তথ্যপ্রযুক্তি-টেলিকম নিয়ে পাঁচ কথা by জাকারিয়া স্বপন

বাংলাদেশের মানুষ অধীর আগ্রহে থ্রি জির জন্য অপেক্ষা করছে। আমাদের দেশে দ্রুতগতির ইন্টারনেটের অবস্থা আমরা সবাই জানি। একটি বিশাল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে আছে এ দ্রুতগতির ইন্টারনেটের জন্য। আমরা তা করছি না। কথা হচ্ছে, প্রতিদিন কাজটি হচ্ছে না।


তাহলে এ বিশাল স্থাপনা নিয়ে বিটিআরসি করছে কী? বাংলাদেশের মানুষ থ্রি জি চায়। তাদের তা দিতে হবে এবং এখনই

গত ১৫ মার্চ বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ সংসদীয় কমিটিতে বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা ঘটেছে। ওই সভায় সংসদীয় কমিটি বর্তমান বিটিআরসির চেয়ারম্যানকে একহাত দেখে নিয়েছে। সমকালের রিপোর্ট অনুযায়ী মিটিংয়ের এক পর্যায়ে তা এতই চরমে পেঁৗছে যে, কমিটির সভাপতি হাসানুল হক ইনু মাইক বন্ধ করে দেন এবং বেশ কড়া ভাষায় বিটিআরসির সমালোচনা করেন। এক পর্যায়ে তিনি বলে ওঠেন, 'ইউ পিপল আর ব্লান্ডারিং দ্য গভর্নমেন্ট।' সেখানে এমন বেশ কয়েকটি বিষয় উঠে এসেছে যেগুলো নিয়ে একটু আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে।
এক. মোবাইল ফোনের লাইসেন্স নবায়ন নিয়ে জটিলতা : সংসদীয় কমিটি দাবি করেছে, গত দু'বছর কাজ করার পরও বিটিআরসি দেশের ৪টি মোবাইল ফোন কোম্পানির লাইসেন্স নবায়ন করতে পারেনি। এমনকি সবক'টি মোবাইল ফোন কোম্পানি তাদের টাকা চার মাস আগে পরিশোধ করে দিলেও এখন পর্যন্ত লাইসেন্স নবায়ন হয়নি! মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলো কি বিনা লাইসেন্সে বাংলাদেশে অপারেট করছে? পৃথিবীতে এমন নজির কি আরেকটি খুঁজে পাওয়া যাবে?
দুই. বিটিআরসি বনাম এনবিআর জটিলতা : লাইসেন্স নিয়ে জটিলতার মূল সমস্যা তৈরি হয়েছে যখন বিটিআরসি ভ্যাটসহ টাকা জমা দিতে বলেছে। একদিকে এনবিআর বলছে ভ্যাট আমাদের এখানে জমা দাও; অন্যদিকে বিটিআরসি বলছে, না, সব টাকা আমাদের নামে জমা দাও। দু'দিকের রশি টানাটানিতে মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলো চলে গেছে কোর্টে। ব্যস!
অবস্থা এমন খারাপ হবে কেন! লাইসেন্স ফি কি বিটিআরসি নতুন করে নিচ্ছে? সরকারের এই পকেট আর ওই পকেট_ যাবে তো সব সরকারি রাজস্ব খাতে। সেখানে কে বেশি টাকা তুলল সেই প্রতিযোগিতায় বিটিআরসিকে কেন যেতে হবে? এই টাকা তোলার পরিমাণ দিয়ে কি বিটিআরসির দক্ষতা বিচার করা হয়ে থাকে? দেশের সবচেয়ে বৃহৎ একটি খাত_ কোন টাকা কে তুলবে তা সরকার এতদিনেও কেন ঠিক করে দিতে পারে না! অর্থমন্ত্রী বিষয়টি কেন এতদিন নিষ্পত্তি করেননি?
সেই মিটিংয়ে টেলিকম সচিব সুনীল কান্তি বলেছেন, টাকা আদায় করার কাজ বিটিআরসির নয়, টাকা আদায় করবে এনবিআর। তাহলে তা মেনে নিতে সমস্যাটা কোথায়!
তিন. বিটিআরসি বনাম টেলিকম মন্ত্রণালয় জটিলতা : এটি এখন নোংরাভাবে সবার সামনে চলে এসেছে যে, বিটিআরসি আর টেলিকম মন্ত্রণালয় দা-কুমড়া সম্পর্কে পরিণত হয়েছে। বিটিআরসি আগে স্বাধীন ছিল। তাদের ধারাল দাঁত ভেঙে দিতে আইন পাস করানো হয়েছে এবং কান ধরে টেনে মন্ত্রণালয়ের অধীন বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে আইনগতভাবে বিটিআরসি টেলিকম মন্ত্রণালয়ের কথা শুনতে বাধ্য। কিন্তু টেলিকম সচিব ক্ষোভের সঙ্গে সেই মিটিংয়ে বলেছেন, বিটিআরসির আচরণ এতটাই ঔদ্ধত্যপূর্ণ যে, তারা মন্ত্রণালয়ের কোনো কথা আমলেই আনে না। বরং তারা উল্টো চিঠি পাঠিয়ে দেয়।
কোনো বিষয়ে ভিন্নমত থাকলে সে বিষয়ে চিঠি তো বিটিআরসি দিতেই পারে। এতে মন্ত্রণালয়ের এত ক্ষিপ্ত হওয়ার কী আছে? সরকারি অফিসে চিঠি চালাচালি তো নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। কিন্তু এখানে ক্ষমতার একটি দ্বন্দ্ব পরিষ্কার ফুটে উঠেছে। এটি যে নতুন তা নয়। পত্রপত্রিকায় বিভিন্ন সময়ে এটি এসেছে। এখানেও কি তাহলে বিএনপি-জামায়াত ঢুকে পড়েছে? না হলে সরকারের এ ফ্রেমওয়ার্ক এত নন-ফাংশনিং কেন? প্রতিদিন আমাদের কেন এ নাটক দেখতে হচ্ছে? এ সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতি নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে এবং কাজ করার চেষ্টাও করছে। তরুণ সমাজেরও অনেক আশা এ সরকারের ওপর। এ ক্ষেত্রে কারা সরকারকে নন-ফাংশনিং করছে?
চার. বিটিআরসি এবং রাজনীতি : সংসদীয় কমিটি এতটাই ক্ষিপ্ত হয়ে গিয়েছিল, এক পর্যায়ে হাসানুল হক ইনু বিটিআরসির চেয়ারম্যানকে বলেন, 'সরকারের ভাগ্য ভালো যে, বিরোধী দল টেলিযোগাযোগের এ বিষয়গুলো বোঝে না। সে কারণে সমালোচনার হাত থেকে বেঁচে গেছি।'
ওই কমিটিতে বিরোধীদলীয় সদস্য থাকার কথা। তিনি হয়তো মিটিংয়ে উপস্থিত ছিলেন না। বিষয় তা নয়। বিষয়টি হলো, টেলিকম সেক্টরটির ভেতরে এমন কাণ্ডকারখানা হচ্ছে যেগুলো বিরোধী দল পর্যন্ত হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। এ বিষয়ে কিছু তথ্য সমকালের পূর্ববর্তী বিভিন্ন রিপোর্টে এসেছে। বিস্তারিত বর্ণনায় না গিয়ে শুধু এটুকু বলা যায়, এখানে পুকুর চুরি হচ্ছে। তা ঠেকানোর ক্ষমতা আপাতত আমাদের কারও নেই। হয়তো সময়ে সেগুলো উদ্ঘাটিত হবে।
পাঁচ. থ্রি জি নিয়ে বিতর্ক : উপরের বিষয়গুলো ছাড়াও যে বিষয়টি নিয়ে আমরা আতঙ্কগ্রস্ত তা হলো, মোবাইল ফোনের থ্রি জি লাইসেন্স। আড়াই বছর ধরে বিটিআরসি এই থ্রি জির লাইসেন্সের নীতিমালা করেই যাচ্ছে। তা যেন আর শেষ হওয়ার নয়। এখন এমন একটি অবস্থা তৈরি হয়েছে যে, পুরো বিশ্বে তার পরের প্রযুক্তি 'ফোর জি' চলে এসেছে। মোবাইল ফোন প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ফোর জি ডিভাইস তৈরি করতে শুরু করেছে এবং এর সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
ভয়ঙ্কর ব্যাপারটি হলো, একটি মহল চাইছে দেশে একবারেই ফোর জি চলে আসুক। অর্থাৎ ফোর জি লাইসেন্স দিয়ে দেওয়া হোক আর থ্রি জিটা ধামাচাপা পরে যাক। এর অর্থ হলো, দেশ এক ধাক্কাতেই মাত্র আট হাজার কোটি টাকা হারাবে। দেশের এ বিশাল ক্ষতির জন্য কাকে দায়ী করা যাবে? বিটিআরসি? মন্ত্রণালয়? সরকার? জনগণ? হায় জনগণ!
কার স্বার্থ রক্ষার জন্য বাংলাদেশে এখনও থ্রি জি লাইসেন্স হচ্ছে না_ এ প্রশ্নের উত্তরটি কে দেবে? জনগণের তো এটি নিত্যদিনের প্রশ্ন। আপনি যে কোনো ফোরামে যান, দেখবেন সবাই জিজ্ঞেস করছে, দেশে থ্রি জি আসবে কবে? আটকে আছে কেন? এর জবাব যাদের দেওয়ার কথা তারা ব্যস্ত ভিন্ন কাজে_ নিজেদের আখের গোছাতে।
বাংলাদেশের মানুষ অধীর আগ্রহে থ্রি জির জন্য অপেক্ষা করছে। আমাদের দেশে দ্রুতগতির ইন্টারনেটের অবস্থা আমরা সবাই জানি। একটি বিশাল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে আছে এ দ্রুতগতির ইন্টারনেটের জন্য। আমরা তা করছি না। কথা হচ্ছে, প্রতিদিন কাজটি হচ্ছে না। তাহলে এ বিশাল স্থাপনা নিয়ে বিটিআরসি করছে কী? বাংলাদেশের মানুষ থ্রি জি চায়। তাদের তা দিতে হবে এবং এখনই। না হলে এর জন্য যতটা ক্ষতি হবে তার দায়ভার কাউকে না কাউকে নিতেই হবে_ তা হোক আজ, নয়তো কাল!


জাকারিয়া স্বপন :তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ
zs@priyo.com

No comments

Powered by Blogger.