আলোচনা- 'মুনাফার মালা গলায় ঝুলিয়ে পুঁজিবাদীরা মানবজাতি ধ্বংসের ব্যবস্থা করছে' by বদরুদ্দীন উমর

এ বছর দুনিয়াজুড়ে শীতের প্রকোপ এমন বৃদ্ধি পেয়েছে, যা দীর্ঘদিনের ইতিহাসে দেখা যায়নি। চীন, জাপান, কোরিয়া থেকে নিয়ে ইউরোপ-আমেরিকায় যেভাবে এখন একটানা তুষারপাত হচ্ছে, এটাও এক অতি ব্যতিক্রমী ব্যাপার।

এর মধ্যে যে অস্বাভাবিকত্ব রয়েছে, এটা উপেক্ষার বিষয় নয়। মানুষ তার প্রতি অন্যের ব্যবহারের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো সতর্ক সংকেত সাধারণত দেয় না। কিন্তু প্রকৃতির আচরণ এদিক দিয়ে ভিন্ন।
মানুষ প্রকৃতির নিয়মাবলি আবিষ্কার করে সেই নিয়মকে মান্য করে তা ব্যবহারের মাধ্যমেই বিজ্ঞান ও সভ্যতার বিকাশ ঘটিয়েছে। এ কাজ প্রকৃতির নিয়ম অমান্য করে বা প্রকৃতির বিরুদ্ধতা করে মানুষ সিদ্ধ করেনি, করা সম্ভবও ছিল না। কাজেই মানুষ প্রকৃতিকে কখনো জয় করতে পারে না।
যাকে এই জয় বলে আখ্যায়িত করা হয়, সেটা আসলে প্রকৃতির আনুগত্য স্বীকার করে নিয়ে, প্রকৃতির নিয়ম মান্য করে তাকে কাজে লাগানোই বোঝায়। প্রকৃতিকে 'জয়' করার চেষ্টা করতে গিয়ে যদি তার বিরুদ্ধতা করা হয়, তাহলে প্রকৃতি ব্যতিক্রমহীনভাবে প্রতিশোধ গ্রহণ করে। আগুনকে মানুষ কতভাবেই না ব্যবহার করে থাকে। কিন্তু সেই আগুনের নিয়ম অমান্য করে যদি আগুনে হাত দিয়ে নিজের শক্তি দেখাতে যায়, তাহলে তার হাত পুড়িয়ে প্রকৃতি প্রতিশোধ নেয়। এটা শুধু আগুনের ক্ষেত্রেই নয়, প্রকৃতির সব ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
প্রকৃতি যখন তার নিয়মের বিরুদ্ধতার প্রতিশোধ নেয়, তখন পূর্বাহ্নেই সতর্ক সংকেত দিয়ে সেটা করে থাকে। প্রকৃতির আচরণ এদিক দিয়ে খুব সরল ও সহজবোধ্য। আমাদের এই ধরিত্রীতে জীবনের সৃষ্টি হয়েছে তার জন্য কতকগুলো প্রয়োজনীয় শর্ত সৃষ্টির মাধ্যমে। এই শর্ত অনুযায়ী শুধু এককোষযুক্ত প্রাণেরই সৃষ্টি হয়নি। যাকে জীববৈচিত্র্য বলা হয়, সেটাও লাখ লাখ প্রাকৃতিক শর্তের সৃষ্টি। কাজেই ধরিত্রীতে জীবনের অস্তিত্ব, জীববৈচিত্র্যের অস্তিত্ব অগণিত প্রাকৃতিক শর্তের দ্বারাই তৈরি। ধরিত্রীতে জীবনের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে, যে শর্তে একেকটি জীবের সৃষ্টি হয়েছে, সেই শর্ত নষ্ট হওয়ায় তাদের অস্তিত্বও নিশ্চিহ্ন হয়েছে। এ সবই নির্ভর করে তাপ, চাপ, খাদ্য সংস্থান, আবাসভূমি ইত্যাদি অনেক শর্তের ওপর। এসব শর্ত কীট-পতঙ্গ, গাছ-গাছড়া থেকে নিয়ে মানুষ এবং বিশাল বৃক্ষরাজির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
আজকের বিশ্ব পরিস্থিতির দিকে তাকালে দেখা যাবে, এসব শর্ত বিলুপ্ত হতে থাকার সঙ্গে সঙ্গে অসংখ্য জীবজন্তু ও গাছপালা ধীরে ধীরে তাদের অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলছে। সংবাদপত্রে নিয়মিতভাবে এসবের রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। যেসব জীবজন্তু এখনো বিলুপ্ত হয়নি, কিন্তু হুমকির মুখে, তাদের বিষয়েও রিপোর্ট এবং আলোচনা দেখা যায়। আমাদের এই দেশেও এমন দেখা যায়, কিভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলে অবাধে বনাঞ্চল ধ্বংস হতে থাকায় হাতিদের আবাসস্থল আক্রান্ত ও সংকুচিত হতে থাকার কারণে শুধু যে তাদের থাকার জায়গার সমস্যা হয় তা-ই নয়, তাদের খাদ্যাভাবও দেখা দেয়। এজন্য তারা প্রায়ই লোকালয়ে আসে খাদ্যের সন্ধানে। অকারণ মানুষ যেভাবে তাদের ক্ষতিগ্রস্ত করছে, তার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তারা বাড়িঘর ভাংচুর এবং ক্ষেত-খামার ক্ষতিগ্রস্ত করে। এর জন্য মানুষ হাতিকে দোষারোপ করে তাদের 'তাণ্ডবের' কথা বলে। কিন্তু এর জন্য যে তাদের নিজেদের তাণ্ডবই দায়ী, এটা স্বীকার করার সাহস ও প্রয়োজন তাদের হয় না।
শুধু হাতিই নয়, চিতা বাঘ, মেছো বাঘ, এমনকি সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগারদের ক্ষেত্রেও এই একই কারণে একই ব্যাপার ঘটছে। তারা লোকালয়ে চলে আসছে খাদ্যের সন্ধানে। বাঘে মানুষ মারছে। আসলে এ হলো মানুষ কর্তৃক প্রকৃতির ওপর হামলার প্রতিশোধ। এ ধরনের হিংস্র জন্তু ছাড়াও আছে বানরকুল। বানররা বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নিজেদের আবাসভূমি সংকুচিত হওয়া অথবা হারিয়ে যাওয়ায় দিন দিন লোকালয়ে আসছে খাদ্যের সন্ধানে। মানুষ একেও দেখছে উপদ্রব হিসেবে। কিন্তু এই 'উপদ্রবের' জন্য যে তারা নিজেরাই দায়ী_এ ভাবনা তাদের মাথায় নেই।
শকুন, চিল, মানিকজোড় ও শামুকখোলার মতো বড় আকারের পাখি থাকে বিশাল বিশাল বৃক্ষে। এই বৃক্ষ এখন দেশজুড়ে ধ্বংস করা হচ্ছে। এর ফলে এসব পাখির বাসা নষ্ট হওয়ায় তাদের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হচ্ছে। ছোট-বড় সব আকারের গাছপালা ধ্বংস হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ছোট আকারের শত শত জাতের অনেক পাখিও ইতিমধ্যেই ধ্বংস হয়েছে; অন্যরাও হুমকির মুখে। শুধু বাসা সমস্যাই নয়, শস্যক্ষেতে কীটনাশকের অবাধ ব্যবহারের জন্যও পাখি ধ্বংস হচ্ছে। মাঠে কীট মারা যাচ্ছে এবং সেই মৃত কীট খেয়ে পাখিরাও বিষ দ্বারা আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে। পাখির জন্য বিখ্যাত যে বাংলাদেশ পাখির কলকাকলিতে মুখরিত থাকত, তাদের অস্তিত্ব এখন আর নেই। কত প্রজাতির পাখি যে নিশ্চিহ্ন হয়েছে, তার হিসাব নেই। বাকিরাও এখন নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে।
ধরিত্রীর উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে এখন সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই বৃদ্ধির কারণে ইতিমধ্যেই দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর উপকূলের জেলাগুলোতে সমুদ্রের পানি এগিয়ে এসে ভূমি গ্রাস করছে। এটা এখন বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত যে, আগামী দুই-এক দশকের মধ্যে বঙ্গোপসাগরের পানি দক্ষিণ বাংলাদেশে এমনভাবে উপকূলীয় ভূমি গ্রাস করবে, যাতে কোটি কোটি মানুষ তাদের আবাসভূমি পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়ে গৃহহীন উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে। শুধু তা-ই নয়, তাদের জীবিকার সংকটও হবে তীব্র। এখন পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং সুন্দরবনের হাতি ও বাঘের এবং অন্যান্য অঞ্চলে বানরদের যে অবস্থা হয়েছে, অল্পদিনের মধ্যেই তার চেয়ে শোচনীয় অবস্থা হবে বাংলাদেশের দক্ষিণ উপকূলের মানুষের। এর পরিণতিতে শুধু যে সেই অঞ্চলের মানুষের জীবনই সংকটাপন্ন হবে তা-ই নয়, সারা বাংলাদেশ এক অদৃষ্টপূর্ব সংকটে পতিত হবে। খাদ্য ও কাজের অভাব, গৃহের অভাব চারদিকে ব্যাপকভাবে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিরও চরম অবনতি ঘটাবে। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে দেশব্যাপী সর্বস্তরের মানুষের জীবন বিপর্যস্ত হবে।
এই বিপর্যয়ের সংকেত প্রকৃতি এখন উন্নত পুঁজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোকেও দিচ্ছে। শিল্পকারখানাগুলোতে নির্গত কার্বন গ্যাস নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজনীয় পুঁজি বিনিয়োগ করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে নিজেদের মুনাফা বৃদ্ধির মাধ্যমে তারা প্রকৃতির বিরুদ্ধে যে আক্রমণ এখনো চালিয়ে যাচ্ছে, তার পরিণাম যে তাদেরও সমুচিতভাবে ভোগ করতে হবে, তার সংকেতই এ বছর শীত মৌসুমে সারাবিশ্বে শীতের প্রকোপ বৃদ্ধি এবং উপরোক্ত দেশগুলোতে একটানাভাবে অদৃষ্টপূর্ব তুষারপাতের মধ্যে দেখা যাচ্ছে।
গত ডিসেম্বর মাসে কোপেনহেগেনে কার্বন গ্যাস নির্গমন কমিয়ে আনা এবং পরিবেশ রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পুঁজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী ধনী দেশগুলো অস্বীকার করে এদিক দিয়ে পরিস্থিতির অবনতি ঘটিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থাই করেছে। এই অবনতি ঘটতে থাকলে তারা নিজেরাও কিভাবে আক্রান্ত হবে, কিভাবে এই তুষারপাত তাদের অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে, তার হিসাব তারা ইতিমধ্যেই শুরু করেছে। এই ক্ষতির পরিমাণ যে কার্বন গ্যাস কমিয়ে আনার খরচ থেকে কম নয় এবং অদূর ভবিষ্যতে তা অনেক গুণ বৃদ্ধি পাবে, এ নিয়েও তাদের অবশ্যই অঙ্ক কষতে হবে। পুঁজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদীরা মানবিক কারণে কার্বন গ্যাস কমিয়ে আনতে আগ্রহী না হলেও তুষারপাতের মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয় যে তাদের ক্ষতির পরিমাণ বছর বছর বৃদ্ধি করে মুনাফার মাথায় বাড়ি মারবে, এ উপলব্ধি তাদের ইতিমধ্যেই হতে শুরু করেছে। কাজেই কোপেনহেগেনের পরবর্তী বিশ্ব পরিবেশ সম্মেলনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে নিয়ে অন্য উন্নত পুঁজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোকে এ ক্ষেত্রে দ্রুত প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা যে গ্রহণ করতে হবে, এটাই মনে হয়। মানবজাতি ধ্বংসের এই প্রাকৃতিক সংকেত যদি তারা হিসাবের মধ্যে না নেয় এবং সেই অনুযায়ী কাজ না করে, তাহলে পরিস্থিতি আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই আয়ত্তের বাইরে যাবে এবং শুধু শ্রমিক শ্রেণীরই নয়, মানবজাতির শত্রু হিসেবে
পুঁজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদীরা মানবজাতির অস্তিত্বই বিলুপ্ত করবে। মুনাফার মালা গলায় ঝুলিয়ে যে ডালে তারা বসে আছে, সেই ডাল কেটে ফেলে তারা নিজেদের সর্বনাশ করবে।
১২.০১.২০১০
===========================
গল্পালোচনা- 'স্বাধীনতাটাকে খুঁজছি' by লে. জেনারেল মাহবুবুর রহমান  আলোচনা- 'টেলিভিশন কি পত্রিকার প্রতিদ্বন্দ্বী'  ফিচার- ‘অতল জলের আহ্বান' by রুবাইয়াত মনসুর  ভ্রমণ- 'গৌড়ের পথে পথে' by মৃত্যুঞ্জয় রায়  রাজনৈতিক আলোচনা- 'সেদিন বঙ্গভবনে কী ঘটেছিল  রাজনৈতিক আলোচনা- 'রাজনীতি পুরনো পথেই' by আবদুল্লাহ আল ফারুক  খবর- ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেনের মহাসড়ক  আলোচনা- 'বাংলাদেশে মিডিয়া ও তার ভবিষ্যৎ' by সাইফুল বারী  প্রবন্ধ- রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেনের 'অবরোধবাসিনী'  ফিচার- ‘হিমশীতল শহরগুলোর দিনরাত' by তামান্না মিনহাজ  গল্পালোচনা- ''সে কহে বিস্তর মিছা যে কহে বিস্তর'  সাক্ষাৎকার- হুমায়ূন আহমেদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ইমদাদুল হক মিলন  ইতিহাস- পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ডাইনোসরের ফসিল 'স্যু' এর কাহিনী  খাদ্য আলোচনা- 'অপুষ্টির প্রধান কারণ দারিদ্র্য ও অজ্ঞতা by শেখ সাবিহা আলম  গল্পালোচনা- 'ডান রাস্তার বামপন্থী' by কাওসার আহমেদ  খবর- 'মারা যাবে না একটি শিশুও' -বিলগেটসপত্নী, মেলিন্ডা গেটস


কালের কণ্ঠ এর সৌজন্যে
লেখকঃ বদরুদ্দীন উমর


এই গল্পালোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.