জল থাকলেই না বিদ্যুৎ by শেখ রোকন

ভুটানের প্রধানমন্ত্রী জিগমে ওয়াই থিনলে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন নিয়ে তার দেশের উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনার ব্যাপারে এ সপ্তাহে এএফপির কাছে যে 'ব্যাপক সংশয়' প্রকাশ করেছেন, তা বেশ খানিকটা অপ্রত্যাশিত। জলবিদ্যুৎ উৎপাদন ও রফতানিতে বিশ্বসেরা আসন দখলপ্রত্যাশী ভুটানে তো বটেই; এ সংশয় সীমানার বাইরেও হতাশা জাগাতে পারে।


সে তালিকায় প্রথমেই থাকবে বিশ্বব্যাংক ও এডিবির মতো কিছু বহুজাতিক অর্থকরী প্রতিষ্ঠান যেগুলো দেশটির খরস্রোতা বিভিন্ন নদীতে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পে বিনিয়োগে উদ্যোগী ছিল। তার ভুটানের বৃহত্তম প্রতিবেশী ভারত। আসবে বাংলাদেশের নামও। ভুটান-বাংলাদেশ কূটনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে মনোযোগী নাগরিকের নিশ্চয়ই মনে আছে, এ বছরের জানুয়ারিতে মি. থিনলের ঢাকা সফরের বিশেষ তাৎপর্য কী ছিল। হিমালয়কন্যা বলে পরিচিত এ প্রতিবেশীর সঙ্গে আমাদের সদ্ভাবের অভাব না থাকলেও দেওয়া-নেওয়া সাধারণত সীমিত কিছু পণ্যের আমদানি-রফতানিতেই সীমাবদ্ধ। সেবারের সফরে তিনি বাংলাদেশকে জলবিদ্যুৎ খাতে প্রয়োজনীয় সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছিলেন। স্বাধীনতার পর থেকেই বিভিন্ন সময়ে আমরা অভিন্ন নদীগুলোর উজানে যৌথ প্রকল্পের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রস্তাব দিয়ে আসছি। নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে ইতিমধ্যে ভারত এমন একাধিক প্রকল্পও চালু করেছে। কিন্তু বোধগম্য নানা কারণে বাংলাদেশের প্রস্তাব আলোর মুখ দেখেনি। দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম প্রতিবেশীটি নিজের ভূখণ্ড দিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে ভুটান ও নেপালের ট্রানজিটের ব্যাপারে ইতিবাচক অবস্থান স্পষ্ট করার পরই কেবল হিমালয়ের খরস্রোতা প্রবাহগুলোতে উৎপাদিত জলবিদ্যুতে আমাদের প্রাপ্তি নিয়ে আশা জেগেছে। এখন খোদ ভুটানই যদি বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যাপারে সংশয় ব্যক্ত করে, আমাদের কী হবে? ভুটানের খাড়া ও সুউচ্চ পর্বতশ্রেণী এবং সেগুলোর ফাঁকে ফাঁকে প্রবাহিত ছোট-বড় নদী জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য আদর্শ স্থান। খুব বেশি কসরত করতে হয় না। একটি হিসাবে দেখা গেছে, ভুটানে উৎপাদিত বিদ্যুতের ৯৯.৯ ভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয় জলবিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে। ০.১ ভাগ আসে তেলচালিত জেনারেটর থেকে। যে পরিমাণ বিদ্যুৎ ছোট্ট দেশটিতে উৎপাদন সম্ভব, অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে তার সামান্যই প্রয়োজন। এ কারণে ভুটান গত এক দশকে ব্যাপক মনোযোগ দিয়েছে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও রফতানির দিকে। এক্ষেত্রে ভারতের কাছ থেকে সর্বোচ্চ উৎসাহ ও সহযোগিতা পেয়েছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সামাল দিতে দৈত্যকায় দেশটির যে বিপুল বিদ্যুৎ প্রয়োজন তার বড় ও স্থিতিশীল উৎস হিসেবে ভুটানের জুড়ি মেলা ভার। দুই দেশ পরিকল্পনা করেছিল যে, ২০২০ সালের মধ্যে যৌথ প্রকল্পগুলোতে বিদ্যুতের উৎপাদন লক্ষ মেগাওয়াট পার করা হবে। সেই বিদ্যুৎ কেবল ভারতে নয়, বাংলাদেশে রফতানির ব্যাপারেও ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছিল। ভুটানের নীতিনির্ধারকরা আশা করছিলেন, কেবল বিদ্যুৎ বেচেই ২০১৮ সালের মধ্যে তারা অর্থনৈতিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারবে।
ভুটানের জনগণের জীবনযাত্রার মান নির্ধারণে বিশ্বব্যাপী প্রচলিত জিডিপি হিসাব করার বদলে সত্তর দশকের গোড়ায় ভুটানের সাবেক রাজা জিগমে সিংহে ওয়াংচুক যে 'জিএনএইচ' (গ্রোস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস) প্রবর্তন করেছিলেন তা সবাই জানেন। তাতে করে নাকি ভুটানের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার সাধ্য বড় বড় অর্থনৈতিক শক্তিগুলোরও ছিল না। ২০১৮ সালের মধ্যে অর্থনৈতিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারলে যে ছোট দেশটি জিডিপিতেও অনেককে টেক্কা দেওয়ার ক্ষমতা অর্জন করত, বলাই বাহুল্য। সোনার কাঠি সে জলবিদ্যুতের ব্যাপারে কেন এমন সংশয়? জিগমে ওয়াই থিনলে এএফপিকে জানিয়েছেন, এর কারণ জলবায়ু পরিবর্তন। বৈশ্বিক এ দুর্যোগের কারণে হিমালয় পবর্তশ্রেণীর হিমবাহগুলো অস্বাভাবিক আচরণ করছে। শীতের সময় যেমন স্বাভাবিকের চেয়ে কম গলছে, আবার গ্রীষ্মকালে বেশি গলছে। ফলে ছোট-বড় শত শত প্রবাহের চরিত্র আগের মতো স্থিতিশীল থাকছে না। জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য প্রয়োজন মোটামুটি ধারাবাহিক প্রবাহ। এখন জলপ্রবাহই যেখানে অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে, সেখানে উৎপাদিত বিদ্যুৎ রফতানি করে সমৃদ্ধি অর্জনের পরিকল্পনায় কতটা ভরসা করা যায়? আর ভারত ও বাংলাদেশের বিদ্যুৎ প্রাপ্তি? নৈবচ নৈবচ।
skrokon@gmail.com
 

No comments

Powered by Blogger.