গল্প- 'রুখসানার হাসব্যান্ড' by মাহবুব মোর্শেদ

রুখসানার হাসব্যান্ড একটা অপদার্থ, গুড ফর নাথিং। সারাদিন বইসা বইসা ঘোড়ার ঘাস কাটে। ঘোড়া হইলো দুনিয়ার এক আজীব প্রাণী। এই প্রাণী কাটা ঘাস খায় না, একেবারে জীবন্ত দণ্ডায়মান ঘাস নিজ মুখে খায়াই নাকি ঘোড়ার সুখ। রুখসানার হাসব্যান্ড কোন দুনিয়ার ঘোড়ার জন্য বইসা বইসা ঘাস কাটে এই বুঝা বড় কঠিন। অন্য কেউ তো দূরের কথা স্বয়ং রুখসানা পারভীনও বুইঝা উঠতে পারে না তার অকর্মা স্বামী করেটা কী? মানে দিনটা সে কেমনে কাটায়।


একদিন বিকাল পাঁচটায় অফিস থেকে ফিরে রুখসানা দেখে নতুন এক আবিষ্কারের নেশায় তাঁর হাসব্যান্ড একেবারে উত্তেজিত হয়ে আছে। অবস্থা দেখে রুখসানা জিগায়, সমস্যা কী? রুখসানার হাসব্যান্ড বলে আজকে একটা অদ্ভুত বিষয় খেয়াল করলাম। বলেন শুনি, বলে রুখসানা তার স্বামীর দিকে না তাকায়া কাঁধের ব্যাগটা টেবিলের গুছিয়ে রাখতে থাকে। লোকটা অদ্ভুত, সারাদিন বাসায় বইসা থাকলেও কখনো নিদেনপক্ষে এই টেবিলটা গোছানোর কথাও তার মাথায় আসে না। হাসব্যান্ড নিজের মতো করে বলতে থাকে, তুমি ঘোড়া প্রাণীটা ভাল কইরা খেয়াল কইরা দেখছো নিকি কুনোদিন? রুখসানা বলে, প্রাণীটার জন্য দিনমান ঘাস তো কাটেন আপনে। আমি খেয়াল কইরা কী করবো? হাসব্যান্ড একটু লাজুক হাসে। কয়, দেখছো কি না সেইটা কও। রুখসানা কিছু কয় না। তোয়ালা নিয়া বাথরুমে চলে যায়। হাতমুখ ধুয়ে তোয়ালা দিয়া অনেক্ষণ ধরে মুখ মুছে বারান্দায় আবার তোয়ালেটা ঝুলায়ে সোজা রান্না ঘরে গিয়া চায়ের পানি চাপায়া আসে। পানি চাপায়া হাসব্যান্ডের সামনে এসে দাঁড়ায়। বলে, নিজে থেকে এক কাপ চা-ও তো করে খান না? হাত ব্যথা করে? হাসব্যান্ড তখন ঘোড়া সম্পর্কে নতুন একটা আবিষ্কারের আনন্দে বিভোর। রুখসানার খোঁটা তার গায়ে লাগে না। আবিষ্কারের আনন্দে বিভোর না হইলেই যে তার গায়ে কথাটা গিয়া কাঁটার মতো বিঁধতো সেরকমও না ঘটনা। এমনিতেই রুখসানার কোনো কথা তার গায়ে লাগে না। অফিসফিরত রুখসানা মিষ্টি মিষ্টি খোঁটাগুলা দিতে থাকলে হ্যাসব্যান্ড তার নোকিয়া ১১০০ সেটটা হাতে নিয়া স্নেক গেম খেলা শুরু করে। একটা লতানো রেখাকে একটা বিন্দুর দিকে নিয়া যাওয়ার জন্য তীব্র আকুতি নিয়া বাটনগুলা চাপতে থাকে। এইবার গেমের ফোর্থ লেবেল পর্যন্ত পৌঁছাইতেই হবে যে কইরাই হউক, এই ভাবনায় তার সমস্ত মন মোবাইলের স্ক্রিনে গিয়া স্থির হয়া থাকে। স্নেক গেম খেলতে খেলতে দেখা যায়, রুখসানার এনে দেয়া চা ঠাণ্ডা হয়া আসে। রুখসানা বলে, চা খাওয়ারও তো দেখি সময় নাই আপনের। হাসব্যান্ড ছোট করে উত্তর দেয়, ঠাণ্ডাই ভাল। তুমি জানো না, ঠাণ্ডা চা ভাল পাই আমি? তারপর আবার স্নেক গেমের দ্রুততর থার্ড লেবেলটা খেলতে থাকে। একটু এদিক-ওদিক হইলেই সর্বনাশ। খেল খতম। রুখসানা চা নিয়া আসলে আজকে গরম থাকতেই খাইতে শুরু করে। বলে, এনিমেল চ্যানেলটা দেখছো কুনোদিন? রুখসানা নরমালি টিভির চ্যানেল বদলায়ে তেত্রিশের পরে যায় না। এনিমেল চ্যানেল মনে হয় ছেচল্লিশে। কয়, ক্যান কী হইছে? সে বুঝতে পারে, তার হাসব্যান্ড সারাদিন হিন্দি বাংলা চ্যানেল দেখে বিরক্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত এনিমেল চ্যানেল দেইখা সময় কাটায়। হবে আবার কী? আজকে চ্যানেল ঘুরাইতে ঘুরাইতে হঠাৎ এনিমেল চ্যানেলে আইসা দেখি ঘোড়ার উপরে একটা অনুষ্ঠান দেখাইতেছে। অনেকক্ষণ ধইরা একপাল ঘোড়ারে ঘুরায়ে ফিরায়ে দেখাইতেছে। বুঝলা? হাসব্যান্ডের কথার উত্তর না করে রুখসানা আনমনে চা খাইতে থাকে। ঘোড়া দেখতে দেখতে হঠাৎ আমার মনে হইলো, ঘোড়ার পিছন দিকটা মেয়েমানুষের মতো। আর সামনের দিকটা ছেলেদের মতো। হাসব্যান্ডের কথা ঠিক বুঝে উঠতে পারে না রুখসানা। হাসব্যান্ড তখন তারে ডিটেইলে বুঝাইতে থাকে। হাসব্যান্ডের ডিটেইলিং শুনতে শুনতে রুখসানা এক্সাইটেড হয়া উঠে। বুঝতে পারে, অনুষ্ঠানটা দেখার পর থেকে হাসব্যান্ড তার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেছে। রুখসানা তার বদমতলব টের পেয়ে ঘরের একদিকে ছুটে যায়। হাসব্যান্ড সেইদিকে আগাইতে থাকলে রুখসানা বলে, খবরদার, ভাল হবে না কিন্তু। সারাদিন ঘোড়ার ঘাস কাটো আর এইগুলা ভাবো তাই না? খবরদার। ছাড়ো, ভাল হবে না কিন্তু। এইগুলা কী? তোমার কাজ কাম নাই কিছু?

রুখসানা পারভীন সন্ধ্যাবেলা ভাত উঠায়, রাতের খাবারের আয়োজন করে, সকালে অফিস যাওয়ার জন্য তড়িঘড়ি করে, অফিসে বইসা হেড অফিসের জন্য উইকলি রিপোর্ট লেখে আর তার হাসব্যান্ডের অবাক আবিষ্কারের কথা ভাবে আর হাসে। অফিস করতে করতে হাসব্যান্ডের জন্য তার মনটা ধক কইরা উঠে। তখন হয়তো হাসব্যান্ড নোকিয়া ১১০০ মডেলের হ্যান্ডসেটে স্নেক গেম খেলতেছে অথবা টিভিতে সাপের ওপর একটা অনুষ্ঠান দেখতেছে। গান-বাজনা দেখতে দেখতে কান পঁইচা গেছে। রুখসানা ভাবে, তার অকর্মা, গুড ফর নাথিং হাসব্যান্ডের জন্য একটা ভিসিডি প্লেয়ার কিনে দিবে। সারাদিন ভালমন্দ সিনেমা দেখলেও তো হয়। চ্যালেন ঘুরায়া ঘুরায়া আর কত? আবার কখনো মনে হয়, হাসব্যান্ডকে সে আগে একটা ভাল নোকিয়া সেট কিনে দিবে। কারণ ১১০০ মডেলের হ্যান্ডসেটে গেম কম। এক স্নেক গেম খেলতে খেলতে এমন স্কোর করছে যে পুরা বাংলাদেশে মনে হয় কেউ তার ধারেকাছে নাই। গেম শেষ হইলে হাসব্যান্ড তারে স্কোর দেখাইতে আসে। গর্বে রুখসানার মনটা ভইরা ওঠে। কিন্তু কার সাথে এইগুলা শেয়ার করবে? কাউরে সে এইটা কইতে পারে না। কইতে পারে না যে স্নেক গেমে পুরা বাংলাদেশে কি পুরা দক্ষিণ এশিয়ায় তার হাসব্যান্ড সবচেয়ে বেশি স্কোর করছে। এই যেমন ঘোড়ার আবিষ্কারটা সম্পর্কেও কাউরে কিছু কইতে পারতেছে না। কাউরে হাসব্যান্ডের রেফারেন্স দিয়া কিছু কইতে গেলেই বলবে, ভাই কি এখনও বেকার? কিছু করে না? সময় কেমনে কাটায়? রুখসানার গুড ফর নাথিং হাসব্যান্ডকে নিয়া মানুষজনের চিন্তাভাবনার অন্ত নাই। লোকে ভাবতে পারে না, এইরকম একটা অপদার্থরে রুখসানা কেন বইসা বইসা খাওয়ায়। সবচেয়ে বিপদ হয় বাপের বাড়ির কেউ ফোন করলে। রুখসানা ফোনের রিংটোন বাজতে থাকলেই ঘামা শুরু করে দেয়। সেদিন বড়ভাইজান ফোন করছে রাত আটটায়। বাপের বাড়ির লোকের দৃঢ় বিশ্বাস রুখসানা অসুখী। ফোন করেই প্রথমে তারা তার অপদার্থ স্বামীরে শাপশাপান্ত করে। বলে, ওইটা আশপাশে আছে নাকি? রুখসানা এসব ক্ষেত্রে মিথ্যা বলে। বলে, ভাইজান ও একটু বাজারে গেছে। বলিস কী, গাধাটা ইদানিং বাজারেও যায় নাকি, অনেক উন্নতি হইছে তো। রুখসানা বলে, কাজের চেষ্টা তো করতেছে ভাইজান। এখন কাজ পাওয়া কি অতো সহজ, বলেন? চাইলেই তো আর কাজ পাওয়া যায় না। মাস্টার্স করা ছেলে তো আর যেখানে সেখানে জয়েনও করতে পারে না। দুই-তিনটা অফার তো ফিরায়ে দিলো। এইসব খুঁটিনাটি নানা বিষয় বুঝায়া ফোন রাখতে গিয়া রুখসানা দেখে হাসব্যান্ড কাছে আইসা বোকা বোকা হাসি দিতেছে। রুখসানাও হো হো করে হেসে ওঠে। বলে, যান গা। কাম আছে। এখন আপনে পুরানা স্নেকটাই আবার খেলেন। হাসব্যান্ড কোনো কথা শুনে না। বোকা বোকা হাসে আর রুখসানার কাছাকাছি ঘেঁষার প্রাণপন চেষ্টা করে। রুসখান বলে, আপনে মানুষটা কী? কন তো। এইগুলা কী?

রুখসানার হাসব্যান্ড যে সারাদিন ঘরে বইসা কাটায়, টিভি দেখে আর মোবাইলে গেম খেলে তা না। মাঝে মাঝে দুপুর বেলা ঘরের বাইরে যায়। আলো-বাতাস গায়ে লাগায়ে আবার ফিরত আসে। মেইন রোডের ধারে কোনো ছায়া ছায়া জায়গায় ঘণ্টাখানেক দাঁড়ায়ে থেকে আবার ঘরে আসে। ঘরের বাইরে বাইর হইলে তার গায়ে আলো বাতাসের গন্ধ পাওয়া যায়। রুখসানা বুঝতে পারে, চোখ নাচায়া কয়, ঘটনা কী? বাইরে গেছিলেন নাকি? হাসব্যান্ড বলে, হ। কেমনে বুঝলা? আজকে এক আজীব জিনিশ দেখলাম রাস্তায় যাইতে যাইতে। বাইছা বাইছা আজীব জিনিশগুলা যে কেন আপনের চোখের সামনে ঘটে বুঝি না। ক্যান কী হইছে? হাসব্যান্ড হাসে, কয়, এক ছেলে আর মেয়ে রিকশায় করে যাইতেছিল। রুখসানা কয়, তো কী? প্রেম করতেছিল না চুমা খাইতেছিল? খালি চুমা? আমি তো দেইখা থেকে তোমারে বলবো বইলা বইসা আছি। একবার ভাবলাম ফোন দেই। পরে ভাবলাম ঘরে আসো তারপর বলি। কী দেখলাম জানো, একজনের কোলের ওপরে আরেকজন উইঠা বসছে? এরকম ঘটনা আমি জšে§ও দেখি নাই। ওইটুক জায়গার মধ্যে কেমনে যে কোলে উঠাইলো এইটাই ভাবতেছি আমি। রুখসানা কয়, মিছা কথা। তুমি বানায়া কইতেছো। হাসব্যান্ড কয়, বানায়া কইতেছি না কি, আসো তোমারে দেখাই কেমনে বইসা ছিল। আসো। রুখসানা কয়, এই না না। দেখানো লাগবে না। আজীব, কী করেন? রিকশার মধ্যে এমনে কেউ বসতে পারে? কী আজগুবি কথাবার্তা কন আপনে। আর এই ঘটনাগুলাই যে ক্যান আপনের সামনে ঘটে বুঝি না। আমি যে রাস্তাঘাটে এত ঘুরি। কই, আমার চোখে তো এইগুলা কোনোদিন পড়ে না। আমি তো আপনার থেকে বেশি রাস্তাঘাটে ঘুরি, নাকি? হাসব্যান্ড বলে, তোমরা কি আর রাস্তা দেখতে দেখতে যাও নাকি। মাথায় কাজ নিয়া দৌড়াইতে থাকো। কোথায় কী ঘটতেছে সেইদিকে তোমাদের খেয়াল থাকে নাকি? রুখসানা কয়, হ। আপনের মাথা। আপনেরে কইছে।

একেকদিন আবার রুখসানার হাসব্যান্ড মোড়ের ফ্লেক্সিলোডের দোকান থেকে একটা নাম্বার কিনে আনে। ফোনে টাকা ভরাইতে আসা মেয়েদের নাম্বার আলাদা করে চিহ্ন দিয়া রাখে দোকানদার। রুখসানার হাসব্যান্ড দোকানদারের হাতে বিশটাকা দিলে দোকানদার গোপনে তারে একটা নাম্বার দেয়।

ঠিক আছে তো? মেয়ে তো?

আরে ভাই ১০০% শিউর।

বয়স কেমন?

১৬।

কম হয়া গেল না?

কম কইলাম। বয়স তো এক দেখায় বুঝা যায় না। ২২/২৩ ও হইতে পারে।

দেখতে কেমন?

হালকা শ্যাম।

বডি স্ট্রাকচার?

ভাল। ইন্ডিয়ান নায়িকা ভূমিকা চাওলারে দেখছেন?

ওইরকম? তাইলে তো ভালই।

আচ্ছা আসি তাইলে।

বাসায় ফেরার পথে রুখসানার হাসব্যান্ড একটা ভিডিও দোকানে ভূমিকা চাওলা অভিনীত সিনেমার খোঁজ করে। সিডির ওপর ভূমিকা চাওলার ছবি দেখে বাসায় ফেরে। টিভি না দেখে বা গেম না খেলে আজকে ভূমিকা চাওলার সঙ্গে মিসকল মিসকল খেলা শুরু করে। প্রথমে একটা মিসকল দিলে ভূমিকা ব্যাক করে। রুখসানার হাসব্যান্ড ফোনটা ধরে, কিন্তু কোনো কথা বলে না। ভূমিকা ছেলে না মেয়ে, বয়স কেমন হইতে পারে, গলার স্বর কেমন, ভদ্রঘরের মেয়ে কি না–এইগুলা দুই-চারবারের ‘হ্যালো হ্যালো‘, ‘কে বলছেন’ এইসব শুনে বুঝার চেষ্টা করে। তারপর ফোন কাইটা দেয়। আধা ঘণ্টা পর আবার মিসকল দেয়। তারপর পনেরো মিনিট পর আবার মিসকল দেয়। ভূমিকা হয়তো এই মিসকলগুলারে ইগনোর করে। অথবা তার কোনো বন্ধু মজা করতেছে ভেবে একবার পাল্টা মিসকল দেয়। রুখসানার হাসব্যান্ডের মনটা চনমন করে ওঠে। পরপর কয়টা মিসকল দিতে গিয়া হয়তো একটা মিসকল ভূমিকা খেয়ে ফেলে। এইভাবে বিকাল হয়ে রুখসানার ফেরার সময় হলে আবার স্নেক খেলা শুরু করে। রুখসানা ফিরলে গেমটা রেখে বলে, বুঝলা, একটা মেয়ে ফোনে খুব ডিস্টার্ব করা শুরু করছে। রুখসানা চোখ কুঁচকে জিগায়, কী চায়? হাসব্যান্ড বলে, কী চায় বুঝো না? বলে, আপনের সাথে কথা কইতে ভাল লাগে। আসেন কথা বলি। আমি কী বলবো? আমি কইলাম, আপা আমার বউ আছে। আর বউটা যথেষ্ট সুন্দরী। বলিউডের নায়িকা ভূমিকা চাওলারে দেখছেন? ভূমিকার মতো সুন্দরী বউ রাইখা কি কারো অন্য মেয়েদের সাথে কথা কইতে ভাল লাগে? রুখসানা বলে, আপনে যে এমন মিথ্যাবাদী! মিছা কথাগুলা সারাদিন বইসা বইসা বানান তাই না? আর সত্য কথার মতো কইরা কইতে থাকেন? হাসব্যান্ড বলে, কী যে কও। ফোনটা নিয়া আসো। তোমারে নাম্বারটা দেখাই। চাইলে তুমিও ফোন দিয়া কথা বলতে পারো। রুখসানা বলে, আমার লাগবে না। যান বিশ্বাস করছি। যান গিয়া, বইসা টিভি দেখেন। যান, ছাড়েন।

বাইরে থেকে কেউই বুঝতে পারে না রুখসানা কেন তার এই অকর্মা, বেকার আর প্রায় বিকৃত রুচির হাসব্যান্ডকে বসায়ে বসায়ে খাওয়ায়। রুখসানাও ঠিকঠাক মতো বুইঝা উঠতে পারে না। তাই কেউ কথা উঠাইলে তারও খুব জানতে ইচ্ছা করে যে, অন্যের বিবাহিত জীবনটা আসলেই কেমন। শায়লা, শ্রাবণী, লতা, রাবেয়া তার সমবয়সী কলিগ। তাদের সঙ্গে রুখসানা অফিসের ফাঁকে ফাঁকে কান কথা বলে। তাদের প্রত্যেকের গল্পই হরেদরে এক। রুখসানা জিগায়, আপা কেমন চলে? তারা বলে, বিয়ে তো করছেন মাত্র পাঁচ বছর। সাত-আট বছর যাক। দেখবেন। সাত-আট বছর গেলে হাসব্যান্ড ওয়াইফ ভাই-বোনের মতো হয়ে যায়। বুঝলেন আপা, সংসার-বাচ্চাকাচ্চার চাপে আর কিছু থাকে না। আর যদি দুই জনে চাকরি করেন তাইলে তো দেখা-সাক্ষাৎ হইতে হইতেও শুক্রবার হয়ে যায়। বাজার-সদাই, রান্নাবাড়া করতে করতে আর কিছু মনে আসে না।

শায়লা একদিন নিভৃতে জিগায় আপনের কী খবর? রুখসানা কিছু বলে না। খালি হাসে। শায়লা, শ্রাবণী বা রাবেয়া বলে, আপা আপনি পেটের কথা পেটে যে কেমনে রাখেন বুঝি না। আমরা যেমনে শেয়ার করি তেমন করে শেয়ার করলেও তো হালকা লাগে। রুখসানা কিছু বলে না। যে যে যার যার মতো কইরা রুখসানার বিবাহিত জীবন সম্পর্কে ভেবে নেয়। কেউ ভাবে, হয়তো স্বামী-স্ত্রীর ভাইবোন সম্পর্কে পৌঁছানোর মতো অবস্থায় রুখসানা এখনও পৌঁছায় নাই। হয়তো, অন্যসব ক্ষেত্রের মতো রুখসানার অকর্মা স্বামী দাম্পত্য জীবনেও কোনো অবদান রাখতে পারতেছে না। রুখসানা তাদের এই চিন্তার মোড় ফেরানোর জন্য কোনো উদ্যোগ নেয় না।

বাসায় ফিরে হাসব্যান্ডকে বলার মতো কিছু গল্প তৈরি হয় রুখসানার। এই শুনেন, আপনারে একটা গল্প কই। কাউরে কইতে পারবেন না। হাসব্যান্ড বলে, আমি কি কারো সাথে মিশি নাকি? কারে বলবো? রুখসানা বলে, তারপরও কাউরে যদি কন। না থাক, আরেকদিন বলবো। তো, রুখসানা আর বলে না। খালি ঘুরায়। আর হাসব্যান্ড গল্পটা শুনার জন্য তড়পাইতে থাকে। সারাক্ষণ পিছ পিছ ঘুরে। বলে, বলো না। বলো। তো রুখসানা বলে, শুনেন শায়লারে চিনছেন না? কোন শায়লা। ওই যে আমার কলিগ। কোন কলিগ। দেখতে কেমন বলো দেখি। তখন রুখসানা সুন্দরী শায়লার রূপ আর পোশাক আশাকের বর্ণনা দিয়া হাসব্যান্ডের সামনে তার একটা চেহারা হাজির করে। হাসব্যান্ড বলে, খুব সেক্সি তো তোমার এই কলিগটা। তার আবার কী হইলো? রুখসানা কয়, সেক্সি? কী যে কন। আপনের কাছে দুনিয়ার সব মেয়েই মনে হয় সেক্সি। ধরেন সেক্সিই হইলো। কিন্তু তার হাসব্যান্ড তার ওপর কোনো আকর্ষণ পায় না। সেক্সি হয়া কোনো লাভ আছে?

কতদিন?

একবছর। কেমনে যে থাকে?

শায়লার গল্প শুনে রুখসানার হাসব্যান্ড একটু বিষণ্ন হয়া উঠে। খানিকক্ষণ চিন্তা করে। তারপর মোবাইলে স্নেক গেম খেলে। সে শায়লারে কোনোদিন দেখে নাই। অফিসের সামাজিক অনুষ্ঠানে নরমালি স্বামীরে নিয়া যায় না রুখসানা। ওনারে দেখলে সবার একটাই কথা, ভাই কোথায় আছেন? কী করেন? এইসব নিয়া হাসব্যান্ডের চাইতে বেশি অস্বস্তিতে থাকে রুখসানা। তাই এইসব এড়ায়ে চলে। তো শায়লারে না দেখলেও রুখসানার বর্ণনা মোতাবেক হাসব্যান্ড তার একটা চেহারা এঁকে ফেলে মনে মনে। খুঁটিনাটি জিগায় বউরে। বলে, শায়লার চুল কেমন? রুখসানা বলে, লম্বা। একেবারে হাঁটু পর্যন্ত। চুলের জন্য সবাই তার দিওয়ানা। হাসব্যান্ড বলে, তাইলে তো সব মিলায়া খুবই সেক্সি মহিলা। কী বলো?

রুখসানা হাসে। বলে, শায়লার কথা চিন্তা করতে করতে তো দেখি আপনের ঘুম হারাম হয়া যাবে। আপনে যে কী না? আমি বুঝি না। হাসব্যান্ড বলে, আমি কী? কও। মুখ ফুটে কও। কও না। কয়ে ফেলো।

রুখসানা একটা রহস্যময় হাসি দেয়। দাঁড়ান শায়লারে একদিন দাওয়াত দিবো নে। রাতে খাইতে বলি একদিন। কী বলেন?

হাসব্যান্ড বলে, তাই নাকি? তাইলে তো খুবই ভাল হয়।

কী ভাল হয়?

খুবই ভাল হয়। বলে রুখসানাকে কাছে টেনে নেয় হাসব্যান্ড।

রাতে আবার হাসব্যান্ড খুব বিষণ্ন হয়া পড়লে রুখসানা বলে, আবার কী হইলো আপনের? ভাবতেছি, আপনারে একটা নতুন নকিয়া কিনে দিবো। ক্যামেরাঅলা।

হাসব্যান্ড কয়, সেট দেওয়া লাগবে না। আমারে একলাখ টাকা ম্যানেজ কইরা দেও।

হায় হায়, এক লাখ দিয়া কী করবেন?

ভাবতেছি একটা ফ্লেক্সিলোডের দোকান দিবো। সবার হাসব্যান্ড তো কিছু না কিছু করে, কিন্তু আমি তো কিছু করি না। এইটা নিয়া তুমি লজ্জার মধ্যে থাকো। সমাজে তোমার দুর্নাম হয়। আমি একটা কিছু করলে তুমি মানুষরে কইতে পারবা? এইরকম থাকা কি ভাল দেখায়?

রুখসানা আগেও হাসব্যান্ডের এইরকম কথা শুনছে। কিন্তু বইলাই সে ভুলে যায়। হাড়ে মাংসে অকর্মা তো। বেশিক্ষণ কামের কথা মনে থাকে না। রুখসানা তাই এক কান দিয়ে শুনে আরেক কান দিয়া বাইর কইরা দেয়। তারপর ঘুমায়া পড়ে। আজ একটু সিরিয়াস হয়ে যায় রুখসানা। বলে, আমি আপনারে দোকান দিতে কইছি? মাস্টার্স পাশ কইরা আপনে ফ্লেক্সিলোডের দোকান দিবেন? আমি কি চাকরি করতেছি না। আমি যদি বেকার থাকতাম তাইলে একটা কথা ছিল। সংসারে কয়জনরে কাজ করা লাগে?

হাসব্যান্ড রুখসানার কথা শুনে অবাক হয়ে যায়।

বলে, সমাজ বইলা একট ব্যাপার আছে না?

রুখসানা বলে, কীসের সমাজ? আপনেরে কাজ করতে হবে না। আপনে যে কাজ করতেছেন সেই কাজই ভাল মতো করেন। কালকেই আপনেরে নতুন একটা নোকিয়া কিনে দিবো নে। স্নেক গেম খেলবেন আপনে। ভাল স্কোর করবেন। পুরা এশিয়ায় সবার চাইতে বেশি স্কোর কইরা আমারে দেখাইবেন। কাজের চিন্তা বাদ। স্নেক গেম নিয়া ভাবেন আপনে।

রুখসানার হাসব্যান্ড একেবারে তাজ্জব হয়া যায়।

কী একটা কইতে যায়। রুখসানা চোখ রাঙায়া ইসসসস বললে কথাটা গপ করে গিলে ফেলে। উনি একটু ভাবে, অকর্মা লোক বইলা বেশি দূর ভাবতে পারে না। শেষে দিশা না পায়া নতুন ক্যামেরা অলা নকিয়া সেট দিয়া রাস্তায় দাঁড়ায়ে কীসের কীসের ছবি তুলে রুখসানাকে দেখাবে সেই চিন্তা করতে করতে ঘুমায়ে পড়ে।
============================
মাহবুব মোর্শেদ
জন্ম
রংপুর ২৯/১/১৯৭৭
mahbubmorshed0@gmail.com

পড়াশুনা
রংপুর, দিনাজপুর, কুষ্টিয়া, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

চাকরি
আজকের কাগজ, সমকাল, যায়যায়দিন, প্রথম আলো; এখন সমকাল পত্রিকায়।

প্রকাশিত বই
ব্যক্তিগত বসন্তদিন (গল্প)। ফেস বাই ফেস (উপন্যাস)।
====================================
গল্প- আলিমের নিভৃতিচর্চা by রাশিদা সুলতানা   গল্প- প্রত্যাবর্তন: আমার ‘ফেরা’ নিয়ে যে কাহিনী না ..মানষ চৌঃ   গল্প- 'বীচিকলায় ঢেকে যায় মুখ ও শিরোনাম' by আনোয়ার ...  গল্প- 'প্রীত পরায়া' by সিউতি সবুর   গল্প- 'চলিতেছে' by মাহবুব মোর্শেদ   গল্প- 'গোপন কথাটি' by উম্মে মুসলিমা   গল্প- 'রূপকথা' by লুনা রুশদী  সঞ্জীব চৌধুরীর কয়েকটি গল্প   গল্প- 'অস্বস্তির সঙ্গে বসবাস' by ফাহমিদুল হক   গল্প- 'মঙ্গামনস্ক শরীরীমুদ্রা' by ইমতিয়ার শামীম   গল্প- 'হাজেরার বাপের দাইক দেনা' by জিয়া হাশান  গল্প- ‘অপঘাতে মৃত্যু’ ও ‘সাদামাটা’ by লীসা গাজী   গল্প- 'দ্বিতীয় জীবন' by ইরাজ আহমেদ  গল্প- 'পুষ্পের মঞ্জিল' by সাগুফতা শারমীন তানিয়া   গল্প- 'একশ ছেচল্লিশ টাকার গল্প' by কৌশিক আহমেদ  গল্প- 'একে আমরা কাকতালীয় বলতে পারি' by মঈনুল আহসান..   গল্প 'গহ্বর' by জাহিদ হায়দার    গল্প- 'পুরির গল্প' by ইমরুল হাসান  গল্প- 'নওমির এক প্রহর' by সাইমুম পারভেজ  গল্প- 'মরিবার হলো তার সাধ' by আহমাদ মোস্তফা কামাল   গল্প- 'নিষুপ্ত শেকড়' by নিরমিন শিমেল   গল্প- 'লাল ব্যাসার্ধ্ব' by শামীমা বিনতে রহমান  গল্প- 'সেদিন বৃষ্টি ছিল' by মৃদুল আহমেদ   ক. কিছুদিন হয় সেই নগরে কোন বৃষ্টি হচ্ছিল না। কিছুদ.. গল্প- 'তুষার-ধবল' by সায়েমা খাতুন  গল্প- 'কোষা' by পাপড়ি রহমান  গল্প- 'কর্কট' by রাশিদা সুলতানা   গল্প- 'তিতা মিঞার জঙ্গনামা' by অদিতি ফাল্গুনী  গল্প- 'সম্পর্ক' by তারিক আল বান্না  গল্প- 'অনেক দিন আগের দিনেরা' by রনি আহম্মেদ  গল্প- 'গাদি' by ইফফাত আরেফীন তন্বী   গল্প- 'কামলাঘাটা' by অবনি অনার্য   গল্প- 'কক্ মানে মোরগ: উদ্ভ্রান্ত মোরগজাতি ও তাহাদে.    গল্প- 'ভরযুবতী ও বেড়াল' by সাগুফতা শারমীন তানিয়া  গল্প- 'অমর প্রেম অথবা আমার প্রেম' by ইমরুল হাসান  গল্প- 'সরল রেখা' by শামীমা বিনতে রহমান



bdnews24 এর সৌজন্যে
লেখকঃ মাহবুব মোর্শেদ


এই গল্পটি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.