রাজনৈতিক আলোচনা- 'বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা আর ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধকরণ' by বাঁধন অধিকারী

"The University will not be manufactory of slaves. We want to think truely, we want to teach freedom.... Freedom first, freedom second, freedom always...." ১৮৩৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন বক্তৃতায় এই সোচ্চার উচ্চারণে ব্রিটিশ উপনিবেশের অধীন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রকম্পিত করেছিলেন স্যার আশুতোষ মুখার্জী।

আজ স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশে বসে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা এবং ছাত্ররাজনীতি নিয়ে আলাপ করতে গিয়ে তাঁকে উদ্ধৃত করছি, যখন সারাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়সহ অপরাপর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকারের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। এর আগে বিএনপি-জামায়াত জোটের শাসনামলেও ছাত্রদল আর ছাত্রশিবিরের অত্যাচারে সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো পরিণত হয়েছিল রাজনৈতিক ক্ষমতাসীনদের অত্যাচারের প্রদর্শনভূমিতে। সমাধানের পথ হিসেবে অনেকেই ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধকরণকে একমাত্র পথ হিসেবে দেখতেন তখনও, এখনও দেখছেন।
কিন্তু সেই রাস্তায় হাঁটতে গেলে কিছু বিপদ, কিছু ভীতি তাড়া করে। তাতে না আবার শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের স্বাধীন তৎপরতা বন্ধ হয়ে যায়!
ধারণাগতভাবেই বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে বিশ্বজনীন জ্ঞান সৃজন ও চর্চার জমিন। মনুষ্য-জীবনের চূড়ান্ত উৎকর্ষ সাধন কিংবা মুক্ত মানুষের মুক্ত সমাজ গড়ার জন্য জ্ঞান উৎপাদন ও তার চর্চা সমাজে প্রবহমান রাখার উদ্দেশ্য বিশ্ববিদ্যালয় ধারণার অংশ। কিন্তু সৃজনের পূর্বশর্ত হলো স্বাধীনতা। তাই স্বাধীনতাই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণভোমরা। জ্ঞানের স্বাধীন ধারা সমাজে প্রবহমান রাখা এবং সমাজ-সভ্যতার বিকাশে সেই জ্ঞানকে কাজে খাটিয়ে ক্রমাগত প্রগতির পথে অগ্রসর হওয়াটা সম্ভব নয়, যদি না জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্র স্বাধীন হয়। পরাধীনতা মানে স্থিতি। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার দ্বারা কিংবা অন্য কোনো ক্ষমতার দ্বারা যদি শিক্ষা নিয়ন্ত্রিত হয়, তাহলে সেই শিক্ষার পক্ষে ওই ক্ষমতার উদ্দেশ্যকে ক্রমাগত বৈধতা দান না করে উপায় থাকে না। সমাজটা তখন স্থিতিশীল হয়ে পড়ে। অগ্রগতি কিংবা প্রগতি ব্যাহত হয়। জ্ঞানচর্চার ইতিহাসটা যেমন কর্তৃত্বের সঙ্গে আপসের ইতিহাস, ঠিক একইভাবে আবার ক্ষমতাশক্তির সঙ্গে চর্চাকারীর দ্বন্দ্বের ইতিহাসও বটে। সক্রেটিস সাক্ষী। ব্রুনো সাক্ষী। সাক্ষী মানছি গ্যালিলিওকে। নতুন জ্ঞান সবসময় সমাজের পুরনো কাঠামোতে প্রয়োগ করা যায় না, তাকে কাজে খাটানোর জন্য নতুন সমাজের দরকার পড়ে। 'সূর্য না, পৃথিবীই ঘোরে'_ এই সত্য আবিষ্কারের ফলে চার্চের ক্ষমতায় ঘা লাগে। যাজকের কর্তৃত্বের ভিত্তি নড়ে যায়। সুতরাং এই সত্য যাজকের কর্তৃত্বকে অস্বীকারের মধ্য দিয়ে নতুন সমাজ দাবি করে বসে। ওই সমাজ এটা তাই মানতে চায় না। আধুনিক সমাজেরও একই ঘটনা। যুদ্ধবাজ রাষ্ট্রনায়কের খুব সমস্যা হয়, যদি জ্ঞানের অনুশীলন আর চর্চার মাঝ দিয়ে এই সত্য আবিষ্কৃত হয়ে যায়, যুদ্ধের উদ্দেশ্য হলো দুনিয়াজোড়া অস্ত্র বিক্রির মাধ্যমে নিজের দেশের ভঙ্গুর অর্থনীতিকে চাঙ্গা করা আর বিশ্বজুড়ে নিজের সামরিক আধিপত্যকে দৃঢ় করা, যেন আর্থিক-সামাজিক নীতিতে সেই দেশগুলোকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করা যায়। ক্ষমতাশক্তি যদি নিয়ন্ত্রণ করত পুরো জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রকে তাহলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো মানুষ কি এই সত্য আবিষ্কার করতে পারত? পারত না। পেরেছে কেননা জ্ঞানচর্চার সব ক্ষেত্র সেখানে পরাধীন নয়। ক্ষমতাশক্তির বিপরীতে সত্যিকারের মানবীয় সমাজের পথে এগিয়ে যাওয়ার জন্য জ্ঞানচর্চার স্বাধীন ক্ষেত্র তাই অপরিহার্য। সেই বোধ বাংলাদেশের আপামর জনগোষ্ঠী ধারণ করেছিল অনেক আগেই, ১৯৭১ সালে। বাঙালির গর্ব, বাঙালির অহঙ্কার, বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের যে স্পিরিট, সেই স্পিরিটের কারণেই স্বাধীন বাংলাদেশে আমরা পেয়েছি '৭৩-এর অধ্যাদেশ। যে অধ্যাদেশে স্বীকৃত হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের দাবি। কিন্তু বঙ্গবন্ধুস্বীকৃত এই স্বায়ত্তশাসনের ধারণায় ছিল কিছু ফাঁকফোকর। তিনজনের প্যানেল থেকে রাষ্ট্র ভিসি নিয়োগের কর্তৃত্ব রেখেছিল আচার্য তথা প্রেসিডেন্টের হাতে। প্রেসিডেন্ট দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ পান। তাই যে দল ক্ষমতায় থাকে, ভিসি নিয়োজিত হন সেই দলের লোক। আর বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার অভ্যন্তরীণ ক্রমকর্তৃত্বতান্ত্রিক বিধি মোতাবেক এই ভিসি হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীশ্বর। নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী। সেই ভিসিকে ঘিরেই বিশ্ববিদ্যালয়ে জমে ওঠে দলীয় রাজনীতি, শিক্ষকদের এবং শিক্ষার্থীদের। আর এভাবেই স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ে অক্ষুণ্ন থাকে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব। বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ বন্ধ করার একটা প্রধানতম জায়গা তাই এই দলীয় লেজুড়বৃত্তির রাজনীতিকে প্রতিহত করা। স্বায়ত্তশাসনকে যথার্থ অর্থে কার্যকর করা। কিন্তু এর মানে নিষিদ্ধকরণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা নয়। ভাষা আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান কিংবা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ছাত্রদের অগ্রগণ্য ভূমিকায় সমৃদ্ধ হয়েছে_আমরা সবাই জানি। ছাত্র রাজনীতি বন্ধের নামে ছাত্রদের স্বাধীন সংগঠন করার সেই অধিকার ক্ষুণ্ন করা হবে না তো_আমাদের শঙ্কা এখানেই। আমরা অস্ত্রবাজি চাই না। আমরা চাই না, তরুণ প্রাণ ঝরে পড়ুক চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি করতে গিয়ে। আমরা স্বাধীন জ্ঞানচর্চার মুক্ত পরিবেশ চাই। রাষ্ট্রকে দেখভাল করার সুযোগ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় যেন বঞ্চিত না হয়, সেটার নিশ্চয়তা চাই। ক্ষমতায় থাকা মানুষগুলো যেন লাগামছাড়া হয়ে না যায়, সেদিকটা খেয়াল রাখতে চাই।
বিএনপি-জামায়াতের দুঃশাসন-অপশাসন পার করে ১১ জানুয়ারি জরুরি অবস্থা জারি হওয়ার পর হঠাৎ করে থমকে যাওয়া এই জনপদের মানুষগুলো যখন দ্রব্যমূল্য, বিচারবহিভর্ূত হত্যাকাণ্ড, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অভাবে দিশেহারা, তখন প্রথমবারের মতো নাড়া দিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা, ২০০৭ সালের আগস্ট মাসে। জরুরি অবস্থার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে সেই প্রথম বড় পরিসরে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছিল সেনাসদস্য কর্তৃক শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনার উছিলায় এবং পরে শিক্ষার্থীদের সেই তৎপরতার পিঠে শামিল হয়েই জাগ্রত হয়েছিল এই জনপদের মানুষেরা। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন শেষে অন্তত ভোটের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পেয়েছে যার পটভূমিতে।
কেউ কেউ বলেন, ছাত্ররাজনীতি বন্ধ হোক কিন্তু ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের অধিকার আদায়ের জন্য সোচ্চার থাকবে, তেমন ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে। তাহলে কি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে রাষ্ট্রযন্ত্র দমন-পীড়ন চালালে বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন রচনা করতে পারবে না শিক্ষার্থীরা? সেটা মোটেই আমাদের কাম্য নয়। বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বজনীন জ্ঞানচর্চার প্রতিষ্ঠান, সমাজের সব থেকে অগ্রসর চিন্তার জায়গা। গরিব কৃষক-শ্রমিকের করের টাকায় এখানে শিক্ষার্থীরা পড়ালেখা করে। রাষ্ট্র সেই করপ্রদানকারী মানুষদের ওপর অত্যাচার চালালে বিশ্ববিদ্যালয় যদি প্রতিবাদ রচনা না করে, তাহলে ইতিহাস তাকে বেইমান আখ্যা দেবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা রাষ্ট্রের ভালো-মন্দের দেখভাল না করলে কারা সেটা করবে? তাই রাজনীতি বন্ধের নামে শিক্ষার্থীদের স্বাধীন তৎপরতা এবং সংগঠন করার অধিকার বন্ধের চেষ্টা হলে সেটা মঙ্গলকর কিছু হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়কে আমরা রাষ্ট্র-রাজনীতি-বাজারের হস্তক্ষেপমুক্ত স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। সেখানে ছাত্র রাজনীতি-শিক্ষক রাজনীতির নামে রাষ্ট্রের যাবতীয় হস্তক্ষেপ থেকে মুক্তি চাই। কিন্তু দেশের প্রতিটি ভালো-মন্দকে দেখভাল করার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র রচনা করতে গেলে, ছাত্র রাজনীতি বন্ধের নামে রাজনৈতিক সচেতনতা বন্ধ করা; আরো নির্দিষ্ট করে বললে, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের স্বাধীন সংগঠনের বিকাশ রুদ্ধ করার চেষ্টা করে বিশ্ববিদ্যালয়কে ভোঁতা একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার চেষ্টা করা হলে সেই প্রচেষ্টা প্রগতির পথ রুদ্ধই করতে পারে শুধু। তাই বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কার কিংবা ছাত্র রাজনীতি নিয়ে ভাবনা-চিন্তা-সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের স্বাধীন জ্ঞানচর্চা এবং স্বাধীন সংগঠনের প্রশ্নটা যেন আড়ালে না থাকে!
============================
নিবন্ধ- 'আইলা, কৃষি এবং কোপেনহেগেন প্রাপ্তি'  গল্পিতিহাস- 'এত যে সফলতা, তবুও বিফলতা' by সনৎ কুমার সাহা  আলোচনা- 'মুনাফার মালা গলায় ঝুলিয়ে পুঁজিবাদীরা মানবজাতি ধবংসের ব্যবস্থা করছে by বদরুদ্দীন উমর  গল্পালোচনা- 'স্বাধীনতাটাকে খুঁজছি' by লে. জেনারেল মাহবুবুর রহমান  আলোচনা- 'টেলিভিশন কি পত্রিকার প্রতিদ্বন্দ্বী'  ফিচার- ‘অতল জলের আহ্বান' by রুবাইয়াত মনসুর  ভ্রমণ- 'গৌড়ের পথে পথে' by মৃত্যুঞ্জয় রায়  রাজনৈতিক আলোচনা- 'সেদিন বঙ্গভবনে কী ঘটেছিল  রাজনৈতিক আলোচনা- 'রাজনীতি পুরনো পথেই' by আবদুল্লাহ আল ফারুক  খবর- ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেনের মহাসড়ক  আলোচনা- 'বাংলাদেশে মিডিয়া ও তার ভবিষ্যৎ' by সাইফুল বারী  প্রবন্ধ- রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেনের 'অবরোধবাসিনী'  ফিচার- ‘হিমশীতল শহরগুলোর দিনরাত' by তামান্না মিনহাজ  গল্পালোচনা- ''সে কহে বিস্তর মিছা যে কহে বিস্তর'  সাক্ষাৎকার- হুমায়ূন আহমেদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ইমদাদুল হক মিলন 


কালের কণ্ঠ এর সৌজন্যে
লেখকঃ বাঁধন অধিকারী


এই রাজনৈতিক আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.