আসুন, আমরা গর্বিত নাগরিক হই ব্য সালমা খান



প্রথম আলো বিগত এক যুগ ধরে শুধু বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন নয়, সেই সঙ্গে মানবিক চিন্তা বিকাশে ও উন্নত সমাজ বিনির্মাণে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করছে, যা সুশীল সমাজে প্রশংসিত হয়েছে। দশম বছর পূর্তিতে ‘বদলে যাও বদলে দাও’ স্লোগানের পর এ বছর এক যুগ পূর্তিতে প্রথম আলো আলোকিত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে হূদয় নিঙড়ানো এক অঙ্গীকারে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করতে সচেষ্ট হয়েছে, ‘আসুন, মায়ের মতো দেশকে ভালো বাসি।’
প্রতিটি জাতিই দেশকে মায়ের সঙ্গে তুলনা করে, যে ভাষাতেই হোক, দেশমাতৃকার চরণে সবাই বিনম্র শ্রদ্ধায় মাথা ঠেকায়। কিন্তু দেশকে মায়ের মতো ভালোবাসা যদি অতি স্বাভাবিক ও সপ্রতিভ হয়, তাহলে দেশে দেশে আজকে এত হানাহানি, শোষণ, দুর্নীতি ও বঞ্চনা কেন? কটা দেশে শান্তি ও সমতা, মানবিক বোধ ও সুশাসন বিরাজ করছে?
ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশের মানুষ দেশের জন্য কম ত্যাগ করেনি। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলন, ভাষাসংগ্রাম থেকে স্বাধীনতাসংগ্রাম—সবকিছুর পটভূমি ছিল দেশকে ভালোবাসার গভীর চেতনাবোধে। তা সত্ত্বেও স্বাধীনতার ৪০ বছর পর দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আমাদের মধ্যে এত হাতাশা কেন? সরকারি পরিসংখ্যান মোতাবেক মাথাপিছু আয় বাড়ছে, আর বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দারিদ্র্য। দুর্নীতি আর অপশাসনে আমরা এগিয়ে চলেছি পাগলা ঘোড়ার গতিতে, নারীর প্রতি সহিংসতা ক্রমবর্ধমান। এ সবকিছুর সঙ্গে রাজনীতির সাংঘর্ষিক রূপান্তর গণতন্ত্রকে করে তুলেছে বিপন্ন। অথচ এমন তো হওয়ার কথা নয়, কী অপার সম্ভাবনার দেশ আমাদের, যাকে নিয়ে আমাদের স্বপ্নের আর প্রত্যাশার শেষ নেই, যাকে আমরা মায়ের মতো ভালোবাসতে চাই।
আমার ধারণায় দেশকে ভালোবাসার প্রধান শর্ত হলো দেশের জন্য গর্ববোধ করা। দেশ আমাদের যতটুকু দিতে পেরেছে বিনম্র শ্রদ্ধার তা গ্রহণ করে দেশকে নিয়ে আমাদের প্রত্যাশা পূরণের সংগ্রামে নিজেকে আন্তরিকভাবে উৎসর্গ করা। স্বাধীনতার ৪০ বছরের খতিয়ানে যেমন রয়েছে আমাদের অপ্রাপ্তির হতাশা, তেমনি রয়েছে উজ্জ্বল অর্জন। পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ হওয়া সত্ত্বেও সামগ্রিক মানবসম্পদ উন্নয়নে বিশ্বের ১৬৯ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থান ১২৯। সেই সঙ্গে শিশুমৃত্যুর হার হ্রাসে, নারীশিক্ষার অগ্রগতিতে এবং গড় আয়ুষ্কাল বৃদ্ধিতে আমরা ভারতসহ এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশকে পেছনে ফেলে এসেছি। সামান্য স্বার্থত্যাগ দেশের জন্য অপার ভালোবাসা আর অসীম গর্ববোধ থাকলে এই উপাদানগুলোই আমাদের নিয়ে যেতে পারে আকাঙ্ক্ষিত সামষ্টিক উন্নয়নের পথে, প্রত্যাশা পূরণের নবদিগন্তে।
তাহলে আমাদের সমস্যাটা কোথায়—আমরা কি দেশকে মায়ের মতো ভালোবাসতে পারিনি? আমার মনে হয়, দেশকে আমরা অনেকেই মায়ের মতো ভালোবাসি ঠিকই, কিন্তু দেশের নাগরিকত্ব নিয়ে গর্বিত অহংবোধ আমাদের মধ্যে আজও সৃষ্টি হয়নি। ইন্দোনেশিয়ায় থাকাকালে এমন অনেক বাংলাদেশি অভিবাসী পরিবারের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছে, যারা ঘরের ভেতর বাঙালিপনার আবেগে ভরপুর। কিন্তু বাইরে বেরোলে নিজেকে বাংলাদেশি বলে পরিচয় না দিয়ে ‘ভারতীয়’ পরিচয় দেয় এই অজুহাতে যে বাংলাদেশকে অনেকে চেনে না। কী চরম হীনম্মন্যতা!
এ প্রসঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ের ছোট কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ একটি সংবাদ উল্লেখ্য। এশিয়ান গেমসে অংশ নেওয়া বাংলাদেশ দলের খেলোয়াড় ও কর্মকর্তাদের সীমিত সামর্থ্যের মধ্যেও দেশের পতাকাখচিত ট্র্যাকস্যুট, জার্সি, প্যান্ট ও ব্লেজার দেওয়া হয়েছে। অথচ খেলোয়াড় ও কর্মকর্তাদের মধ্যে গেমসের পোশাক পরার ক্ষেত্রে অনীহা দেখা গেছে এবং কাবাডি কোচ ও ক্রিকেটাররাও গেমসের পোশাক পরে খুব একটা বের হননি। বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তাদের মধ্যেও গেমসের পোশাক পরা নিয়ে ছিল অনীহা। কিন্তু ভারতীয় ক্রীড়াবিদেরা সর্বক্ষণ দেশের পতাকাখচিত পোশাক পরেন। ভারতীয় মহিলা কাবাডি দলের কোচ সুনীল বলেন, ‘এ পোশাক আমার গর্বের। গেমসের পোশাক দিয়ে দেশের পরিচয় তুলে ধরতে পারি।’ (আমাদের সময় ১৩.১১.১০)
আসলে মাকে ভালোবাসা অনেক সহজ। কারণ, মা শুধু দিয়ে যায়, বিনিময়ে মাকে কিছু দিতে হয় না। মাকে আমরা সহজাতভাবে, বিনা প্রচেষ্টায়, বিনা ত্যাগে ভালোবাসি, মা ততটা দায়িত্বপ্রসূত নয়, যতটা আবেগপ্রসূত। তাই দেখা যায়, চরম দুর্নীতিবাজ, শঠ ও জনস্বার্থবিরোধী লোকেরাও মাকে ভালোবাসতে কার্পণ্য বোধ করে না। কিন্তু দেশকে ভালোবাসতে হলে দেশের অসংখ্য অদেখা-অচেনা মানুষের ন্যায্যতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে, স্বার্থপরতা ত্যাগের বিনিময়ে একজন বাংলাদেশি হওয়ার অহংকারবোধ নিয়ে ভালোবাসতে হবে।
জন্মলগ্ন থেকেই আমরা জানি বাংলাদেশ একটি দরিদ্র দেশ। শুধু বাংলাদেশে জন্মানোর আত্মপরিচয়ের অহংকারবোধ থেকেই আমরা কঠিন যাত্রাপথ পরিক্রম করে এত দূর এসেছি। বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে সবাইকে নিয়ে সুখী-সমৃদ্ধ জীবনযাপন করতে হলে একদিকে দেশের মূল সমস্যা এবং অন্যদিকে দেশকে নিয়ে আমাদের অহংকারের প্রতীকগুলো আবিষ্কার করতে হবে। বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রতিবন্ধকতাগুলো ঘোচানোর দায়িত্ব সবাইকে ভাগ করে নিতে হবে। যার যার স্থানে থেকে দায়িত্ব পালন করলেও উন্নত অর্থনীতি ও বিকশিত সমাজ গঠনের সংগ্রামটা হতে হবে সমষ্টিগতভাবে, যে সক্ষমতার পরিবেশ সৃষ্টির দায়িত্ব বর্তাবে সরকারের ওপর। একটা বৈষম্যহীন গর্বিত জাতি হিসেবে বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোই ছিল আমাদের স্বাধীনতার সবচেয়ে বড় স্বপ্ন। এ স্বপ্ন সফল করতে হলে দেশের প্রত্যেক নাগরিক, বিশেষ করে তরুণদের কাছে উন্মোচিত করে দিতে হবে সুযোগের দুয়ার। একদিকে যেমন তারুণ্যের অপচয় রোধে চাই সৃজনশীল পরিকল্পনা, অন্যদিকে দেখতে হবে তারা যাতে বেকারত্বের ঘেরাটোপে না পড়ে। এক বিরাট জনসংখ্যা নিয়ে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে সর্ব প্রথম জনসংখ্যা-বিস্ফোরণকে প্রধান জাতীয় সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে সরকারকে। স্বল্প আয়তনের দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধ করে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে দৃঢ়সংকল্প ভূমিকা পালন করতে হবে সরকারকে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, গত এক দশকে দেশে বেকারত্ব বেড়েছে ১ দশমিক ৬ শতাংশ। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা দেশজ উৎপাদিত দ্রব্যের বাজার না পেয়ে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে ব্যর্থ হচ্ছেন। সীমিত সম্পদে প্রস্তুতকৃত পণ্যের অভ্যন্তরীণ ও বিদেশি বাজার সংকুচিত হচ্ছে আর সেই সঙ্গে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের আমদানি বাড়ছে। এমনকি আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গেও আমাদের রয়েছে বিরাট বাণিজ্য ঘাটতি। ২০০৯-১০ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ভারতে রপ্তানির পরিমাণ ছিল মাত্র তিন কোটি ৩০ লাখ ডলার। বিপরীতে ভারত থেকে পণ্য আমদানি হয়েছে ৪০০ কোটি ডলারের। বহির্বাণিজ্য নীতি ও শুল্ক ছাড়াও এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য প্রধান অন্তরায় ছিল দেশীয় পণ্যের প্রতি জনগণের অনাগ্রহ। গত দুই ঈদের বাজারে তাই ঢাকার গুলশান থেকে গাউছিয়া, এমনকি মফস্বলের ছোট বাজারগুলোও ছিল বিদেশি পণ্যে উপচে পড়া। অনেক দোকানিকে গর্বের সঙ্গে বলতে শুনেছি, ‘আমরা কোনো দেশীয় জিনিস দোকানে রাখি না।’
এখনো আমাদের শপিং মলগুলোতে গেলে অনায়াসে মনে করা যাবে যে আমরা বিদেশে কোথাও শপিং করছি। এ রকম দৃশ্য কি আমাদের প্রতিবেশী কোনো রাষ্ট্রে দেখা যাবে? আমাদের আশপাশের সব দেশই তাদের শিল্প সংরক্ষণ নীতিতে দৃঢ় এবং সেই সঙ্গে দেখা যায় তাদের জনগণ অধিক গর্ববোধ করে নিজের দেশের পণ্য ব্যবহার করতে। দেশজ সংস্কৃতি ও বিনোদন চাহিদার ক্ষেত্রেও অনেক সময় উদ্যোক্তাদের মধ্যে এ ধরনের আচরণ দেখা যায়, আমরা যার প্রতিবাদ করি না। অন্য দেশের সাধারণ মানের নাম না-জানা শিল্পীদের কোটি টাকা দিয়ে মনোরঞ্জনের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়, অথচ দেশের অনেক প্রতিভা অর্থাভাবে দারিদ্র্যের গহ্বরে হারিয়ে যায়। সেদিকে আমরা দৃষ্টিপাত করি না। এসবই দেশ নিয়ে আমাদের গর্ব ও অহংকারবোধের অভাব। নিজের কানা ছেলেকে ভালোবাসব, কিন্তু আঁচল দিয়ে ঢেকে রাখব, পাছে কেউ দেখে ফেলে—এ রকম মনোভাব থেকে মুক্তি পেতে হবে। বিশ্বায়নের যুগে অবশ্যই জানালাগুলো খুলে দেব মুক্ত বাতাস সঞ্চালনের জন্য, তবে সিংহ দুয়ার আগলে রাখব দেশের গর্বিত প্রহরী হিসেবে। আসুন, আমরা দেশের গর্বিত নাগরিক হই, স্বাধীনতার মাসে এই হোক আমাদের প্রতিজ্ঞা।
সালমা খান: অর্থনীতিবিদ, নারীনেত্রী।

No comments

Powered by Blogger.