আমাদের জন্য দোয়া করবেন by মাইনুল এইচ সিরাজী

আমাদের ৬ বছর বয়সী মেয়ে কুশিয়ারা। এবার তার কিছু বুদ্ধিসুদ্ধি হয়েছে। তাই এবারের ঈদ নিয়ে তার অনেক পরিকল্পনা। রোজা শুরু হতে না হতেই তার স্কুলের খাতায় ঈদের কেনাকাটার তালিকা করা শুরু করেছে। সেই তালিকায় রয়েছে মায়ের জন্য শাড়ি, বাবার জন্য পাঞ্জাবি, নিজের জন্য জামা, জুতা, লিপস্টিক ইত্যাদি।


সে ঠিক করেছে ঈদ করবে দাদুবাড়িতে। তাই তার তালিকায় আরও আছে দাদুর জন্য শাড়ি-বল্গাউজ, ফুপির জন্য জামা, দাদুবাড়ির গৃহকর্মী ইয়াসমিনের জন্য জামা। দাদুকে সে ফোনে এসব জানিয়েছে। এখন দাদুও অপেক্ষা করছেন তার জন্য।
এখন সে প্রতিদিন এই তালিকা হালনাগাদ করছে। এ নিয়ে রীতিমতো উত্তেজিত সে। আনন্দ-উৎসাহের কমতি নেই। তার আনন্দে আমরা দু'জনও যোগ দিই। কিন্তু পরক্ষণে আবার বুকটা ধক করে ওঠে_ যখন ভাবি মেয়ের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা যাবে না। ওর আনন্দ-উৎসাহ আক্ষরিক অর্থেই মাটি হয়ে যাবে।
আমি চাকরিজীবী। বেতন পাই সাকুল্যে ১৭ হাজার টাকা। ৩ জনের সংসার। এ টাকা দিয়ে বাড়িভাড়া মিটিয়ে চট্টগ্রাম শহরে আমি থাকছি। আমি যে এরপর কষ্টকর জীবনযাত্রার ফিরিস্তি টানব_ সচেতন পাঠক নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের কষ্টগুলো, হতাশা-দীর্ঘশ্বাসগুলো, আমাদের বিব্রতবোধগুলো, লজ্জাগুলো তো চিরাচরিত। সবার কাছে পরিচিত। আমি আর নতুন করে কী বলব!
তবে হঠাৎই যেন দীর্ঘশ্বাস, হতাশা প্রলম্বিত হয়ে গেল মেয়ের ঈদবাজারের তালিকা দেখে। সুতরাং কিছুটা বলি। পাঠক আশা করি বিরক্ত হবেন না।
আগেই বলেছি আমাদের তিনজনের সংসার। আমাদের ১০ বছরের দাম্পত্যজীবনে সংসারটা স্বাভাবিকভাবেই ৪ জনের হতে পারত। কিন্তু হয়নি। ১ সন্তানের সাধ-আহ্লাদ মেটাতে না পেরে বুক ভেঙে যায়, আরও এক সন্তানের চিন্তা নিয়ন্ত্রণ করে রাখে অনিয়ন্ত্রিত বাজার। বাসায় কোনো গৃহকর্মী রাখা হয়নি। রাখা হয়নি কোনো ছুটা বুয়া। সংসারের সব কাজ আমরা দু'জন ভাগাভাগি করে করি। এতসব নিয়ন্ত্রণের পরও খেয়ে-পরে বেঁচে থাকাটা দায় হয়ে পড়ে। নিজেরা না হয় দায় নিয়ে বেঁচে থাকলাম, কিন্তু আমাদের একমাত্র সন্তান? সে দুধ খায়। হরলিক্স খেতে চায়। খেতে চায় নানা রকম ফল, চকোলেট, আইসক্রিম। আরও অনেক কিছু খেতে চায়। দিতে পারি না। দুধের দাম বেড়েছে। এক বোতল হরলিক্স ২৮০ টাকা। আধা লিটার আইসক্রিম এই সেদিনও ছিল ৭০ টাকা। এখন সেটার দাম ৯০ টাকা। ১০ টাকার নুডলস এখন ১৬ টাকা। এভাবে তালিকা দীর্ঘ করা যায়। কিন্তু লাভ কী? কোন জিনিসটার দাম বাড়েনি? আগুন ধরানোর ম্যাচবাক্স ছাড়া আর সবকিছুর দামে আগুন লেগেছে।
এ রকম অবস্থায় রমজান মাসে আমাদের কষ্ট-হতাশা আরও বেড়ে যায়। চাল, ডাল, তেল, আটা, চিনি_ নিত্যপ্রয়োজনীয় এসব পণ্যের দাম বছরজুড়ে বাড়ে। রমজান এলে বাড়ে অস্বাভাবিক রকম। অন্য সময় খেয়ে না খেয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করি। রমজানে সে চেষ্টা রীতিমতো যুদ্ধে পরিণত হয়। সারাদিন রোজা রেখে ইফতারে ভালোমন্দ খেতে ইচ্ছা করে। কাবাব, ফিরনি, হালিম, ক্ষীর, স্যুপ_ এসবের চিন্তা করি না। সামান্য চিড়া-মুড়ি, ছোলা-পেঁয়াজু, জিলাপি, শরবত_ এসব তো খেতে ইচ্ছা করে। খেতে হয়। চিনির দাম বাড়তি, তাই জিলাপির দামও আকাশছোঁয়া। ছোলা ৮৫ টাকা কেজি। ২৫ টাকার ইসবগুল এখন ৫৫ টাকা। আর পেঁয়াজ? ৩৪ টাকা কেজি।
সেহরিতে যদি মাঝে মধ্যে মাছ-মাংসের সংস্থান করি তাহলে সংসার খরচ আর ইফতার-সেহরির খরচ মেটাতে আমার বেতন-বোনাসে কুলাবে না। আমি ঈদ করব কীভাবে? আমার মেয়ে যে স্বপ্ন দেখছে সেটার কী হবে? তার তালিকা অনুযায়ী কেনাকাটা দূরে থাক, ঈদে গ্রামের বাড়ি যাওয়া দূরে থাক, সেমাই-চিনি কেনার জন্যও তো পয়সা থাকবে না। তাহলে? ভালো হতো যদি রোজা, ঈদ_ এসব না আসত। এখন আমাকে অনেক মিথ্যা বলতে হবে। মায়ের কাছে, মেয়ের কাছে। মাকে বলব_ মা, অসুস্থ হয়ে পড়েছি, ঈদে বাড়ি আসতে পারব না। মা দুশ্চিন্তা করবেন। তবু বলতে হবে। মেয়েকে বলব_ শরীর খারাপ মামণি, শপিংয়ে যেতে পারব না। কাল যাব। কালও একই কথা বলব। এভাবে প্রতিদিন মিথ্যা বলে তাকে ভুলিয়ে রাখতে হবে। অবশ্য আমার যদি সত্যি সত্যি ঈদের আগে আগে একটা অসুখ হয়ে যায় তাহলে মিথ্যা বলা থেকে বেঁচে যাব। প্রিয় পাঠক, আমার জন্য দোয়া করবেন যেন কোনো একটা অসুখে পড়ি!

মাইনুল এইচ সিরাজী : আনুষঙ্গিক বিভাগের শিক্ষক, চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট
mhs_bspi@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.