কক্সবাজার সাফারি পার্কঃ প্রাণীর প্রাচুর্য আছে, নেই অর্থ, দক্ষতা by খসরু চৌধুরী

প্রাণবৈচিত্র্য, নৈসর্গিক সৌন্দর্য ও আয়তন মিলিয়ে ‘বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক, কক্সবাজার’ হয়ে উঠতে পারত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম আকর্ষণীয় প্রকৃতি দর্শনকেন্দ্র। কিন্তু উদ্দেশ্যহীন সম্প্রসারণ, অপরিকল্পিত অবকাঠামো নির্মাণ, অদক্ষ জনবল এবং সর্বশেষ অর্থাভাব আর অবহেলায় পার্কটির সেই সম্ভাবনা তিরোহিত হচ্ছে। যদিও এখানে আছে বিশ্বের অন্যতম বেশ কটি বিপন্ন প্রাণী।
১৯৭৮ সালে বন বিভাগ বন অধিদপ্তরের উদ্যোগে কক্সবাজার বন বিভাগের ফাশিয়াখালী রেঞ্জের ডুলাহাজারা বিটে হরিণ (চিত্রা, মায়া, শম্বর) ও গয়ালের বংশ বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রজননকেন্দ্র স্থাপন করা হয়। ১৯৯৮-৯৯ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের উদ্যোগে এবং বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় নয় কোটি ৯৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা ব্যয়ে নয় হাজার হেক্টর (২২ হাজার একর) বনভূমি অধিগ্রহণ করে ডুলাহাজারা ও হারগাজা বিটে সাফারি পার্কের গোড়াপত্তন করা হয়। একটি প্রজননকেন্দ্রকে অপ্রয়োজনীয় দ্রুততায় সাফারি পার্ক করায় এর আদর্শ-উদ্দেশ্য ত্রুটিপূর্ণ থেকে যায়। ফলে পার্কটি না সাফারি, না প্রজননকেন্দ্র হিসেবে চলতে শুরু করে।
অসংগতির প্রদর্শনী!: সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পাখির খাঁচার পাশে বানরের খাঁচা, বিড়ালের খাঁচা করা হয়েছে। এতে পৃথক স্বভাবের প্রাণীদের জন্য মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা তৈরি হচ্ছে। কোনো কোনো খাঁচা বিশাল আবার কোনোটি প্রয়োজনের তুলনায় বেশ ছোট। বাঘ, সিংহ, জলহস্তী, হাতি, ওয়াইল্ডবিস্ট, ভালুক ও বাঁশভালুকের জন্য আছে সুপরিসর বেষ্টনী। আবার জলাসংলগ্ন পাখির খাঁচায় রয়েছে মদনটাক, গগনবেড়, পশমিগলা মানিকজোড়, সেনজঙ্ঘা, কালো মানিকজোড়ের মতো বিশালকায় পাখি। কিন্তু সে খাঁচার পরিসর এত ছোট যে সেখানে সঙ্গী পাখি কোরচে বক, নিশি বক, কাঁচিচোরাদের পাখা ঝাপটানোরই স্থান নেই, আর বড়রা তো পাখা মেলতেই পারবে না। অদূর ভবিষ্যতে এরা আর্থ্রাইটিসের (বাত) শিকার হবে। অন্য জায়গায় প্রয়োজনের চেয়ে অনেক ছোট খাঁচায় রাখা হয়েছে এক জোড়া মদনটাক। অন্যতম আকর্ষণ ফুলেশ্বরী চিতাটির আবাসনও অত্যন্ত আঁটসাঁট, যা সাফারি পার্কের উপযোগী নয়।
বাঘ-সিংহের অবস্থাও অনেকটা একই রকম। এদের জন্য রয়েছে যথাক্রমে ৬০ ও ৪০ হেক্টর জমি নিয়ে বিশাল বিশাল বেষ্টনী। বেষ্টনীর কোথাও ফাটল, কোথাও দেয়ালের তলার মাটি বৃষ্টিতে ধসে যাওয়ায় তিন বছর ধরে বাঘ-সিংহ বিস্তৃত বেষ্টনীতে ছাড়া হয় না। খাঁচায় আবদ্ধ থাকে। বাঘের বেষ্টনীটি কাজে লাগাচ্ছে অত্যন্ত দুর্লভ, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আকারের একটি গরু—গাউর। মহামূল্যবান এই প্রাণীটি নিজেই একটি বেষ্টনীর দাবিদার।
উদ্দেশ্যহীন সংগ্রহ: সাফারি পার্কটি যে উদ্দেশ্যহীনভাবে গড়ে উঠেছে, সেটা বোঝা যায় এর পশু-পাখি সংগ্রহের নমুনায়ও। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের প্রয়োজন এ দেশের বিপন্ন প্রাণী রক্ষা ও বিলুপ্তপ্রায় প্রাণী উদ্ধার। সাফারি পার্ক প্রাণী দিয়ে দ্রুত ভরাতে গিয়ে ঢাকা চিড়িয়াখানার এমন সব উদ্বৃত্ত প্রাণী আনা হয়েছে, যাদের প্রতিবেশমূল্য সামান্য অথবা ক্ষতিকারক দর্শনমূল্যও সামান্য।
এখানে পূর্ব আফ্রিকার প্রাণী জলহস্তী, ওয়াইল্ডবিস্ট বহাল তবিয়তে আছে, বাচ্চা দিচ্ছে। অবশ্যই সুখবর। কিন্তু দেশের প্রতিবেশের কী উপকারে আসবে এরা? এদের বেষ্টনীতে দেশ থেকে বিলুপ্ত এশীয় তিন প্রজাতির গন্ডার, বারাশিঙা হরিণ, সোনালি বিড়াল, বুনো মোষ প্রভৃতি প্রাণী আশপাশের দেশ থেকে সংগ্রহ করে প্রজননের ব্যবস্থা করলে আমাদের প্রতিবেশ যেমন উপকৃত হতো, দর্শকেরাও তেমনই আনন্দ পেত। যেমন—ঢাকা চিড়িয়াখানার বৃদ্ধ চিতাবাঘটি মারা গেলেই সম্ভবত দেশ থেকে চিতাবাঘের পাট চুকে যাবে। অথচ একসময় সুন্দরবন ছাড়া দেশের সব কটি এমনকি গ্রামীণ বনেও চিতাবাঘের স্থান ছিল।
সাফারি পার্কের নিঃসঙ্গ প্রাণীর জোড় মেলানো পার্ক কর্তৃপক্ষের নৈতিক দায়িত্ব। পার্ক কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে উদাস অথবা ব্যর্থ। এখানে রয়েছে নিঃসঙ্গ মেয়ে ফুলেশ্বরী চিতা, পুরুষ গাউর, দুটো স্ত্রী বাঘ, দুটো পুরুষ উল্লুক, একটি পুরুষ আসামি বানর, একটি লজ্জাবতী বানর, একটি লালচে হনুমান, একটি বৃদ্ধ লাঙ্গুল হনুমান, একটি মেঘডম্বুর, একটি গোলবাহার সাপ। গভীর রাতে বাঘের আসঙ্গলিপ্সার ডাক আমাদের অপরাধী করে তোলে।
রাস্তা ধরে সাফারি সফর: সাফারি পার্কের অন্যতম উপভোগ্য হচ্ছে এর ১১ কিলোমিটার দীর্ঘ পাকা রাস্তা। এর দুই কিলোমিটার আবার গেছে বাঘের বেষ্টনীর ভেতর দিয়ে। এ পথে হাঁটা, সাইকেল চালানো, কম গতিতে গাড়ি চালানো সব সময়ই আনন্দদায়ক। পুরস্কার হিসেবে চকিত চিত্রা, মায়া, শম্বর হরিণ অথবা গয়ালের দর্শন পাওয়া স্বাভাবিক ঘটনা। রাতে শিয়াল, বাগডাশ, মেছো বিড়াল চোখে পড়তে পারে।
১ ডিসেম্বর সন্ধ্যার সময় গাড়িতে চেপে পাকা রাস্তা ধরে পুরো পথটা ঘুরতে বের হলাম। ওয়াইল্ডবিস্টের বেষ্টনী পার হতেই পথের দুই পাশ ঘিরে ধরল ঘন জঙ্গল। কিছুটা পথ পার হয়ে হাতির বেষ্টনীর ৩ নম্বর প্রবেশপথের পাশ দিয়ে গা-ছমছমে পথ ধরে এগিয়ে চললাম; পথে অনুপ্রবেশকারী হাতির দলের সামনে না পড়ি। জঙ্গলের উঁচু-নিচু পথটা পার হয়ে ফাঁকায় এসে বেশ বড় পরিত্যক্ত একটি পাখির খাঁচা দেখে গাড়ি থেকে নামলাম। খাঁচাটি কেন পরিত্যক্ত জিজ্ঞেস করে উত্তর শুনে যেন চড় খেলাম গালে। ৩৪ লাখ টাকা ব্যয় করে খাঁচাটি নির্মাণ করা হয়েছে, কখনো ব্যবহূত হয়নি। পার্কের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোজাম্মেল হক শাহ (বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ) জানালেন, পাখির খাঁচাটি ত্রুটিপূর্ণভাবে নির্মিত হওয়ায় কর্তৃপক্ষ খাঁচাটি বুঝে নেয়নি। ঠিকাদারের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। তবে জানা গেল, ঠিকাদারের অর্থও পরিশোধ করে দেওয়া হয়েছে।
পার্কের ভেতরে ৯০০ ফুট লম্বা কাঠের ওয়াকওয়েটি পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে; নতুন রেস্টহাউসটিও ব্যবহারের অযোগ্য। নেচার ইন্টারপ্রিটেশন ঘরটির অবস্থা সুবিধার নয়। ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামে রক্ষিত প্রাণিদেহগুলো অত্যন্ত খারাপ অবস্থায় রয়েছে। চমৎকার জায়গায় বসানো পার্কের রাস্তার ধারে বিশ্রামাগারগুলো ভাঙাচোরা। এসব বিশ্রামাগারের একসময় ভাড়া ছিল সাধারণ ঘর ৪০০ টাকা, এসি ঘর এক হাজার টাকা। বিভাগীয় বন কর্মকর্তা জানালেন, সর্বসাধারণের জন্য ভাড়া দেওয়া হয় না। অথচ সাফারি পার্ক ভালোভাবে দেখতে হলে এক দিন রাতযাপন আবশ্যক।
অর্থ বরাদ্দ: প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ে ২০০৩-০৪ অর্থবছরে চারদলীয় সরকারের আমলে বরাদ্দ হয়েছিল আট কোটি ৫৭ লাখ ৪০ হাজার টাকা। পার্কের সাইনবোর্ড ও কাগজপত্র বদলে নাম রাখা হয়েছিল ডুলাহাজারা সাফারি পার্ক। তৃতীয় পর্যায়ে বরাদ্দ হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৬-০৭ অর্থবছরে। টাকার পরিমাণ ছিল ১৩ কোটি ৭৭ লাখ। এ অর্থ শেষ হবে ২০১১ সালের জুন মাসে। মন্ত্রণালয়ের পরামর্শে এ বছর ২৪ কোটি টাকার আবেদন করা হবে।
জনবলের অবস্থা: পার্কের প্রকল্পে কর্মরত আছেন মোট ৭৪ জন। তাঁদের মধ্যে ছয়জন আসেন না, স্থায়ী হয়েছেন ৪৫ জন, অস্থায়ী ২৩ জন—যাঁদের অধিকাংশই ওয়াইল্ডলাইফ স্কাউট, ক্লিনার ও প্রাণীর তদারককারী। পার্কের কর্মচারীরা দীর্ঘদিন কাজ করে একধরনের প্রশিক্ষণহীন পটুত্ব অর্জন করেছেন। তবে তাঁরা ভীষণ হতাশ। রাজস্ব খাতে যাঁরা যেতে পারেননি, তাঁদের হতাশাই বেশি। কোনো ঝুঁকিভাতা নেই। আশ্চর্যের বিষয়, একবিংশ শতাব্দীর একটি পার্কে কোনো ওয়াইল্ডলাইফ বায়োলজিস্ট নেই। পার্ক কর্তৃপক্ষ জানেই না, পার্কের গয়াল, শম্বর প্রভৃতি প্রাণী কেন প্রজননে আগ্রহী নয়।
আরও বিস্ময়কর ও মর্মান্তিক হলো, পার্কে কোনো সাপ্তাহিক ছুটি নেই। এতে কর্মীরা মানসিক-শারীরিকভাবে ক্লান্ত ও উদাস হয়ে পড়ছেন। এ অবস্থা আধুনিক ব্যবস্থাপনায় অকল্পনীয়।
বিপন্ন প্রাণী: পার্কে রয়েছে আন্তর্জাতিকভাবে বিপন্ন বিন্টুরাং, উল্লুক, লাজুক বানর, গাউর, ক্লাউডেড লেপার্ড, চিতা বিড়াল, রেটিকুলেটেড পাইথন, উলি উড স্টর্কের মতো মহামূল্যবান প্রাণী। পৃথিবীর যেকোনো প্রাণী সংগ্রহশালায় এরা হতে পারত দারুণ আকর্ষণীয় ও বৈজ্ঞানিক জিজ্ঞাসার খোরাক। অথচ নিতান্ত অবহেলায় এরা জীবন কাটাচ্ছে এখানে। পার্কের একটি কুকুরজাতীয় প্রাণী যেটা ভুলভাবে খ্যাঁকশিয়াল নামে লেখা, সেটা চিনতে পারিনি। দাঁতের গড়ন দেখে মনে হয়েছে, ম্যালানিনগ্রস্ত বুনো কুকুর। কিন্তু দাঁড়কাক-কালো প্রাণীটির থাবায় সাদা ছোপ দেখে ভিন্ন প্রজাতির মনে হয়। এটির পরিচয় নির্ধারণ প্রয়োজন।
আন্তর্জাতিক মানের একটি আধুনিক পার্ক হয়ে ওঠার অনেক সম্ভাবনাই আছে বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কের। কিন্তু অব্যবস্থাপনা, দক্ষতার সংকট, তীব্র অর্থাভাব আর উদ্দেশ্যহীনতার কারণে একজন দর্শকের মনে হতে পারে ‘এখানে কিছুই নেই।’ তবে বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোজাম্মেল হক শাহ মনে করেন, তীব্র অর্থাভাব দূর হলেই অনেক কিছু সামাল দেওয়া যাবে।
===================================
জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের গুপ্ত জীবন  ছাব্বিশটি মৃতদেহ ও একটি গ্রেপ্তার  ৩৯ বছর পরও আমরা স্বাধীনতাটাকে খুঁজছি  সাইবারযুদ্ধের দামামা  সরলতার খোঁজে  সেই আমি এই আমি  আমেরিকান অর্থনীতি ডলারের চ্যালেঞ্জ  বাংলাদেশ-ভারত যৌথ ইশতেহার- আশানুরূপ সুফল নেই এক বছরেও  ন্যায়ভিত্তিক সমাজ ও রাজনীতি  মাস্টারদা সূর্যসেন ও যুব বিদ্রোহ সাতাত্তর  রসভা নির্বাচন ২০১১: একটি পর্যালোচনা  ড. ইউনূস অর্থ আত্মসাৎ করেননি  প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির ৩৯ বছর  স্বাধীনতাযুদ্ধের 'বিস্মৃত' কূটনৈতিক মুক্তিযোদ্ধারা  আতঙ্কে শেয়ারবাজার বন্ধঃ বিক্ষোভ  আতঙ্কের রাজত্ব কায়েম হয়েছে  মানবকল্যাণ আমাদের মন্ত্র  ট্রানজিট নিয়ে সবে গবেষণা শুরু  ভারতের একতরফা সেচ প্রকল্পঃ বাংলাদেশের আপত্তিতে বিশ্বব্যাংকের সাড়া  আমলাদের যাচ্ছেতাই বিদেশ সফর  সরকারের ব্যর্থতায় হতাশাঃ বিরোধী দলের ব্যর্থতায় বিকল্পের অনুপস্থিতি  ক্ষমতা ও গণতন্ত্র  পানি সংকট পানি বাণিজ্য  ২০১০ সালের অর্থনীতি কেমন গেল  গণতান্ত্রিক বিকাশের পথে বাধা অনেক  কপাটে তালা দিয়ে কেন এই মৃতু্যর আয়োজন  বিজয়ের অর্থনীতি ও সম্ভাবনা  মুক্তিযুদ্ধের বিজয়লক্ষ্মীর মুখোমুখি  একেই কি বলে আমলাতন্ত্র?  আত্মসমর্পণের সেই বিকেল  আমরা তাঁদের ভুলতে পারি না  সংবিধানের অনেক বক্তব্য পারস্পরিক সংঘাতমূলক  পরাশক্তির বিরুদ্ধে এক ‘ভবঘুরের’ স্পর্ধা  আবু সাঈদ চৌধুরীর ভাষণ দেওয়া হলো না  শুভ নববর্ষ ২০১১- দিনে দিনে বর্ষ হলো গত  এরশাদের বিচারে দুই দলেরই আগ্রহ কম  কিশোরদের সাদামাটা ফল  জিপিএ-৫ পেয়েছে আট হাজার ৫২ জন  এরশাদের বিচার হওয়া উচিত  ছোটদের বড় সাফল্য


দৈনিক প্রথম আলো এর সৌজন্যে
লেখকঃ খসরু চৌধুরী

এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.