গল্প- 'সরল রেখা' by শামীমা বিনতে রহমান

ইসক্রিমটা খাওয়ার পর মনে হলো, মাথায় ছোট ছোট দুইটা চ্যাপ্টা পা দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ আটকে থাকা এক ঝাঁক চড়ুই ঠাস করে উড়া শুরু করলো। তিরু সামনে তাকালো। সামনে মোজাইকের ফ্লোরের ওপর একটা আলোর রম্বস। জানালা কাম ভেন্টিলেটর দিয়ে ঢুকে পড়া এই রম্বসাকৃতির সুরুজ বাতির বিকিরণটা তিরুর অনেক ভাল্লাগে। এই সময়টায়, মানে যখন সে সারাদিন বাসায় থাকে, সেই দিনের দুপুর সাড়ে তিনটার রোদ—তাকে আপ্লুত করে ফেলে। সে মাঝে-মধ্যে ডিভাইডার আর ফতুয়া খুলে সেই রম্বসের মধ্যে শুয়ে থাকে।


আড় কাত হয়ে আর দেখতে আরো ভাল্লাগে তার বুকের পার ঘেঁষে, ক্রমশ নিচের দিকের শরীর, শরীরের কার্ভ লাইনে আলোর খেলা, একেবারে ছোট ছোট লোম জুড়ে আলোর বয়ে চলা। যেন করাতের খাঁজের ওপর দিয়া হেঁটে চলা একটা যুবক। কোথায় প্রথম দেখা হয়েছিল মিতির সাথে? ইয়াপ! মনে পড়ছে। ডিপার্টমেন্টের পিকনিক প্রোগ্রামে মিতি ছিলো কার যেন গেস্ট। ওটা মনে নাই। কিন্তু বাস থেকে নেমে কুমিল্লা বার্ড এর প্রত্নতাত্ত্বিক অলিতে গলিতে ঘোরার সময় সে ফস করে একটা সিগারেট ধরায়। ওর ধরানোর মধ্যে একটা দারুণ ছেলে-ছেলে ব্যাপার ছিল, মানে মেয়েরা এরকম করে না সাধারণতঃ। কিন্তু ছেলেরা সাধারণতঃ যা করে, ও সেটা সেরকম সাধারণতঃ না কিন্তু অভিনবত্ব ফলায়ে করছে। তো মিতিকে ভাল্লাগবে না তো কারে ভাল্লাগবে? তিরু আবার রম্বস-শরীরের দিকে তাকালো। আজকে তার বাসায় থাকবার কথা না, কারণ আজকে তার রাশান কালচারাল সেন্টারে রবী বাবুর রাজা দেখতে যাবার কথা ছিল, সেখানে তওফিকের আসার কথা। নাটক শুরু হবার আগের দুই ঘণ্টা আড্ডা, কিছু চড়ুই চুমু হবার বিস্তর সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু দুপুরের পর থেকেই তার কেমন কেমন, ভাল্লাগেনা-ভাল্লাগেনা-ভাল্লাগেনা ফিলিং হইতেছিল। সে মোবাইল ফোন বন্ধ করে শুয়ে আছে। বাসায় এখন কেউ নাই। আজকে কারোই ডে অফ না। অফিসটা তিরুর দমবন্ধ লাগে। একদমই এনজয় করে না। এত ডিসিপ্লিন, এত মন খারাপ করা ডিপ্লোম্যাসি সহ্য করতে হয়! হাসি না আসলেও হাসতে হবে। বসদের ভালগার ম্যানারে, অধিক বোল্ডনেস দেখানো নারী সহকর্মীর পাশে দাঁড়ায়া তার মতো মেনে নেয়া হাসির সহযাত্রী হতে হয়। এসব কিছুই ভাল্লাগেনা মানতে তিরুর।

তিরুর আসলে কী ভাল্লাগে? এইটা খুব জটিল খুঁজে বের করা। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভাল্লাগেনা শব্দটা শুনতে হয় তার রুমমেট আর বন্ধুদের। পল্লব বলছিল, তুই ভয়ানক নৈরাজ্যবাদী। তুই এনার্কিস্টদের মতো ভয়ানক এক্সট্রিমিস্ট মাঝে-মইদ্যে। স্ট্যাবলিশমেন্টের সাথে এডজাস্ট করা কিন্তু কোয়ালিটি। প্রফেশনে ভালো করতে চাইলে, এইটা তোমারে এডাপ্ট করতেই হবে। না চাইলে অন্য কথা।

আমি তো এডাপ্ট করতে চাই।

না, তুমি চাও না। চাইলে এতো অবজেকশন, এতো পেইন নিতা না। তোমার সাথে দেখা হইলেই কিছুক্ষণ পরই তোমার গলায় চাকরি নিয়া নানা গোলোযোগ শুনতে হয়। লাস্ট ফাইভ ইয়ারস্ ইটস হ্যাপেনিং। অ্যান্ড ভেরি স্যাড টু সে ইটস কন্টিনিউয়িং। তিরু, তুমি সিদ্ধান্ত নাও। তোমার সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় হয়া গেছে কিন্তু।

কী সিদ্ধান্ত?

তুই চাকরি করবি নাকি নিজে নিজে একটা কিছু দাঁড় করানোর চেষ্টা করবি। অর ফ্রিল্যান্স।
ফ্রিল্যান্সেও একই প্রেসার।

না, ওইটায় প্রেসার রেগুলারের চাইতে কম।

* * *

পল্লব মাঝে-মধ্যে তিরুর সাথে গাইড অ্যান্ড ফিলজফার টাইপ আচরণ করে। ইউনিভার্সিটি থেকেই এই প্র্যাক্টিস চালু রাখছে সে। কথা নাই, বার্তা নাই। একদিন হুট করে স্রেফ বন্ধুত্বটাকে টার্ন দিয়া ভারি একটা আচরণের টানেলে চলে যায়। আজিব! রিয়্যালি আজিব এইটা। একটানা বল্লে তিরুর ভার-ভার লাগে, বাট এছাড়া রিক্সার তামাক-সিগারেটের লম্বা জার্নিতে এটা খুব এনজয়িংই মনে হয়।

মিতি সেই যে বার্ডের ভেতরকার প্রত্ন-ইটগুলিতে পিঠ ঠেকায়ে সিগারেট ধরাইছিল, সেটা তার সাথে প্রথম ভালোলাগা বিনিময়। এরপর রাতভর জার্নিতে ক্যাম্পাসে ফিরে এসে পরদিন দুপুরে ঘুম ভেঙে অনেক খুঁজছে তাকে। দেখা হয় নাই। হয়তো সে ঢাকায় চলে গেছিল। হয়তো বা না। ডিপার্টমেন্টে গিয়ে খুঁজলেও হতো। কিন্তু তিরুর ইচ্ছা হয় নাই। তবে স্যোশাল সায়েন্স হয়ে ক্যাফেটেরিয়ার দিকে আগালেই সে একবার না একবার খোঁজার চোখ নিয়ে বাঁয়ে তাকাতো।

মিতি কখনোই জিন্স-ফতুয়া পরে না। অলওয়েজ সালোয়ার-কামিজ। আবার কামিজের নিচে কখনোই সে ব্রা পরবে না। ব্রা পরতে মিতির অস্বস্তি লাগে। মিতি সিগারেট খাবে, কিন্তু গাঁজা খাবে না। আর চুলের সাহস নাই ঘাড় থেকে নিচে নামার। মেয়েদের বিউটি বানানোর পার্লারে মরে গেলেও যাবে না। ছেলেদের পার্লারে চুল কাটবে। তবে চুল কাটার সময় সে একটা সিডেটিভ ট্যাবলেট খেয়ে নেয়। যাতে অস্থির না লাগে। একবার তিরু পল্লবকে খুঁজতে প্রান্তিক গেইটের ভেতর দিয়ে ঢুকে সব হোটেল, স্টেশনারি দোকান খুঁজে লাইনের মাথার দিককার সেলুন দোকানগুলির একটাতে গিয়া দেখে মিতি চোখ বন্ধ করে আছে। আর সেলুন মামা চুল কেটে দিতেছে। তিরু জিজ্ঞেস করলো, মামা কী ছাট?

মামা জবাব দেয়, বাটি ছাঁট।

মামা আমারেও এই ছাঁট দিয়া দেন।

মিতি চোখটা খুলে একটুখানি দাঁত বের হওয়াসহ মুচকি হাসি দিয়া বল্লো, মামা ওর চুল কাটবেন না।

তিরু অবাক হয়ে যায়। তখনো তাদের সম্পর্কটা আসলে দাঁড়ায় নাই। সে গোলাকৃতির চোখ রেখে বল্লো, তোমার সমস্যা কী? আমি কাটবোই।

শোনো তোমার চুলের সাইজটায় তোমাকে দারুণ লাগে। তোমার ফেইসটাও তো, খুবই ফটোজেনিক। কেউ বলে নাই তোমাকে?

মিতি যে তাকে খেয়াল করে বা করছে—এটা তিরু প্রথম খেয়াল করলো। মিতির কথা রাখায় তারা চা খেতে বের হলো সেলুন থেকে। চা খেতে খেতে মিতি বল্লো, শোনো বুদ্ধিই সৌন্দর্য। এটাই সুন্দর। তুমি পার্লারে গিয়া ভ্রূ প্লাক করলা, ফেসিয়াল-থ্রেডিং-ফেয়ার পালিশ—সবই করলা আর কথা-বার্তায়, আচরণে তোমার ভেতরে কেউ ডুবই দিতে পারলো না। তাইলে তো মানুষ তোমারে সাইড লাইনে বসায়া রাখবে সব সময়। তুমি সাইড লাইন থেকে মেইন বডিতে আইসা মাঝে মধ্যে পার্টিসিপেট করবা আবার তোমার আলাপ চালানোর অগভীরতার কারণে ফেরত যাবা আগের বসবাসে। এইটা কখনোই ফলো করো না। স্ট্যান্ডার্ডটাকে ভিন্ন জায়গায় সেট করো।

তিরু মন দিয়ে শুনতে শুনতে ডুব দিলো মিতির ভেতরে। এই শুরুটা আর্কিওলজিক্যাল এক্সক্যাভেশনের মতো। যতই খোঁড়ে, ততই ভেতরে নতুন কিছু আবিষ্কারের আসক্তির গভীর টান। এরপর থেকে তাদের সারাদিন এক সাথে ঘোরাঘুরি। একসাথে চলে। ক্লাস-ফ্লাস যে কই গেছে প্রথমদিককার মাসগুলির। ওরা প্রথম চুমু খায় হলের দোতলার লনে। তখন সন্ধ্যা ছিল। বাইরে আযান হচ্ছিল ক্যাম্পাসের মসজিদে। মাথার ওপরে ছিল খোলা আকাশ। চৈত্রের শুরুর দিকটাতে সন্ধ্যায়ও কুয়াশা জমে হলের পেছনের লেকটাতে। তিরুর ভীষণ অস্থির লাগতেছিল আর ভীষণ অন্যরকম লাগতেছিল। সে বার বার জাপটে ধরতেছিল মিতিকে। মিতি এমন ক্যানো! রুমে এসে মিতি তার স্তনে গোল গোল বৃত্ত আঁকতে আঁকতে বলেছিল, আই লাভ টু ডাই টু লিস্যন দ্য সাউন্ড। তিরু উন্মাতাল হয়ে উঠেছিল। তিরু উন্মাতাল হয়ে উঠতো সব সময়। ইভ্যেন, চাকরিতে জয়েন করার পর এক সাথে থাকার দিনগুলিতেও। যদিও তখন তার শরীরও বিভক্ত, মনও বিভক্ত, মননেও দুই ভাগ।

তিরু শুয়ে শুয়ে বাথরুমের আগের বাড়তি ড্রেসিং রুম অংশটাতে রাখা দৈনিক পত্রিকার ফুট তিনেক উচ্চতার স্তর দেখতেছিল। সে খেয়াল করলো ইংরেজি-বাংলা দৈনিকগুলোর মাঝখানে মাঝখানে কিছু সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন টাইপ পত্রিকা রাখা। চোখটা সেখান থেকে তুলে পায়ের বুড়া আঙুল ফলো করতে করতে উরুর কাছে আসতেই সে আবারো খেয়াল করলো, আলোর রম্বসটা খাটো হয়ে আসছে। একটু খানি নিচেও নেমে গেছে।

ফার্স্ট ইয়ার থেকে মাস্টার্স পর্যন্ত চেপে রাখলেও বন্ধুদের কাছে, চাকরিতে জয়েন করার পর যখন সবাইকে জানায়ে তারা ইস্কাটনে বাসা নিলো, তখন কাছের বন্ধুদের জানাতে থাকলো তাদের সম্পর্কটা। আর সেই সময় তারা নিজেদের যৌথতাকে অ্যাড্রেস করতেছিল এইভাবে: উই আর লিভিং টুগ্যাদার। ইটস নট অনলি দ্য বেইজমেন্ট অব ফ্রেন্ডশিপ, মোর দ্যান লিনিয়ার লাভ। মিতি তখন অনেক সিরিয়াস। অফিস শেষ করেই বাসায় ফিরে আসে, একসঙ্গে সন্ধ্যায় চা বানায়া খায়। বেশিরভাগ সময় মিতিই রান্নার প্রেসার নেয়। তিরুর ইচ্ছা করতেছে না একটা কাজ করতে, এটা খুবই খেয়ালে রাখে মিতি। ঠিকাছে, ভাল্লাগতেছে না; ওকে। অপরাধাবোধসহ কাচুমাচু করার দরকার কী। লেইম এক্সকিউজের দরকার নাই। আমার যতক্ষণ খারাপ লাগবে না, ততক্ষণ আমার প্রেসার নিতে সমস্যা নাই—এইরকম আন্তরিক আচরণ করতো মিতি। এই সময়টায় সে হয়ে উঠেছিল অনেকটা স্যাক্রিফাইসিং। ছাড় দিতে ভাল্লাগতো। নিজেই স্পেইস তৈরি করতো, যাতে তিরু বোরড্ না হয়ে যায় সম্পর্ক নিয়ে। তিরু সন্ধ্যায় ফিরতেছে না, না ফিরুক। রাত ১১টায় আসতেছে, অসুবিধা কী? কোনো প্রকার প্রশ্নবোধক চোখও রাখতো না।

ওদের যৌথতার সংসারে বাঁধনহীন বাঁধন আছে বলেও ওরা গল্প করতো বন্ধুদের। এই গল্প অবশ্য মিতি’র রংপুর ক্যান্টনমেন্টের ভেতর পর্যন্ত যেমন পৌঁছাতো না, তেমনি তিরুর উত্তরার বাসা থেকেও খুব বেশি বিপত্তি তৈরি হয় নাই। মিতির লে. কর্নেল ডাক্তার মা শহরে নিজের একটা ব্যক্তিগত ক্লিনিক চালানো নিয়ে এতই ব্যস্ত থাকতেন আর বাবার সাথে দীর্ঘ সেপারেশন তাকে নিষেধের প্রশ্নে কখনোই আটকাতে হয় নাই। শৈশব-কৈশোর ভারতেশ্বরী হোমস এবং এরপর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় তাকে পুরোই বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল পারিবারিক না থেকে। বছরে একবার বা দুই বছরে একবার বাড়ি গিয়ে মাকে দেখে আসে। টেলিফোনে বা ইন্টারনেট চ্যাটিংয়েই কথা সেরে যায় বড়াপিদের সঙ্গে। বাবার সঙ্গে মায়ের সেপারেশন তাকে এত বেশি পেইন দিতো যে বাবা প্রসঙ্গের আলোচনায় সে কখনোই বন্ধুদের সঙ্গে আগ্রহ দেখায় নাই। আবার অনাগ্রহটাও এমনভাবে প্রকাশ করতো যে, বাবার গল্প এড়িয়ে যাওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু মনে হতো না। এসময়টায় সে ইচ্ছা করেই মুখে একটা আনন্দের হাসি রেখে দিতো আর বাবাদের অ্যাপ্রিশিয়েট করতো। ভুলেও অন্য বাবার গুণের সাথে নিজের বাবার কোনো বৈশিষ্ট্য/কোনো আদরের স্মৃতি শেয়ার করতো না। কেবল তিরুই ছিল এসব বেদনার একমাত্র শ্রোতা। মিতি বলতে বলতে কখনো কখনো চিৎকার করে কান্নায় ভেঙে পড়তো। তখন তার চোখ থাকতো অসম্ভব তীক্ষ আর বেদনাময়। ভীষণরকমের বেদনাময়। তামার মতো রং হয়ে যেত চোখের কর্ণিয়ার সাদা অংশ। সেসময়ে তিরুর একটুখানি চুলে হাত বুলিয়ে দেয়া মিতিকে সংযত, দুঃখ কাটিয়ে ওঠার স্থিতি দিতো।

এরকম একদিন মিতি তার তামাটে-কালো আর তীব্র ভাষাময় চোখ থেকে গড়ানো পানি মুছে, বাম হাতে নাকের একটা পাশ চেপে তিরুকে বলতে থাকলো: জানো তিরু! আমার মনে হয় আব্বু আম্মুকে অনেক বেশি ভালোবাসতো। অনেক বেশি ভালোবাসতো বলেই তারা একসঙ্গে থাকতে পারে নাই। আমার মনে হয় আব্বু এখনো আম্মুর জন্য অপেক্ষা করে।

ক্যানো এইটা মনে হয় তোমার? তুমি কি উল্টা করে ভাবতেছ না?

আমার মনে হয়। ক্যান জানি মনে হয়। আমার মনে হয় আব্বু আম্মুর একটা ফোনের জন্য ওয়েট করে। আমি তাকে ক্লাস এইট পর্যন্ত পাইছিলাম। আমি যখন ভ্যাকেশনে বাসায় আসতাম, কখনোই দেখি নাই তাদের ঝগড়া করতে। উল্টা এত কেয়ারিং মনে হতো আব্বুকে। আম্মু কেন যে সেপারেশনে গেল, আই নেভার ক্যান্ট গেইজ এনি থিং।

আমার মনে হয়, কোনো না কোনো একটা লিমিটেশনের জায়গা ছিলই। মানে, একটা গ্যাপ। সেই গ্যাপ নিয়েই হয়তো একসাথে থাকা শুরু করছিলো। ভাবছিলো বিয়ের পর, বাচ্চা-কাচ্চা হয়ে গেলে গ্যাপটা কমে যাবে বাট কমে নাই। এইটা একটা কজ হইতে পারে।
তিরুও গোল করে রাখা পায়ের ভাঁজ থেকে মাথা তুলে মিতি তিরুর চোখের দিকে তাকায়।

আচ্ছা গ্যাপ ছিলো মনে হলো ক্যান তোমার?

মনে হলো। মেইবি। মেইবি। নাও হতে পারে। ওঠো, মন খারাপ করার কিছু নাই এতো। সবাই তো আর রাইট-ম্যাচড্ হয় না। কষ্ট হলে মনে করো আমি আছি তোমার পাশে। আমি সব সময়ই তোমার সাথে সাথে আছি। ওঠো ওঠো। মুখ ধুয়ে আসো।

* * *

রম্বস আলোটা এখন অনেক নিচে নেমে গেছে। বুড়া আঙুলের ডগার একটু নিচে এসে থেমেছে। তিরু মোবাইল সেটটার দিকে তাকালো। ওটা বাজতেছে না দেখে খুব হালকা লাগতে থাকলো। মনে হচ্ছে, মোবাইল না থাকাটা অনেক আরামের একটা ব্যাপার। খোলা থাকলেই অপেক্ষার চাপ থাকে। কথা বলার চাপ থাকে। বছর খানেক পর রিক্যাপ হচ্ছে আগের নয় বছর। মিতির সাথে থাকার ৬ বছরের মাথা থেকে অর্থাৎ চাকরিতে ঢোকার পরের বছরই তিরু যতই মিতির কাছ থেকে দূরে সময় কাটাতো, ততই তার ভাল্লাগতে থাকে বেশি। এ সময়টায় তিরু একটা গ্রুপের সাথে মেশা শুরু করলো, যারা একেবারেই বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক না। প্রফেশন বেইজড্। বিভিন্ন জন বিভিন্ন হাউজে কাজ করে, কিন্তু সন্ধ্যা হলেই তারা অলিয়ঁস ফ্রঁসেজে ক্যাফেতে বসে। রাত ৯টায় ক্যাফে বন্ধ হয়ে গেলে উল্টা দিকের চায়ের দোকানে আড্ডা চলতেই থাকে। এই আড্ডাতে ডিজিটাল মুভি বানানোর ভীষণ ঝড়। ডিজি ক্যামেরায় সিনেমা। দৈর্ঘ্য ছোট, দৈর্ঘ্য বড় যাই হোক। তিরুর খুব ভাল্লাগে এখানে বসে বসে অনেক রাত আড্ডা দিতে। ছবি বানানোর পরিকল্পনা মাথায় কাজ করতে থাকে। গল্পের প্লট, প্লট ছাড়া গল্প, শুধু প্লট, গল্প বলে কিছু নাই–এসব নানা কিছু নিয়ে আড্ডা তিরুর পায়ে দিন দিন আঠা বসিয়ে দিতেছিল তাড়া নিয়ে বাসায় ফিরে না যাবার। সে বুঝতে পারতেছিল, একটা আলগা আলগা কিছু হচ্ছে, হয়ে যাচ্ছে। মাস ছয়েকের মাথায় তিরুর কাছে পরিষ্কার হলো, এই মিতির ওপর আলগা অনুভূতির সাথে রাজনের প্রতি বেশি টান এর সম্পর্ক আছে। এক রাতে মিতিকে একটা প্লট বলতে গিয়ে তার মনে হলো মিতি কম্যুনিকেট করতে পারতেছে না। তিরু বলতে থাকলো,
ধরো, একটা মাছি, মাছিকে ফলো করা। কিছু পচা খাবার, ধরো পঁচা পাাউরুটি বা ফল রেখে দিবা একটা ঘরের ভেতর, সেরকম সময়ে যখন সূর্যের আলো মেঝের একপাশ জুড়ে থাকবে। আর খাবার থাকবে আলোর একপাশে। পড়ে থাকা আলোর খুব কাছে, যেন আলোর প্রতিসরণ গিয়ে একটা আভা তৈরি করে। এরপর ক্যামেরা রেখে দিবা। ক্যাজুয়্যেল শ্যুট। কাজ থাকবে জুম করার মধ্যে। ফিক্সড জুম, জুম ইন, জুম আউট এসব থাকবে।

মিতি আগ্রহ না দেখিয়ে শুনতে থাকলো। তিরু খুবই টান টান উজ্জ্বল চোখে বলতে থাকলো, শোনো এর মধ্যে মাছির ভন ভন শটটা বসানোর আগে আমি কী বসাতে চাই জানো? তোমাকে এডিটিং এর জায়গা থেকে বলতেছি। আমি জনসমাবেশে মানুষের অসংখ্য মাথার টপ শট ইউজ করবো। একটু শ্লো করে মুভি দিবো। আর সাউন্ড থাকবে ভন ভন। এই শটটার পরের শটটাই বিপুল মাছির আগমন। এখানে কোনো গল্প নাই কিন্তু। জাস্ট মাছিকে ফলো করা। বুঝতেছ?

তিরু বলতেছিল রেসপন্স পাওয়ার এমন ভাব নিয়ে যে, মিতি তাকে মাঝখান থেকে থামায়া বলবে, না এটা এইভাবে না, মাথার শট দিয়া শুধু শুধু ফিকশন মেইক করতেছ ক্যান? কিন্তু মিতি কিছুই বলে নাই। খুব মন দিয়া শুনছে বলেই মনে হয়। একটুও বেখেয়াল হয় নাই, তবে কেবল শুনেই গেছে।

তিরুর তখন প্রথমবারের মতো মনে হয়েছে এ জায়গায় রাজন থাকলে অনেক বেশি মজা হতো। অনেক বেশি ভাল্লাগতো আড্ডা দিয়ে। এই মনে হওয়াটাই, তিরুকে অন্য কিছু বুঝতে না দিয়ে ক্রমশই দখল করে ফেলছিল। আড্ডাগুলাতে তিরু যথাসম্ভব দ্রুত গতির দিনের বেগে অনেকের মাঝ থেকে রাজনকে তুলে নিয়ে সিঙ্গেল আড্ডা দেয়া শুরু করলো।

তিরু আলগা হতে থাকলো।

মিতির কিন্তু আলগা লাগতো না। তিরু মিথ্যা বলা শুরু করলো মিতির কাছে। কেন সে মিথ্যা বলা আরম্ভ করলো, এটা তিরু নিজেও বুঝতে পারে নাই, তখন। সে একদিন মিথ্যা বললো, সে চিটগং যাবে। শুটিং লোকেশন ঠিক করতে যাবে প্রোডাকশন টিমের সাথে। তিরু আসলে যাচ্ছিল সিলেটের জাফলংয়ে। রাজনের সঙ্গে বেড়াতে। প্রস্তাবটা তিরুরই ছিল। সে বলেছিল, চলো ঢাকার বাইরে যাই। সিলেট আর পঞ্চগড়ের মধ্যে টস করে সিলেট উঠলো। সে বেড়ানোর জায়গা সিলেকশনের এই পদ্ধতিটাতে অনেক মজা পেয়েছিল। মিতিকে সিলেট বললে, এমন কোনো ক্ষতি ছিল না। কারণ মিতি সেটা যাচাই করে নাই। করার কথাও না। তবু তিরু বলে নাই। কেন বলে নাই, ওই সময়ে ধরতেই পারে নাই। অবশ্য ধরার চেষ্টাও ছিল না তার। তিরু এভাবে আস্তে আস্তে রাজনের সঙ্গে ব্যক্তিগত হয়ে পড়ে।

সিলেট থেকে ফিরে আসার পর তিরুর আলগা লাগা বোধটা আরো বাড়তে থাকে। সে বিছানায় এক সাথে ঘুমাতে গিয়ে কেমন যেন আরাম বোধ করে না। মিতিকে রোজ যেমন ধরে ঘুমাতো, তেমন ধরে ঘুমাতে তার ভাল্লাগে না। কোল বালিশ জড়িয়ে ধরে উল্টা দিকে পিঠ দিয়ে ঘুমায়। বেশি বেশি করে উত্তরায় যেতে থাকে। ইস্কাটনের বাসাটা অপশনাল হয়ে পড়ে। মিতির খুব একলা লাগতে থাকে। মিতি অপেক্ষা করতে থাকে। ভাবে তিরু একটু চঞ্চল, আস্তে করে ঠিক হয়ে আসবে। বেশ কিছু গ্যাপের পর একদিন রাতে; অনেক রাতের পর এক গল্পের রাতে, এক আনন্দের রাতে, এক আড্ডার রাতে তিরু অনেক প্রাণবন্ত ভাব নিয়ে গল্প করছিলো অনেক কিছু। তার নতুন বন্ধুদের গল্প। রাজনের সঙ্গের বেশ কিছু গল্প সে ভিন্ন ভিন্ন নাম ব্যবহার করে বলতে থাকে মিতিকে। যাতে মিতি ধরতে না পারে রাজনকে একক কোনো ক্যারেক্টার হিসাবে। মিতি দেখছিল প্রত্যেকটি গল্প বলায় তিরু কেমন সাবলীল! অনেকদিন পর তিরু এমন সাবলীল। কিন্তু মিতি হঠাৎ প্রশ্ন করে, আচ্ছা রাজনকে তোর খুব ডেপেন্ড্যবল মনে হয়?

ন্-না, ওতো না। বাট বেশ এক্সাইটিং।

কী রকম?

ধরো, আমরা অলিয়ঁসের বাইরে যে আড্ডাটা দেই সেই আড্ডায় রাজন হুট করে এমন সব প্রপোজাল দেবে, সে, ঘুরাঘুরি—একজন বললো সিলেট যাবো। আরেকজন বললো সেন্টমার্টিন আর একজন বললো বান্দরবান আর রাজন বলবে পঞ্চগড়। ও বোঝানোর চেষ্টা করবে আনয়্যুজাল জায়গায় যাবার চার্মটা কেমন। আচ্ছা, তুমি ওই আড্ডায় যাইতে চাও না ক্যান?

তুমি তো আমাকে বলো নাই। ওইটা তো তোমার আড্ডা। তুমি আমার হোস্ট। না বললে, যাবো কী করে?

বললে যাবা?

যাবো।

ওকেই। কাল চলো। সন্ধ্যার পর। মানে ৮টা ৯টার দিকে। আমি ওখানেই থাকবো। তুমি চইলা আইসো।

* * *

পরদিন রাতে মিতি গিয়ে দেখলো, তিরু আর রাজন ছাড়া আর দুই তিনজন। যাদের কাউকেই মিতি চেনে না। সে বেশ কিছুক্ষণ একসাথে কাটাতে গিয়ে দেখলো তিরু রাজনের পাশাপাশি বসতেই বেশি আনন্দ পায়। মিতি যেন অনেকদিন পর দেখা হওয়া এক বন্ধু। কেবলই বন্ধু। মিতি প্রথমবারের মতো আলগা ফিল করতে থাকলো। ফেরার সময় রাজন তিরুকে আটকে রেখে কথা বললো অনেকক্ষণ। মিতিকে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে একা, তিরু ফিরতে চাইলেই রাজন হাত ধরে রাখে। আর একটু পর বলে আবদার করতে থাকে সময়। মিতির নিজেকে বাড়তি মনে হতে থাকে। এখানে সে অপ্রয়োজনীয় এমন একটা কমপ্লেক্স, এখানে সে মিশতে পারছে না এমন এক অস্বস্তি, এখানে সে অযথাই এমন বোধ হতে থাকে। প্রায় মিনিট ১৫র মধ্যে মিতি ঘুরপাক খেতে থাকলো অস্থিরতায়। সে বার বার একটা দরজায় গিয়ে বাড়ি খেয়ে ফিরতেছে। কোনোভাবেই সে দরজা খুলছে না। সে বুঝতে পারতেছে না কী ভাবে এটা ওভারকাম করা যায়।

বাসায় ফিরে মিতি অস্থিরতা নিয়েই প্রশ্ন করলো, তিরু তুমি কি রাজনের প্রেমে পড়ছো?

তিরু অবাক হওয়ার মতো এক্সপ্রেশনের সঙ্গে খানিকটা সন্দেহ যোগ করে চোখ কুঁচকে পাল্টা জিজ্ঞেস করলো, ‌’মানে কী?’

মানে কী? মানে সরাসরি হাঁ বা না বলবা। কোনো ব্যাখ্যা আমি শুনতে চাই না। তুমি হাঁ বা না একটা এনস্যর করবা।

রাজনের সঙ্গে প্রেম করবো কেনো?

তিরু তুমি একটা সিঙ্গেল এনস্যর সিলেক্ট করো।

তিরু খেয়াল করলো, মিতি অন্যরকম হয়ে উঠতেছে। ওর চোখ তামাটে হয়ে জ্বলে উঠতেছে। বাসায় ফিরে ড্রেস চেইঞ্জ না করেই মিতি তাকে প্রশ্ন করা শুরু করলো।

‘আমি পারবো না বলতে। আমার কাছে এরকম সরাসরি কোনো এনস্যর নাই। যেটা নাই সেটা বলার জন্য আমাকে প্রেসড্ করবা না।’ বলেই তিরু বাথরুমে ঢুকে গেল ড্রেস চেইঞ্জ করতে। বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে তিরু একই ড্রেসে বের হয়ে এসে বললো, ‘আমি উত্তরায় যাচ্ছি। আম্মু ফোন করছে।’

মিতি অপেক্ষায় বসে থাকবার পর এরকম কথা শুনে জ্বলে উঠলো। ‘না তুমি যেতে পারবা না। আমার সাথে কথা শেষ হবে, তারপর যাবা।’

মানে? আম্মু ফোন করছে! তোমার কোশ্চেন কালকে এনস্যর করবো। এখন ঝামেলা করবা না।

ঝামেলা! আমি অনেক ঝামেলা করবো। আমার শেষ কথা না শোনা পর্যন্ত তুমি কোথাও নড়বা না। কোথাও যেতে পারবা না। বসো এখানে।

তিরু প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ হচ্ছে এমন ভাব এনে বললো, তোমার এই ক্রেজি ম্যানারস আমার পছন্দ না।

আমার অনেক কিছুই তোমার পছন্দ না। সেটা আমাকে বোঝানোর দরকার নাই। তুমি বলো, রাজনের সঙ্গে তোমার সম্পর্ক কতটুক বন্ধুত্বের?

পুরোটাই বন্ধুত্বের।

কী রকম বন্ধুত্ব?

আরে? এখন তোমাকে কি আমি উদাহরণসহ বোঝাবো নাকি? আই এম ট্রান্সপারেন্ট লাইক এনিথিং।

‘ওহ! তিরু! তুমি সত্য বলো।’ মিতি হাত ঝাঁকাতে লাগলো। ওর মাথাও একই বেগে নড়তে থাকলো। ‘তুমি বলো, রাজনের সঙ্গে কোথায় কোথায় ডেইট করছো? কই কই গ্যাছো? কিচ্ছু লুকাবা না।’

তিরু প্রচণ্ড ক্ষিপ্ততা চোখে এনে বললো, ‘অনেকবার। অনেক জায়গায়।’

মানে?

মানে আমার রাজনকে ভাল্লাগে। অনেক ভাল্লাগে।

ওর সাথে সেক্স করছো কোথায়?

জাফলংয়ে। আরো অনেক জায়গায়।

‘তিরু!!!’ মিতি চিৎকার করতে থাকলো। সে চিৎকার করে কাঁদতে থাকলো। ইলেকট্রিসিটি চলে গেলে অন্ধকারকে এডজাস্ট করবার আগ পর্যন্ত চোখ যেমন সব কিছুই নিকষ অন্ধকার দেখে, মিতির কাছে চারপাশ সেরকম অন্ধকার মনে হচ্ছিল। মিতি তিরুতিরুতিরু করে কীসব চিৎকার করতেছিল, একটা লাথি দিয়ে প্লাইউডে বানানো ওয়াড্রোবের কাভার্ডটা ভেঙে ফেললো। তিরু ভয় পেতে থাকলো। মিতি একনাগাড়ে কাঁদতে থাকলো। চিৎকারের কান্না যখন ফোঁপানোতে টার্ন করলো মিতি আবার জিজ্ঞেস করলো, ‘তুমি কবে থেকে রাজনের সঙ্গে প্রেম করা শুরু করলা?’

আমি রাজনের সঙ্গে প্রেম করি না মিতি। কিন্তু ওকে আমার অনেক ভাল্লাগে।

অসম্ভব। অ্যাবসার্ড। তুমি এখনো লুকাইতেছো। তুমি আর লুকাবা না। তুমি আমাকে বলো রাজনের সঙ্গে প্রেম শুরুর আগে কি আমাকে বলা দরকার ছিলো না?

ও মিতি। বি কুল আমি রাজনের সঙ্গে প্রেম করি না। প্রেম করি নাই। আমি তো বলছি, এটা এম্নি রিলেশন।

মিতি সরাসরি তাকায় তিরুর চোখে। কিছুক্ষণ স্থির তাকায়া থেকে বললো, ‘তুমি এই ভাল্লাগা রিলেশনটা আমার কাছে লুকায়া রাখছিলা ক্যানো? আমাকে আড়াল করছো ক্যান? তার মানে আমাকে তুমি প্রব্লেম ভাবছো, তাই না? লুকাইছো ক্যান?’

লুকাই নাই। বলতে পারি নাই। আই নিড সাম টাইম। কজ ইটস অলসো অ্যানাদার স্পেশাল থিং ফর মি।

তিরু তুমি নানা ভান করছো। তুমি রাজনকে নিয়া সিলেট গ্যাছো, আমারে বলো নাই। তুমি রাজনের সঙ্গে সারাদিন ঘুইরা আইসা আমারে বলছো অন্যদের কথা। ক্যানো এত মিথ্যা বলছো? ক্যানো আড়াল করছো? আমার সাথে এত ডার্টি ডিসট্যান্স করলা?

আমি ডার্টি ডিসট্যান্স করি নাই।

চুপ! কোনো প্রকারে ডাইভার্ট করার চেষ্টা করবা না। তুমি ভয়ানক অপরাধ করছো। তুমি আমার বিশ্বাস ভাঙছো। তুমি আমাকে অনেক মিথ্যায় আটকায়া রাখছিলা লাস্ট ফিউ মানথস্। ও মাই গড! তিরু তিরু আমি ভাবতেই পারি নাই। বলে আবার প্লেট-গ্লাস ভাঙা শুরু করলো মিতি। একটা খুবই ভয়ানক অবস্থা। তিরুর মনে হইতেছিল কিছু গ্লাস যেন তার মাথায় ভাঙা হচ্ছে। সে কোনো প্রতিবাদ না করে খাটের এক কোনায় বসে থাকলো। মিতি আবার কাঁদতে কাঁদতে ফ্লোরে গড়াগড়ি খেতে থাকলো।

কী ভয়ানক সেই দৃশ্য। কী ভারি সেই দৃশ্য! তিরু ভাবতে গেলে এখনো পুরাটা বুঝতে পারে না, কেন সে এমন অচেনা করে রেখেছিল মিতির কাছে নিজেকে। কেন মিতির চাইতে রাজনকে বেশি ভাল্লাগতো। কেন সেই ভাল্লাগাটা মিতির সাথে শেয়ার করা যায় নাই।…

* * *

তিরু খেয়াল করলো রম্বস আলো তো নাই-ই। চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসছে। সে ফ্লোর থেকে মাথা উঁচু করে বারান্দা দিয়ে পাশের একটা লম্বা আর ব্যাপক ডালপালা ছড়ানো আমাগাছটা দেখতে থাকলো। ওখানে পাতাগুলা আর আলাদা করে চেনা যাচ্ছে না। সে উঠে দাঁড়ালো। ড্রেস পরে মোবাইলটা অন করলো। বারান্দায় এসে দাঁড়ালো—নানা জানালায়, ভারি পর্দা গলে সাদা আর কিছু কিছু হলুদ আলো বের হচ্ছে—আর চারপাশটা নিলচে-কালো অন্ধকার। বাতাস আসছে। মিহি বাতাস। একটা অদ্ভুত আশ্রয় ভর করছে তিরুর পুরো শরীর এবং মন ঘিরে। নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করতে থাকলো, অপেক্ষা ক্যামন? এই জীবনে কখনোই তাকে অপেক্ষার স্বাদ নিতে হয় নাই। মানে প্রেম জাতীয়, প্রেমজর জন্য অপেক্ষা। সব সময় সে-ই অপেক্ষায় রাখছে। আচ্ছা অপেক্ষা ক্যামন?

আচ্ছা মিতি কোথায় আছে এখন?

কার সাথে থাকে?

মিতি কি চলে গেছে কোথাও? নাকি ঢাকায়?

তিরুর মনে হতে থাকলো, সামনের আম গাছ, তার ওপরকার পাঁচতলা বাড়ির জলছাদ, এটা পার হয়ে দম-ইনোর অ্যাপার্টমেন্টের চূড়া গুড়িয়ে সমান করে একটা বিশাল, ইলেকট্রিকের পোলহীন, একটা বিশাল হাকালুকি হাওর শুয়ে পড়েছে। শীতকালের হাকালুকি হাওর। বিস্তৃত মাঠ, কিছুদূর মাঠের পর পর পেরিনিয়্যাল হাওর, জল টলোমল। ধারে ধারে অনেক শীতের পাখি। বক আর হাসজাতীয়। ওরা বসে থাকে, উড়ে যায়। নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করে, কানে-কানে কথা বলে, হাগু করে আবার ডুবে থাকে প্রেমে, অপ্রেমেও। তিরুর মনে হতে থাকলো, মিতি একটা টিভিএস হান্ড্রেড মটর বাইক চালিয়ে চুলে বাতাস মাখতেছে আর তিরু পেছনে তাকে ঝাপটে ধরে বসে আছে। আর বলতেছে, এইবার ছাড়ো, মিতি! এইবার আমি চালাব। ছাড়ো! নেক্সট আবার তুমি। মিতির ভাবটা স্পষ্ট দেখেতে পাচ্ছে তিরু: ওর ভঙ্গিটা এমন, অনেক মজা পাচ্ছে এবং ছাড়বে ছাড়বে সিদ্ধান্তের দিকে যাচ্ছে।…।

নিজের অজান্তেই তার চোখ বিষণ্ন থেকে সচল হয়ে উঠতে থাকলো। একটু হেসে, ধুলাপড়া গ্রিলে মুখ রাখলো। বাতাসটা খুব ভাল্লাগতেছে। এত মিহি আর এত চিকন!

বেশ কিছুক্ষণ ধরে মোবাইল ফোনটা বেজেই যাচ্ছে। রুমে এসে দেখে, অবধারিত নাম্বার।

‘… … … … … … … … … … … …’

‘তওফিক আমার শরীর ভালো না। আমি ঘুমাই গেছিলাম। এই একটু আগে উঠলাম।’

‘… … … … … … … … … … … …’

‘না। না, আর বাইরাবো না। বেশ কিছু প্রপোজাল রেডি করতে হবে।’

‘… … … … … … … … … … … …’

‘… … … … … … … … … … … …’

‘… … … … … … … … … … … …’

‘হুম। কালকে। কাল অফিস ছুটির পর ফোন দিবো।’

মার্চ ২০০৯
===================================
শামীমা বিনতে রহম

জন্ম: ২৫ নভেম্বর। নোয়াখালীতে। পড়াশোনা আর্কিওলজি বিষয়ে। একজন রিপোর্টার।
==================================
গল্প- আলিমের নিভৃতিচর্চা by রাশিদা সুলতানা   গল্প- প্রত্যাবর্তন: আমার ‘ফেরা’ নিয়ে যে কাহিনী না ..মানষ চৌঃ   গল্প- 'বীচিকলায় ঢেকে যায় মুখ ও শিরোনাম' by আনোয়ার ...  গল্প- 'প্রীত পরায়া' by সিউতি সবুর   গল্প- 'চলিতেছে' by মাহবুব মোর্শেদ   গল্প- 'গোপন কথাটি' by উম্মে মুসলিমা   গল্প- 'রূপকথা' by লুনা রুশদী  সঞ্জীব চৌধুরীর কয়েকটি গল্প   গল্প- 'অস্বস্তির সঙ্গে বসবাস' by ফাহমিদুল হক   গল্প- 'মঙ্গামনস্ক শরীরীমুদ্রা' by ইমতিয়ার শামীম   গল্প- 'হাজেরার বাপের দাইক দেনা' by জিয়া হাশান  গল্প- ‘অপঘাতে মৃত্যু’ ও ‘সাদামাটা’ by লীসা গাজী   গল্প- 'দ্বিতীয় জীবন' by ইরাজ আহমেদ  গল্প- 'পুষ্পের মঞ্জিল' by সাগুফতা শারমীন তানিয়া   গল্প- 'একশ ছেচল্লিশ টাকার গল্প' by কৌশিক আহমেদ  গল্প- 'একে আমরা কাকতালীয় বলতে পারি' by মঈনুল আহসান..   গল্প 'গহ্বর' by জাহিদ হায়দার    গল্প- 'পুরির গল্প' by ইমরুল হাসান  গল্প- 'নওমির এক প্রহর' by সাইমুম পারভেজ  গল্প- 'মরিবার হলো তার সাধ' by আহমাদ মোস্তফা কামাল   গল্প- 'নিষুপ্ত শেকড়' by নিরমিন শিমেল   গল্প- 'লাল ব্যাসার্ধ্ব' by শামীমা বিনতে রহমান  গল্প- 'সেদিন বৃষ্টি ছিল' by মৃদুল আহমেদ   ক. কিছুদিন হয় সেই নগরে কোন বৃষ্টি হচ্ছিল না। কিছুদ.. গল্প- 'তুষার-ধবল' by সায়েমা খাতুন  গল্প- 'কোষা' by পাপড়ি রহমান  গল্প- 'কর্কট' by রাশিদা সুলতানা   গল্প- 'তিতা মিঞার জঙ্গনামা' by অদিতি ফাল্গুনী  গল্প- 'সম্পর্ক' by তারিক আল বান্না  গল্প- 'অনেক দিন আগের দিনেরা' by রনি আহম্মেদ  গল্প- 'গাদি' by ইফফাত আরেফীন তন্বী   গল্প- 'কামলাঘাটা' by অবনি অনার্য   গল্প- 'কক্ মানে মোরগ: উদ্ভ্রান্ত মোরগজাতি ও তাহাদে.    গল্প- 'ভরযুবতী ও বেড়াল' by সাগুফতা শারমীন তানিয়া  গল্প- 'অমর প্রেম অথবা আমার প্রেম' by ইমরুল হাসান



bdnews24 এর সৌজন্যে
লেখকঃ শামীমা বিনতে রহমান


এই গল্পটি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.