শ্রদ্ধাঞ্জলি-বিনয় বাঁশীর ঢো by নাসির উদ্দিন হায়দার

পরিবারের ঐতিহ্যে শৈশবেই জাল আর নৌকার সঙ্গে সখ্য হয় বিনয় বাঁশী জলদাসের। কিন্তু মন যাঁর আনচান করে ঢোলের বোলে, গান ছাড়া কি তাঁর প্রাণ বাঁচে? তাই তো একদিন বিনয় পা রাখেন ওস্তাদের বাড়িতে, তালিম নেন যন্ত্রসংগীতে।
কথায় আছে—রতনে রতন চেনে।


সেই যে দিনগুলো, ঢোল বাজানোর দিনগুলোতে রমেশ শীলের জহুরি চোখে ধরা পড়ে যান বিনয়। বঙ্গের শ্রেষ্ঠ কবিয়াল বাদক হিসেবে সঙ্গে নেন বিনয় বাঁশীকে। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। রমেশ শীলের সহশিল্পী হিসেবে ৩৫ বছর ধরে বাজিয়েছেন বিনয়, বাংলার ঢোল নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন উপমহাদেশের পথে-প্রান্তরে। সানাই, বেহালা, দোতারা, করতাল, মৃদঙ্গ বাজানোতেও পারদর্শিতা ছিল তাঁর।
রমেশ শীল দুই বাংলার শ্রেষ্ঠ কবিয়াল, বিনয় বাঁশী উপমহাদেশের বিখ্যাত ঢোলবাদক। এর বাইরে তাঁদের আরেকটি পরিচয়—রমেশ-বিনয় ছিলেন সংগীতের মানিকজোড়। ২০০২ সালে সরকার দুজনকেই একুশে পদক দেয়। তবে দুই সংগীতজ্ঞের সমাধিস্থলে সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স নির্মাণের কথা থাকলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। বিনয় বাঁশীর বাড়িটা ছন্দারিয়া খালে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে পরিবারের সদস্যরা প্রশাসনের কাছে ধরনা দিলেও কোনো কাজ হয়নি।
ঢোলের জাদুকর বিনয় বাঁশী জলদাস ঘুমিয়ে আছেন চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর ছন্দারিয়া জেলেপল্লিতে। তাঁর জন্ম ১৯১১ সালে। বাবার নাম উপেন্দ্র লাল জলদাস ও মা সরবালা জলদাস। বেশি লেখাপড়ার সুযোগ পাননি জেলে পরিবারের সন্তান বিনয়, রামসুন্দর বসাকের বাল্যশিক্ষাই সম্বল ছিল কেবল। প্রায় ৮০ বছরের জীবনের সিংহভাগই কেটেছে তাঁর ঢোলের প্রেমে। ২০০২ সালের ৫ এপ্রিল নিজের বাড়িতে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বিনয়।
সম্প্রতি আমরা গিয়েছিলাম ছন্দারিয়ায়। বাড়ি তো নয়, যেন পাখির বাসা। কুঁড়েঘরের দাওয়ায় আমাদের যত্ন করে বসতে দিলেন বিনয় বাঁশীর স্ত্রী অশীতিপর সুরবালা জলদাস ও ছেলে বাবুল জলদাস। অন্তঃপুরে দৌড়ে গিয়ে একটি পদক বের করে আনেন সুরবালা। বলেন, ‘এই একুশে পদক আমার স্বামীর জীবনের শ্রেষ্ঠ পাওয়া। মানুষটার কোনো লোভ-লালসা ছিল না। একদিন গানবাজনা শেষে বাড়ি ফিরলে তাঁকে সংসারের অভাবের কথা বলি। মানুষটা আমার কাঁধে হাত দিয়ে বলেছিলেন, “টাকা-পয়সা দিয়ে আমি তোমাকে খুশি করতে পারব না। তুমি কি আমার কাছ থেকে প্রেম চাও না বিত্ত?” আমি বলেছিলাম, প্রেম চাই। জীবনে কখনো প্রেমের অভাব হয়নি আমার।’
বিনয় বাঁশীর ছোট ভাই রবীন্দ্রলাল জলদাস বলেন, ‘আমার ভাই ঢোল বাজিয়ে ভুবন জয় করেছেন। আজ ভাইয়ের কোনো স্মৃতি নেই গ্রামে। তাঁর সেই ঢোল এখন বাজে না। সরকার একুশে পদক দিয়েই দায়িত্ব সেরেছে।’
বিনয় বাঁশীর দুই ছেলে সুখলাল দাস ও বাবুল দাস এবং নাতি কৃষ্ণমোহন জলদাসের সমন্বয়ে একটি কীর্তনিয়া দল আছে, যেটি এখন দেশ-বিদেশের অনুষ্ঠানে ঢোল বাজায়। বিনয় বাঁশীর দল বলে তাঁদের সবাই সমীহ করে।—জানান কৃষ্ণমোহন।
২০০০ সালে লন্ডনে বাংলাদেশ উৎসবে ঢোল বাজানোর জন্য সরকার আমন্ত্রণ করে বিনয় বাঁশীকে। কিন্তু অসুস্থতার কারণে যেতে পারেননি। তবে ছেলে বাবুল জলদাস বাবার হয়ে লন্ডন মাতিয়ে এসেছিলেন। বিনয় বাঁশীর যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন বাবুল। চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে তাঁর দলের ঢোলবাদনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় অনুষ্ঠান। চট্টগ্রামের ডিসি হিলে বাবুলের ঢোল ছাড়া তো অনুষ্ঠানই হয় না। বাবুল জলদাসের খ্যাতি বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে। ইতিমধ্যে জার্মানি, আমেরিকা ও ভারতে ঢোল বাজিয়ে সুনাম কুড়িয়েছেন তিনি।
বিনয় বাঁশীর পরিবারে কিছু দুঃখও আছে। বাবুল জলদাস বলেন, ‘২০০২ সাল থেকে আমাদের বাড়িটা ছন্দারিয়া খালের ভাঙনে পড়েছে; এখন বিলীনপ্রায়। সাবেক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রবীন্দ্র শ্রী বড়ুয়া সরেজমিন পরিদর্শন করে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। শিগগিরই ভাঙন রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন এবং কিছু উদ্যোগও নিয়েছিলেন। কিন্তু এরপর আর কেউ খোঁজ নেয়নি। গত বর্ষায় বাড়ির অর্ধেকাংশ খালে বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙন রোধে ব্যবস্থা নেওয়া না হলে সামনের বর্ষায় তা পুরোপুরি বিলীন হয়ে যেতে পারে।’
উল্লেখ্য, ২০০২ সালে তৎকালীন বিএনপি সরকারের দুই মন্ত্রী রমেশ শীল ও বিনয় বাঁশীর সমাধিস্থলে সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স নির্মাণের ঘোষণা দিলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। অবশ্য বোয়ালখালীর আরেক কিংবদন্তি শিল্পী আঞ্চলিক গানের সম্রাজ্ঞী শেফালী ঘোষের সমাধিস্থলে পারিবারিকভাবে একটি ভাস্কর্য ও স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়েছে। শিল্পীর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ২০০৭ সালের ১৯ জানুয়ারি স্মৃতিফলকের উদ্বোধন করা হয়।
বোয়ালখালীর তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রবীন্দ্র শ্রী বড়ুয়া (বর্তমানে চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের সচিব) বলেন, ‘উপজেলার তিন কিংবদন্তি শিল্পী রমেশ শীল, বিনয় বাঁশী ও শেফালী ঘোষের স্মৃতি রক্ষায় বড় একটি মেলা আয়োজনের পরিকল্পনা করেছিলাম। সমাধিস্থলে সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স করার উদ্যোগ ছিল। কিন্তু জায়গাসহ নানা জটিলতায় আমার সময়ে কাজ শেষ করা সম্ভব হয়নি।’
বিনয় বাঁশী সারা জীবন ভালোবেসে গেছেন দেশকে, দেশের মানুষকে। ঢোলের প্রতি ভালোবাসা ছিল আমৃত্যু। জীবনে অনেক জ্ঞানী-গুণীর ভালোবাসা তিনি পেয়েছেন। কিন্তু বিত্তের দিকে ফিরে তাকাননি ভুলেও। বাজনায় মুগ্ধ হয়ে উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নটরাজ উদয় শংকর তাঁর নৃত্যদল ‘মম বাণী’তে যোগ দেওয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন বিনয় বাঁশীকে। কিন্তু নিজের জন্মস্থান ছন্দারিয়া গ্রাম ছেড়ে কোথাও যেতে চাননি। আজ তাঁর নবম মৃত্যুবার্ষিকী। এ উপলক্ষে বিনয় বাঁশীর বাড়িতে আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও কবিগানের আসর বসবে।

No comments

Powered by Blogger.