আলোচনা- 'ওয়াংগালাঃ গারোদের জাতীয় উৎসব' by নেহাল আদেল

য়াংগালা গারো আবর্তের জাতীয় উৎসব। বাংলাদেশের উত্তর প্রান্তে গারো পাহাড়ের পাদদেশে মেঘালয়ের মেঘপুঞ্জের পাশাপাশি গারো আবর্ত। মঙ্গোলীয় জাতিগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত গারো বা মান্দি উপজাতি। ওদের ভাষায় মান্দি অর্থ মানুষ। সুদূর উত্তর মেরুর কাছে এস্কিমোদের ভাষায় মান্দি শব্দের অর্থও মানুষ। আর আর্য ভাষায় মানব অর্থ মানুষ, সুইডিশ ভাষায় মানিশ। মানবজাতির একাত্মতা অনেকটা প্রকাশ করে মানব প্রজাতির বিকাশ ও তার ঐতিহাসিক বিবর্তনে।
গারো আবর্তের ওয়াংগালা উৎসবে মুখরিত মানবগোষ্ঠীর মধ্যে আমরা প্রতিফলন দেখি এক শাশ্বত সংস্কৃতির, যা উপনিবেশবাদের বিস্তার ও খ্রিস্ট ধর্মান্তর গ্রাস করতে পারেনি। বাংলাদেশের সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী প্রমোদ মানকিন একজন গারো। প্রমোদ নামটি বাংলা, মানকিন তাঁর গারো নাম। বিরিশিরিতে উপজাতীয় একাডেমীটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সাবেক রাষ্ট্রপতি মরহুম জিয়াউর রহমান। বিভা সাগমা ছিলেন এ একাডেমীর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক। আমি শুনেছি, বিভাদি কয়েক বছর আগে মহাপ্রয়াণ করেছেন। তিনি প্রথম উচ্চ শিক্ষিত শুধু গারো নন, বাংলাদেশি অগ্রগণ্য নারীদের অন্যতম একজন। মাত্র কয়েক বছর আগেও বিভাদির সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল গারো ভাষা বিকাশের ব্যাপারে।
মেঘালয়ে লাতিন বর্ণমালায় গারো ভাষা লেখা হয় এবং শিক্ষাও দেওয়া হয়। কেন বাংলা বর্ণমালায় গারো ভাষা লেখা যাবে না কিংবা গারোদের একটি স্বকীয় বর্ণমালাও কি তৈরি করা যায় না? পার্বত্য চট্টগ্রামে মুরং-বোমদের স্বকীয় বর্ণমালা তৈরি করা হয়েছে। ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর অধিকার আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত, এমনকি জাতিসংঘ সনদেও। আমরা একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করি। কিন্তু আমরা কী করেছি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর জন্য শুধু আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসে কিছু সভা-সেমিনার ছাড়া? বাংলাদেশে প্রায় তিন লাখ গারো রয়েছে। তাদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ঢাকায়। বিউটি পার্লারে বা কূটনীতিকপাড়ায় পরিচারিকা হিসেবে তাদের উপস্থিতি। বিভাদির মতো পেশাগতভাবে তারা অনেকেই এগোতে পারছে না। প্রতিযোগিতা প্রবল।
গারোরা বৃহত্তর ময়মনসিংহ ও বৃহত্তর সিলেটের উত্তরাঞ্চলে হালুয়াঘাট, নালিতাবাড়ী থেকে সুনামগঞ্জ পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বাস করে। মধুপুর ও ভাওয়ালের গভীর অরণ্যেও তাদের বাস ছিল। এখন আর গভীর অরণ্য নেই। গারোরা সাধারণ জীবনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছে। তবে শ্রুতি রয়েছে, সাপ আর বাঘ ছিল ওদের বন্ধু। আক্রান্ত না হলে সাপ আর বাঘ মানুষকে আক্রমণ করে না বরং রক্ষা করে। এই কয়েক দিন আগে বাঘ রক্ষার জন্য রুশ প্রধানমন্ত্রী ভ্লাদিমির পুতিন ১৩টি দেশের একটি শীর্ষ সম্মেলন আহ্বান করেছিলেন। আমাদের প্রধানমন্ত্রীও সে শীর্ষ সম্মেলনে যোগদান করেন।
রফিক আজাদ দীর্ঘদিন বিরিশিরির উপজাতীয় একাডেমীর পরিচালক ছিলেন। খাদ্যমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক গারো অধ্যুষিত মধুপুর এলাকার সংসদ সদস্য। মান্যবর মন্ত্রীর কাছে গারোদের প্রত্যাশা অনেক। কবি রফিক আজাদ বিরিশিরিতে বেশ কিছু কাজ করেছিলেন শুনেছিলাম। গারোদের অনেকেই যেমন খ্রিস্ট ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছে, তেমনি অনেকে ইসলাম ধর্মেও ধর্মান্তরিত হয়েছে। এটা বড় প্রশ্ন নয়। তবুও মাঝেমধ্যে সংঘাত আসে, আসে দ্বন্দ্ব। যেকোনো জাতিগোষ্ঠীর যাত্রাপথে এটা স্বাভাবিক। মধুপুরে ইকো পার্ক নিয়ে এমনই একটি সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল। গারো তরুণরা প্রাণ দিয়েছে। একটি ঘনবসতিপূর্ণ দরিদ্র দেশের গরিব মানুষের অর্থে বিদেশিদের বিনোদনের জন্য কি ইকো পার্ক বা থিম পার্কের প্রয়োজন আছে? না, আমি গারো ও বাঙালিদের মধ্যে পার্থক্য দেখি না। কেবল বিদেশি দাতা এসে তার মনোরঞ্জনের জন্য নির্দেশ দিলেই কি তা পালন করতে হবে? এ ভিক্ষাবৃত্তির প্রবণতা ত্যাগ করতে হবে। দেশ ভিক্ষায় চলে না। কোনো বিরাট প্রতিনিধিদল নিয়ে গেলেই কেউ ভিক্ষা দেয় না। একটি স্বনির্ভর বাংলাদেশ তৈরি করতে হলে সবাইকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে হবে। আমরা জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র ভেদাভেদ ভুলে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে এ দেশ স্বাধীন করেছি। কাজেই এখানে সবার অধিকার সমান। আমরা সবাই এ দেশের সন্তান। সবার উন্নয়ন-অগ্রগতি সমভাবে হবে_এটিই স্বাভাবিক ও সংগত প্রত্যাশা।
গারো মেয়ে মৌরশীকে আমি মাঝেমধ্যেই দেখি বসুন্ধরায়। ওর অনেক বাঙালি বন্ধু-বান্ধবী রয়েছে। ও আমাকে নেহালদা বলে। গারোরা সাধারণত দাদা-বৌদি-বাবু এ শব্দগুলো ব্যবহার করে বাঙালিদের সঙ্গে কথোপকথনে। অনেকটা স্মার্ট আর দেখতে মঙ্গোলীয়দের মতো। নাট্যশিল্পী মনিরাও আমাকে নেহালদা এবং নেহালবাবু বলে। আমি প্রথমে ওকে গারো ভেবেছিলাম। আমি ওয়াংগালা উৎসবে অনেক বাঙালিকেও দেখলাম। আমরা সবাই একত্রে উপভোগ করি ওয়াংগালা। এদের জন্য আমরা কি কিছুই করতে পারি না? হ্যাঁ, অবশ্যই পারি। শুধু সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা আমাদের সার্বিক অগ্রগতির জন্য খুব দরকার। আমরা বৈষম্যহীন, সুখী, সমৃদ্ধিশালী বাংলাদেশ চাই, যে বাংলাদেশের স্বপ্ন একাত্তর সালে দেখে দেশ স্বাধীন করেছি।
====================
স্মরণ- 'বাঘা যতীনঃ অগ্নিযুগের মহানায়ক'  খবর, কালের কণ্ঠের- আগেই ধ্বংস মহাস্থানগঃ হাইকোর্টের নির্দেশে কাজ বন্ধ  কেয়ার্নের সঙ্গে স্বার্থবিরোধী চুক্তির পেছনেও জ্বালানি উপদেষ্টা  উইকিলিকস জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের আত্মসমর্পণ  সবুজ মাঠ পেরিয়ে  আলোচনা- 'আরো অনুদানের টাকা সরিয়েছিলেন ইউনূস'  আলোচনা- 'একটি 'উজ্জ্বল ভাবমূর্তির' এভারেস্ট থেকে পতন  গল্পালোচনা- 'আসি আসি করে আশিতে আসবে!'  রাষ্ট্র ও রাজনীতিঃ সবুজ মাঠ পেরিয়ে  স্মরণ- 'রবীন্দ্রনাথ—সার্ধশত জন্মবার্ষিকীতে'  স্মরণ- 'জননেতা দেওয়ান ফরিদ গাজী'  আলোচনা- 'প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফর ও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের নতুন পর্যায়'  আলোচনা- 'কর্মপরিবেশঃ স্বর্গে তৈরি'  গল্পালোচনা- ‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া...’  আন্তর্জাতিক- উইকিলিকসঃ হাটে হাঁড়ি ভাঙা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ  গল্পসল্প- ওরা ধান কুড়ানির দল  শিক্ষা- আদিবাসী পাহাড়ে বিশ্ববিদ্যালয় চাই  জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের অর্থের মূল উৎস সৌদি আরব  রাজনৈতিক আলোচনা- এমন বন্ধু থাকলে...  শিল্প-অর্থনীতি শেয়ারবাজারের সুন্দরী প্রতিযোগিতা-তত্ত্ব  সাক্ষাৎকার- খাদ্যনিরাপত্তার জন্য বিকল্প উপায় খুঁজতা হবে  খবর, প্রথম আলোর-  দলীয় স্বার্থ বড় করে দেখবেন না  মার্কিন কূটনীতিকদের গোপন তারবার্তাঃ পাকিস্তানে জঙ্গি নির্মূলে ১০-১৫ বছর লাগবে  অধ্যাপক ইউনূসের অর্থ স্থানান্তর : গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যাখ্যা  শিল্প-অর্থনীতি 'সময় এসেছে মাথা তুলে দাঁড়াবার'  প্রকৃতি- 'কিয়োটো প্রটোকল ভেস্তে যাচ্ছে, কানকুনে কী হবে?  আলোচনা- 'মেয়েদের লাঞ্ছনা বন্ধ করতে কঠোর হতে হবে'  যুক্তি তর্ক গল্পালোচনা- 'আগ্নেয়গিরির ওপরে পিকনিক'  আলোচনা- 'হিমালয়ের কোলে এক টুকরো দক্ষিণ এশিয়া'  স্মরণ- 'মানুষের জন্য যিনি জেগে থাকতেন'  রাজনৈতিক আলোচনা- 'আবার আসিব ফিরে!'  আলোচনা- 'রাজকীয় সম্মেলন'  যুক্তি তর্ক গল্পালোচনা- 'অসারের তর্জন-গর্জন'  আলোচনা- 'একজন নোবেল বিজয়ী, বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ও ক্ষুদ্রঋণের ফাঁদ'


দৈনিক কালের কণ্ঠ এর সৌজন্যর
লেখকঃ নেহাল আদেল
সুইডেন প্রবাসী নৃতাত্তি্বক


এই অলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.