রাজনৈতিক আলোচনা- 'রাজনীতি পুরনো পথেই' by আবদুল্লাহ আল ফারুক

(১১ জানুয়ারি ২০১০ সালে লেখা) আজ বহুল আলোচিত সেই এক-এগারো বা ওয়ান ইলেভেন। রাজনীতিবিদদের জন্য এটি অনুশোচনারও একটি দিন। এক-এগারোর যে খৰে রাজনীতিকরা পড়েছিলেন,

তাদেরই সহজ-সরল স্বীকারোক্তি হচ্ছে, রাজনীতিতে কাঙ্ক্ষিত সেই পরিবর্তন আসেনি। রাজনীতিবিদদের মধ্যেও সেই সচেতনতা ফিরে আসেনি। দেশের রাজনীতি এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে যে গুণগত পরিবর্তন আশা করা হয়েছিল, সেটাও হয়নি। বরং সেই এক-এগারোর আগের সাংঘর্ষিক রাজনীতি যেন আবার ফিরে আসছে দেশে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সরকারের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে স্বীকার করেছেন, এক-এগারো পূর্ববর্তী পরিস্থিতি সৃষ্টির একটি পাঁয়তারা চলছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বর্তমান পরিস্থিতিকে অত্যন্ত দুঃখজনক মন্তব্য করে বলেছেন, 'আমরা সাংঘর্ষিক ও প্রতিহিংসার রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তা হচ্ছে না। বরং পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে।'
২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি তৎকালীন রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ড. ইয়াজউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন বিতর্কিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে হটিয়ে ড. ফখরুদ্দীন আহমদের সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেশের দায়িত্ব নেয়। জারি হয় জরুরি অবস্থা। ২০০৯ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগ পর্যন্ত শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াসহ দেশের প্রথম সারির অধিকাংশ রাজনীতিবিদ গ্রেপ্তার হন। রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, আমলা মিলিয়ে বিভিন্ন জনের বিরুদ্ধে পৌনে ৫০০ মামলা দায়ের করা হয়। সাজা হয় ৩০০ জনের। এর মধ্যে অন্তত ৯০ জন ছিলেন প্রতিষ্ঠিত রাজনীতিবিদ।
শেখ হাসিনা গ্রেপ্তার হন ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই, আর মুক্তি পান ২০০৮ সালের ১১ জুন। তাঁর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজিসহ মোট ৯টি মামলা দায়ের করা হয়। খালেদা জিয়া গ্রেপ্তার হন ২০০৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর, আর মুক্তি পান ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর। তার বিরুদ্ধে মামলা হয় ৩টি। তার বড় ছেলে বিএনপির তৎকালীন সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব তারেক রহমান ২০০৭ সালের ৭ মার্চ গ্রেপ্তার হয়ে পরের বছর ৩ সেপ্টেম্বর মুক্তি পান এবং বিদেশে চলে যান ১১ সেপ্টেম্বর। তারেকের বিরুদ্ধে মামলা হয় ১৩টি। খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোকেও প্রায় এক বছর কারাভোগ করতে হয়। অনেক রাজনীতিক ও ব্যবসায়ী দেশ-বিদেশে পালিয়ে বেড়ান। গ্রেপ্তার হওয়া অনেক নেতার ওপর জিজ্ঞাসাবাদের নামে চলেছে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বিএনপির সিনিয়র সহসভাপতি তারেক রহমান এবং এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু এই নির্যাতনের কথা অকপটে স্বীকার করেন। চাপ সৃষ্টি করে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা-পয়সা আদায় করা হয়েছে বলেও অনেক অভিযোগ আছে।
এক-এগারোর সরকারের দুই বছরের শাসনামলে দেশে গণতন্ত্র, নাগরিকদের মৌলিক ও মানবাধিকার এবং সংবাদপত্রের কোনো স্বাধীনতা ছিল না। শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে (মাইনাস টু) ভিন্ন এক রাজনৈতিক ধারা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়। কতিপয় রাজনীতিবিদের দুর্নীতি, অনাকাঙ্ক্ষিত পারিবারিক রাজনীতির কুফল এবং সাংঘর্ষিক ও প্রতিহিংসার উদাহরণ সামনে নিয়ে আসে তত্ত্বাবধায়ক সরকার। দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কেউ নিজেদের ওপর দায় নিতে রাজি নয়। তারা এক-এগারোকে অভিশাপ হিসেবে বর্ণনা করে এর জন্য পরস্পরকে দোষারোপ করে বক্তব্য দিয়ে থাকে। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ২৯ ডিসেম্বর ঢাকার অদূরে একটি সেতু উদ্বোধনকালে এক-এগারোর জন্য বিএনপিকে দায়ী করেন। তিনি বলেন, বিএনপির দুর্নীতি, লুটপাট, দলীয়করণ এবং ২২ জানুয়ারি একতরফা নির্বাচনের উদ্যোগই এর জন্য দায়ী। বিরোধী দলের নেতা ও বিএনপি চেয়ারপারসন একাধিকবার এক-এগারোর জন্য আওয়ামী লীগের সাংঘর্ষিক রাজনীতিকে দায়ী করে বক্তব্য দিয়েছেন। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর বিএনপির ক্ষমতা হস্তান্তরের দিন এবং তার একদিন আগে ১৪ দলীয় জোট লগি-বৈঠা নিয়ে রাজপথে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এ সময় কয়েকজন প্রাণ হারান। এরই ধারাবাহিকতায় এক-এগারোর ঘটনা ঘটে বলে খালেদা জিয়ার অভিযোগ।
অনেক কাঠখড় পোড়ানোর পর ২০০৯ সালের ২৯ ডিসেম্বর দেশে কাঙ্ক্ষিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, যার মাধ্যমে দেশ এক-এগারোর নাগপাশ থেকে মুক্তি পায়। তবে এক বছরে রাজনীতির গতিপথ আবার উল্টোদিকে চলতে শুরু করেছে। বিএনপি জাতীয় সংসদের অধিবেশন বর্জন করছে। সরকারকে মেয়াদ পূর্ণ করতে না দেওয়ার ঘোষণাও দিয়েছেন বিরোধী দলের নেতারা। সেই সঙ্গে সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ইস্যুতে রাজপথের আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে চারদলীয় জোট। আওয়ামী লীগ বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তন, সেনানিবাসের বাসভবন থেকে খালেদা জিয়াকে উচ্ছেদের নোটিশ দেওয়ার পাশাপাশি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দায়ের করা আওয়ামী লীগ নেতাদের মামলা প্রত্যাহার করলেও ঝুলিয়ে রাখছে বিএনপি নেতাদের মামলাগুলো। এ পরিস্থিতিকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতারা দুঃখজনক ও আশঙ্কাজনক বলে মূল্যায়ন করছেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ৮ জানুয়ারি সংবাদ সম্মেলনে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, দেশে এক-এগারো পূর্ববর্তী পরিস্থিতি সৃষ্টির পাঁয়তারা চলছে।
বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন কালের কণ্ঠকে জানান, 'আমরা যে সাংঘর্ষিক ও প্রতিহিংসার রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে চেয়েছিলাম, তা সম্ভব হচ্ছে না। বরং পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক।' তিনি আরো জানান, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর থেকেই বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন চালিয়ে প্রতিহিংসার রাজনীতি শুরু করেছে। প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। সেই ধারা পরিহার করতে সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ওবায়দুল কাদের জানান, যে কারণে এক-এগারো সৃষ্টি হয়েছিল, সেই রাজনৈতিক বৃত্ত থেকে দেশ বেরিয়ে এসেছে বলে তার মনে হয় না। অতীতের ভুল থেকে কেউ শিক্ষা নিয়েছে বলেও মনে হয় না তার। এক-এগারো সৃষ্টির মতো কারণ হচ্ছে অতিরিক্ত 'পার্টিজান পলিটিক্সে' জড়িয়ে পড়া। দ্বিধা-দ্বন্দ্ব বা শত্রুতা রাজনৈতিক অঙ্গনে আরো বিভাজন ঘটাবে। 'পার্টিজান' মনোভাব পরিহার করা উচিত। তা না হলে এর ফল কোনোভাবেই শুভ হবে না।
সুজনের সভাপতি ও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআইবি) ট্রাস্টি প্রফেসর মোজাফ্ফর আহমদ জানান, রাজনীতিতে যে পরিবর্তন আশা করা হয়েছিল, তা হয়নি। তবে কিছু পরিবর্তন এসেছে। পরিবর্তনের জন্য দাবি অব্যাহত রাখতে হবে। তা ছাড়া কেউ পরিবর্তন নিজে থেকে করে দিয়ে যাবে না। আর সাংঘর্ষিক ও প্রতিহিংসার রাজনীতির কথা রাজনীতিবিদরাই যখন স্বীকার করছেন, তখন তারা এসব বাদ দিলেই পারেন, এর সঙ্গে না জড়ালেই পারেন।
প্রফেসর মোজাফ্ফর আরো জানান, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে তিনি শঙ্কিত নন। তিনি সব সময় একজন আশাবাদী মানুষ।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি আনিসুল হক জানান, দেশের রাজনীতিতে অবশ্যই পরিবর্তন আশা করে জনগণ। তবে এ জন্য এখনই মন্তব্য করার সময় আসেনি। এখন মন্তব্য করলে তা আগাম হয়ে যাবে। তবে তাঁর মতে, রাজনীতিবিদদের মধ্যে কিছুটা সচেতনতাবোধ তৈরি হয়েছে।
=============================
খবর- ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেনের মহাসড়ক  আলোচনা- 'বাংলাদেশে মিডিয়া ও তার ভবিষ্যৎ' by সাইফুল বারী  প্রবন্ধ- রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেনের 'অবরোধবাসিনী'  ফিচার- ‘হিমশীতল শহরগুলোর দিনরাত' by তামান্না মিনহাজ  গল্পালোচনা- ''সে কহে বিস্তর মিছা যে কহে বিস্তর'  সাক্ষাৎকার- হুমায়ূন আহমেদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ইমদাদুল হক মিলন  ইতিহাস- পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ডাইনোসরের ফসিল 'স্যু' এর কাহিনী  খাদ্য আলোচনা- 'অপুষ্টির প্রধান কারণ দারিদ্র্য ও অজ্ঞতা by শেখ সাবিহা আলম  গল্পালোচনা- 'ডান রাস্তার বামপন্থী' by কাওসার আহমেদ  খবর- 'মারা যাবে না একটি শিশুও' -বিলগেটসপত্নী, মেলিন্ডা গেটস  আলোচনা- 'সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনের অঙ্গীকারঃ  নিবন্ধ- সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড-একটি দেশ একটি কবিতার জন্ম by আলীম আজিজ  আলোচনা- 'আরও একটি সর্বনাশা দেশ চুক্তির বোঝা' by আনু মাহমুদ  গল্পালোচনা- হতাশার বিষচক্র থেকে জাতিকে মুক্ত করতে হবে


কালের কণ্ঠ এর সৌজন্যে
লেখকঃ আবদুল্লাহ আল ফারুক


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.